মাতুপত্তি ড্যাম, মুন্নার ভ্রমণ

মুন্নারের চা-বাগানের রূপে বিমুগ্ধ হওয়া আর সবুজের জাদুতে হারিয়ে গিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম মুন্নার টি মিউজিয়ামে। সেখানে ঘন্টা দু’য়েকের উপরে সময় কাটিয়ে আমরা রওনা হলাম মুন্নারের বিখ্যাত মাতুপত্তি ড্যাম (Mattupetty Dam) উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে একেবারে রোড সাইড খাবারের দোকান যাকে বলে, সেরকম একটি খাবারের ভ্যান এর নিকটে থামানো হল আমাদের গাড়ীটি। উদ্দেশ্য দুপুরের খাবারের পাট চুকিয়ে নিয়ে তারপর ড্যামে প্রবেশ করবো। Amma Homly Food নামক সেই হোমলি রান্না করা খাবারের দোকান চালাচ্ছিলেন বছর চল্লিশের এক ভদ্রমহিলা। হাস্যমুখে আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। রাস্তার উপর একটা খাবারের ভ্যান এবং তার পাশেই প্লাস্টিকের টেবিল-চেয়ার পাতা গাছের ছায়ায়, খোলা আকাশের নীচে। সবজি, গরুর মাংশ, মাছ, সাম্বার, ডাল, চাটনি, আচার সহ নানান আয়োজন দিয়ে আয়েশ করে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিলাম দলের চারজনই। খাবারে পদ এবং স্বাদের তুলনায় বিল এর পরিমাণ খুব বেশীই কম ছিল, তা আর উল্লেখ না করলাম। আহা, আবার যদি খেতে পারতাম। ও হ্যাঁ, ভালো কথা; ভারতের অন্যান্য জায়গায় গরুর মাংস মেলা দুষ্কর হলেও কেরালায় কিন্তু এভেইলেবলই ছিল। খাবার এর পাট চুকে গেলে রওনা হয়ে গেলাম মাতুপত্তি ড্যাম এর দিকে। 

 

মুন্নারের চিরহরিৎ পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে চলা এই মাতুপত্তি ড্যাম এর অবস্থান কেরালা আনামুদি পিক (Anamudi peak) এর পাদদেশে। এই মাতুপত্তি মূলত একটি হিল ষ্টেশন, যার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১,৭০০ মিটার। এটি মুন্নার শহরের কেন্দ্রস্থল হতে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের সারির ভাঁজে ভাঁজে সবুজ গালিচার ন্যায় উপত্যকা আর চমৎকার শীতল আবহাওয়া যে কোন পর্যটকের মন কেড়ে নিবে নিমিষেই। এই মাতুপত্তি পাহাড় সারির বুক চিড়ে গড়ে ওঠা মাতুপত্তি ড্যাম হল এখানকার প্রধান আকর্ষণ এবং এই কৃত্রিম হ্রদ এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে। 

 

এই মাতুপত্তি ড্যাম হল বিশেষ ধরনের গ্রাভিটি ড্যাম, এই ধরনের ড্যাম শক্ত পাথর বা কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়, যা উঁচু স্থান হতে প্রবাহমান পানির ধারার মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে প্রতিরোধ করে পানিকে ধরে রাখতে পারে। এই বাঁধগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন, প্রতিটি অংশ সমানভাবে পানির চাপ সহ্য করে পানি ধরে রাখতে পারে। ফলে এই ধরনের ড্যাম সাধারণত শক্ত শিলাখন্ডের ভৌতিক গঠনগত পাহাড়ে বেশীরভাগ সময় তৈরি করা হয়ে থাকে। কেরালার মুন্নারের এই ড্যামটি ১৯৪০ সালে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন করার লক্ষ্যে নির্মান শুরু হয়, যার কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৭০ এর পরে। এই বাঁধ এখন শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, বন্যপ্রাণী আর পাখীদের এক অভ্যয়ারণ্যেও পরিণত হয়েছে।  

 

এই ড্যামের অন্যতম আকর্ষণ হল স্থির জমে থাকা পানিতে সবুজ পাহাড়ের ছায়া, সারিসারি চা-বাগান, আর দূরে পাহাড়ের গায়ে ঘুমিয়ে থাকা গহীন বনের হাতছানি। পর্যটকদের জন্য রয়েছে স্পীড বোটে করে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, রয়েছে নিজে নিজে চালানোর জন্য প্যাডেল বোট। শান্ত এই হ্রদের পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকলেও আপনার বিরক্তি ধরবে না। এই ড্যামকে কেন্দ্র করে ১৯৬৩ সালে ভারত এবং সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, গো-প্রজনন এবং ডেইরীর লক্ষ্যে। মুন্নারের সবুজ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা এই প্রজেক্ট বর্তমানে ‘কেরালা লাইভ স্টক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মিল্ক মার্কেটিং বোর্ড’ যার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

 

 

এখানে প্রবেশের জন্য আপনাকে মাত্র ১০ রুপী দিয়ে টিকেট কাটতে হবে। আর বোটিং করতে চাইলে প্রতি পাঁচজনের গ্রুপের জন্য প্রতি ১৫ মিনিটের খরচ ৩০০-৫০০ টাকা, সাধারণ বোট; ৭০০-১০০০ টাকা স্পীড বোট। আমরা যখন টিকেট কেটে এই ড্যামে প্রবেশ করছিলাম, ঠিক তখনই একটা স্কুল বাসে করে একটা স্কুল ছাত্রছাত্রীদের দল স্কুল ড্রেস পরিহিত অবস্থায় বেড়াতে এলো এখানে; সাথে দু'তিন জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। দল বেঁধে সুশৃঙ্খলভাবে তারা প্রবেশ করলো, কেউ কেউ রাস্তার পাশের নানান খাবারের দোকান হতে খাবার কিনে নিচ্ছিলো। 

 

 

 

 

আমরাও ঢুঁকে পড়লাম তাদের পিছু পিছু। নীল জলের চারিধারে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি। সবুজ গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে সবকয়টা পাহাড় এবং তাদের পাদদেশ। আমাদের দলের সবাই নিজেদের মত করে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছিলাম; আমি লেকের জলের একেবারে কোল ঘেঁষে একটা ছায়াযুক্ত গাছের নীচে ঘাসের উপর বসে পড়লাম। অদ্ভুত এক প্রশান্তি যেন জাদুর পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিলো দেহমনে। অনেকটা সময় এখানে কাটিয়ে দিয়ে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা রওনা হলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে, ব্লসোম পার্ক এর উদ্দেশ্যে।

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