আমার ঢাকা, প্রাণের ঢাকা, আমাদের ঢাকা। শতবর্ষী এই ঢাকার বুকে আজও টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শতবর্ষী অনেক পুরাকীর্তি যার বেশীরভাগই কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং নগরায়নের জোয়ারে এগুলোর খোঁজ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আর তাই বোকা মানুষের এবারের আয়োজন তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক, আজ যার প্রথম পর্ব থাকছে। তিনটি পর্বে ঢাকা এবং ঢাকা শহরের আশেপাশের বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে পোস্ট থাকবে, যাতে করে আগত দিনে যে কেউ চাইলে এই পোস্ট হতে একসাথে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের খোঁজ পেয়ে যেতে পারে সহজেই।
আসুন শুরু করা যাক, যেহেতু আমার বাস পুরাতন ঢাকার লালবাগে এবং আমার প্রিয় ভ্রমণ সংগঠন ভ্রমণ বাংলাদেশের অফিস একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের একেবারে গাঁ ঘেঁষে অবস্থিত, তাই সেই স্থান দিয়েই শুরু করি। এটি আর অন্য কিছু নয়, প্রাচীন মসজিদ, খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ।
খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদঃ ধারণা করা হয়ে থাকে ১৭০৪-১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে খান মোহাম্মদ মৃধা ভূমি থেকে ৫ মিটারের বেশী উঁচুতে প্রায় ৩৮ মিটার বাই ২৯ মিটার আয়তনের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এই মসজিদ কম্পাউন্ডে মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে হাতের বাম দিকে রয়েছে মূল মসজিদ কাঠামো। ডানদিকে বিস্তৃত বাগান এবং এই বাগানের উত্তরপূর্ব কোনে একটি পরিত্যাক্ত কুয়া রয়েছে, একসময় সেই কুয়ার পানি দিয়ে মুসল্লিদের অজু এবং অন্যান্য ব্যবহার্য পানি সরবরাহ করা হত। মূল মসজিদের কাঠামো তিন গুম্বজ বিশিষ্ট এবং এর চারিদিকে ছোট ছোট প্রায় বিশ-পঁচিশটি মিনারের মত কাঠামো রয়েছে। মসজিদটি বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে থাকলেও নামাজের জন্য তা স্থানীয়দের রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছ।
এবার আসুন একটু এগিয়ে যাই লালবাগের কেল্লার দিকে। খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ হতে ২০০ গজ পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই লালবাগ কেল্লা। এই কেল্লা নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই।
লালবাগ কেল্লাঃ প্রথমে এই কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। আর এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর ৩য় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মাত্র এক বছর পরেই দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙগজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়।নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকায় এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গ অপয়া মনে করা হয় এবং শায়েস্তা খান ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ বন্ধ করে দেন। এই পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এখানকার স্থাপনার অন্তর্গতঃ পরীবিবির সমাধি বেশ উল্লেখযোগ্য। এটি মোগল আমল এর একটি চমৎকার নিদর্শন। প্রশস্ত এলাকা নিযে লালবাগ কেল্লা অবস্থিত। কেল্লার চত্বরে তিনটি স্থাপনা রয়েছেঃ (১) কেন্দ্রস্থলের দরবার হল ও হাম্মাম খানা, (২) পরীবিবির সমাধি এবং (৩) উত্তর পশ্চিমাংশের শাহী মসজিদ। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্বাংশে সুদৃশ্য ফটক, এবং দক্ষিণ দেয়ালের ছাদের উপরে বাগান রয়েছে। বর্তমানে রবিবার পূর্ণ দিবস ও সোমবার অর্ধদিবস বন্ধ থাকে। সপ্তাহের বাকী ছয়দিন এই কেল্লা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
