জল জোছনার খোঁজে
আমি সবসময় একা নয়ত কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সাথে বেড়াতে অভ্যস্ত, আর গ্রুপের সাথে ট্যুরে গেলে সেটা হয় ভ্রমণ বাংলাদেশের সাথেই। এবার প্রথম ভ্রমণ বাংলাদেশের অন্যতম কার্যকরী সদস্য আবু বকর ভাইয়ের “ইকো ট্র্যাভেলার্স” এর সাথে ভ্রমণে বের হলাম। আগে থেকে দেয়া গেস্ট লিস্টে পরিচিত কাউকে দেখতে না পেয়ে তৈরি ছিলাম একা একা সময়গুলো উপভোগ করার। কিন্তু কমলাপুর পৌঁছে দেখলাম দশ বারো জন পূর্ব পরিচিত ভ্রমণ সঙ্গী রয়েছে যাদের সাথে আগে ভ্রমণ বাংলাদেশ হতে ট্যুর করেছি। ফলে সময়গুলো খুব খারাপ কাটবে বলে মনে হল না।
ভোর ছয়টার কাছাকাছি সময়ে ট্রেন পৌঁছলো ময়মনসিংহ ষ্টেশন, এখানে ট্রেন থেমে রইল বেশ কিছু সময়। ট্রেন হতে নেমে বৃষ্টির ছাঁট মাথায় নিয়ে চা পান করে নিলাম। এখান হতে দেখলাম মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে লোকাল ট্রেন ছাড়ে। হুমায়ূন আহমেদের সুবাদে এই এলাকার বেশ কিছু ষ্টেশনের নাম মনে গাঁথা ছিল। এক এক করে সেইসব ষ্টেশন পার হওয়ার সময় মনে পড়ছিল প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে। মোহনগঞ্জ, গৌরীপুর, শ্যামগঞ্জ, বারহাট্টা সহ কত নাম জানা না জানা ষ্টেশন পার হয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ। সেখানে ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে। সেখানে সকলে ফ্রেশ হয়ে লোকাল একটা রেস্টুরেন্টে সেরে নিলাম সকালের নাস্তা, সাথে চা আর লোকাল মিষ্টি। পেট পুজোর পর আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ষ্টীল বডির ইঞ্জিন নৌকায় সবাই উঠে পড়লাম। কেউ কেউ নীচের ছাউনির ভেতরে, আর বাকীরা ছাঁদে চেয়ার বসে বসে, অথবা হাত-পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। ইঞ্জিনের বিরক্তিকর শব্দের উৎপাত ঢাকা পড়ল বৃষ্টিভেজা চারিদিকের সবুজ প্রকৃতি। জলরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলল আমাদের নৌযান।
রেইন কোট পড়ে, মাথায় ছাতা দিয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়। একসময় সব কিছু বাদ দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাওড়ের রূপসুধা পান করতে করতে এগিয়ে চললাম সম্মুখ পাণে। সাথে করে ঢাকা থেকে আমাদের টুলু বাবুর্চিকে নিয়ে যাওয়ায় খাবারের সকল আয়োজন নৌকাতেই হয়েছিল। হাওড়ের বেশ কয়েক পদের মাছ দিয়ে আয়োজন ছিল লাঞ্চের। লঞ্চের ছাঁদে বসে খোলা আকাশের নীচে জলের দুলুনিতে খাওয়ার মজাই অন্যরকম। কিন্তু বিকেল হতেই শুরু হল ঝড়ো হাওয়া, উত্তাল হল হাওড়। ২০১৩ সালের হাওড় ট্যুরের সময় বন্ধু মনার মুখে শুনেছিলাম হাওড়ের ঢেউ নাকি ভয়ংকর হয়। এবার তার রূপ দেখলাম, অবিশ্বাস্য। আমাদের গন্তব্যের সাথে ঢেউয়ের অভিমুখ ছিল প্রায় নব্বই ডিগ্রী, ফলে ঢেউ সরাসরি নৌকার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছিল, ক্ষণে ক্ষণে নৌকা কাত হয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেল, মাঝিকে বারবার বলছিলাম নৌকার দিক একটু ঘুরিয়ে দিতে, যাতে করে ঢেউয়ের আঘাত সরাসরি নৌকার বডিতে না পড়ে। কিন্তু মাঝিটা বড়ই বেয়ারা ছিল, সে একটু পরপরই নৌকাকে ঢেউয়ের সাথে নব্বই ডিগ্রী এঙ্গেলে নিয়ে যাচ্ছিল। শেষে বাধ্য হয়ে সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিলাম, আসন্ন যে কোন বিপদের জন্য। আবহাওয়া বেশী খারাপ হলে, একটা দ্বীপ গ্রামে নৌকা ভেড়ানো হল। দুপুরের নামাজ ছিল জুম্মা নামাজ, মূল হাওড়ে ঢোকার আগে একটা গ্রামের মসজিদে সেটা সেরে নিয়েছিলাম। এবার এই গ্রামে আসরের নামাজ সেরে নিলাম এই ফাঁকে। নামাজ শেষে নৌকায় ফিরে দেখি পরিস্থিতি একটু ভাল, ঢেউয়ের উত্তালতা একটু কমেছে। আবার নৌকা ছাড়ল, রওনা হলাম টেকেরঘাটের দিকে। চোখের সামনে মেঘালয় পাহাড়ের মেঘের খেলা, তার নীচে সাজানো গ্রাম, নৌকা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল সেই মায়ার ভুবনে।
সন্ধ্যার লগ্নে নৌকা ভিড়ল ঘাটে, সাথে শুরু হল ঝুম বৃষ্টি। টেকেরঘাটে একটিমাত্র আবাসিক হোটেল, স্থানীয় চেয়ারম্যানের মালিকানার “খন্দকার আবাসিক” যেখানে রুম মাত্র চারটি। তাই প্রতিবার টেকেরঘাটে ভ্রমণসাথী বেশীরভাগ ছেলের দল নৌকায় কাটাই সারা রাত। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ২০১৩ সালেও অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, এবারো হবে। বৃষ্টি দেখে মেজাজ খারাপ আমার, ঢাকা থেকে আসার আগে ভেবেছিলাম নিম্নচাপ তো দক্ষিণে, এই উত্তরে নিশ্চয়ই তার প্রভাব থাকবে না। কিন্তু কোথায় কি? নৌকা হতে নেমে স্থানীয় মসজিদ যা ঐ ঘাটের একেবারে লাগোয়া, সেখানে চলে গেলাম মাগরিবের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে কি মনে হল, মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আট-দশজন মসজিদের লাগোয়া ছাউনি ঘেরা বারান্দায় রাত কাটানোর অনুমতি পেয়ে গেলাম।
বৃষ্টি একটু কমে আসলে নৌকায় ফিরে এসে আবার ছাঁদে উঠে পড়লাম, নাহ মেঘের কমতি নেই আকাশে। আহা আমার জল জোছনায় স্নানের সাধ! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, রাতের খাবার খাওয়া শেষে যখন সবাই ছাঁদে উঠে এলাম, তার কিছুক্ষণ পর মেঘ সরে গিয়ে মুখ দেখালো পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের আলোয় পুরো হাওড় যেন এক রহস্যময় অপার্থিব জগতে পরিণত হয়ে গেল। মুগ্ধতার সাথে আমরা সাত আটজনের দল চেয়ে রইলাম সেই ঘোর লাগা সৌন্দর্যের দিকে। গেয়ে উঠলাম, এই জল জোছনায়....