এবার লালবাগ কেল্লা হতে একটু উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়ে চলে আসি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দিকে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরঃ এটি ঢাকা শহরের অন্যতম প্রধান একটি মন্দির যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম একটি তীর্থস্থান তথা উপাসনালয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির ঢাকা শহরের পলাশী ব্যারাক এলাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহের দক্ষিণে ঢাকেশ্বরী রোডে অবস্থিত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সাথে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে মহানগর পুজামণ্ডপ অবস্থিত। এখানে যেখানে দুর্গা পুজার স্থায়ী বেদী রয়েছে। মূল মন্দির এলাকার ভবনগুলি উজ্জ্বল হলুদাভ ও লাল বর্ণের। মূল মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তর পশ্চিম কোণে রয়েছে চারটি শিব মন্দির। মূল মন্দিরটি পূর্বাংশে অবস্থিত। এখানে দেবী দুর্গার একটি ধাতু-নির্মিত প্রতিমা রয়েছে।
এখন চলুন আরও পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে বকশীবাজার এলাকা পার হয়ে চলে যায় হোসেনী দালান।
হোসেনী দালানঃ হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকা এলাকায় অবস্থিত একটি শিয়া উপাসনালয় এবং কবরস্থান। বিকল্প উচ্চারণ হুস্নী দালান এবং ইমারতের গায়ে শিলালিপিতে ফারসী ভাষায় লিখিত কবিতা অনুসারে উচ্চারণ হোসায়নি দালান। এটি মোগল শাসনামলে ১৭শ শতকে নির্মিত হয়। ইমারতটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পৌত্র হোসেন (রাঃ)-এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদৎবরণের স্মরণে নির্মিত। প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো এ স্থাপনা মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তাঁর এক নৌ-সেনাপতি সৈয়দ মীর মোরাদ কর্তৃক হিজরী ১০৫২ সনে (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়।তিনি প্রথমে তাজিয়া কোণা নির্মাণ করেন, ইমামবাড়া তারই পরিবর্ধিত রূপ। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে নির্মাতা হিসেবে মীর মুরাদের নাম। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুন:নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১ তে পুনর্বার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পুর্রহোসেনী দালান ইমামবাড়ার সংস্কারসাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃদির পুকুর। এর উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান অবস্থিত। দালানটি সাদা বর্ণের, এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। ইরান সরকারের উদ্যাগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়।
এবার চলুন পুরাতন ঢাকার চকবাজারে, প্রথমেই খোঁজ করি ছোট কাটারার।
ছোট কাটারাঃ ছোট কাটারা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি একটি ইমারত। আনুমানিক ১৬৬৩ - ১৬৬৪ সালের দিকে এ ইমারতটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং তা ১৬৭১সালে শেষ হয়েছিল। এটির অবস্থান ছিল বড় কাটারার পূর্বদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড় কাটারার মত হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটারার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটারা। তবে ইংরেজ আমলে এতে বেশ কিছু সংযোজন করা হয়েছিল। শায়েস্তা খানের আমলে ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে মিশনারি লিওনারদ ছোট কাটরায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরাজি স্কুল। ১৮৫৭ সালে, এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুল। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা ছিল নবাব পরিবারের দখলে। এবং তাতে তখন ' কয়লা ও চুণার কারখানার কাজ' চলত। ছোট কাটরার সাথে বিবি চম্পার স্মৃতিসৌধ অবস্থিত ছিল। , এক গম্বুজ, চার কোণা, প্রতিপাশে ২৪ ফুট দীর্ঘ ছিল স্মৃতিসৌধটি। তায়েশ লিখেছেন, 'পাদ্রী শেফার্ড ওটা ধ্বংস করে দিয়েছেন।' শেফার্ড বোধহয় কবরটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। বিবি চম্পা কে ছিলেন তা সঠিক জানা যায় নি। তবে কারো মতে তিনি শায়েস্তা খাঁর মেয়ে। বর্তমানে ছোট কাটারা বলতে কিছুই বাকি নেই শুধু একটি ভাঙা ইমারত ছাড়া। যা শুধু বিশাল তোড়নের মতন সরু গোলির উপর দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অসংখ্য দোকান এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে মুঘল আমলের এমন একটি স্থাপত্য ছিল।
ছোট কাটারা’র হতে কয়েক কদম পরেই রয়েছে পাশের গলিতে বড় কাটারা।
বড় কাটরাঃ বড় কাটরা ঢাকায় অবস্থিত মুঘল আমলের নিদর্শন। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে (হিজরী ১০৫৫) বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। এর নির্মাণ করেন আবুল কাসেম যিনি মীর-ই-ইমারত নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এক সময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারনে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি ভগ্নাবশেষ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় বড় কাটরার তোরণে ফার্সি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। যেখানে এই মুসাফির খানার নির্মাতা ও এর রক্ষনাবেক্ষনের ব্যয় নির্বাহের উপায় সম্পর্কে জানা যায়। ফলকে লেখা ছিল: সুলতান শাহ্ সুজা সব সময় দান-খয়রাতে মশগুল থাকিতেন। তাই খোদার করুণালাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক এই দালানটি নির্মাণ করিলেন। ইহার সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হইল- যাহাতে এইগুলির আয়ে ইহার মেরামতকার্য চলিতে পারে এবং ইহাতে মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হইতে পারে। এই বিধি কখনো বাতিল করা যাইবে না। বাতিল করিলে অপ্রাধী শেষ বিচার দিনে শাস্তি লাভ করিবে। শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজি কর্তৃক এই ফলকটি লিখিত হইল।
মধ্যাহ্নভোজের ( ) বিরতিঃ এবার সোজা পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করে একটু ডানে বেঁকে যাই, চলে এলাম বিখ্যাত আরমানিটোলা। এতক্ষণে তো প্রায় দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার কথা, ক্ষুধা পেয়েছে, তাই না? এক কাজ করি চলুন বিখ্যাত নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও দিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরে নেই। খাওয়া শেষে চলুন এবার একটু হেঁটে সামনে এগোই, কয়েক কদম মাত্র, চলে এলাম বিখ্যাত তারা মসজিদ।
তারা মসজিদঃ তারা মসজিদ পুরানো ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার 'মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ'-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা গোলাম পীর এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে এটি তখন বেশ পরিচিতি পায়। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে, ১৯২৬ সালে, ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। সে সময় জাপানের রঙিন চিনি-টিকরি পদার্থ ব্যবহৃত হয় মসজিদটির মোজাইক কারুকাজে। মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে এ মসজিদে। ঢাকার কসাইটুলীর মসজিদেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরের সতের শতকে নির্মিত স্থাপত্যকর্মের ছাপ পড়ে মোঘল স্থাপত্য শৈলীতে। মির্জা গোলামের সময় মসজিদটি ছিল তিন গম্বুজঅলা, দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) আর প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার)। আলী জানের সংস্কারের সময়, ১৯২৬ সালে, মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বারান্দা বাড়ানো হয়। ১৯৮৭ সালে তিন গম্বুজ থেকে পাঁচ গম্বুজ করা হয়। পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়।
এবার আরেকটু পা চালিয়ে চলে এলাম আর্মেনিয়ান চার্চ দেখতে।
আর্মেনিয়ান চার্চঃ ১৭৯১ সালে নির্মিত এই চার্চটি মূলত তৎকালীন সময়ে ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়দের হাতে তৈরি। ঐতিহ্যবাহী এই চার্চটি ছিল এখানে বসবাসরত আর্মেনীয়দের উপাসনাগার। প্রথমে এই জায়গায় ছিল আর্মেনীয়দের কবরস্থান। পড়ে তার পাশেই নির্মিত হয় এই চার্চটি। লম্বায় সাতশ ফুট এই চার্চের দরজা চারটি, সাথে জানালা রয়েছে সাতটি। এর পাশেই নাকি ছিল একটি ঘড়িঘর যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যায়। অন্যান্য চার্চের মত এখানেও ছিল একটি বড় ঘণ্টি যা বাজালে বহুদূর থেকে শব্দ শোনা যেত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেই ঘণ্টি শেষবারের মত বেজেছিল ১৮৮০ সালের দিকে। বর্তমানে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যাওয়া অন্যতম একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এই আর্মেনিয়ান চার্চ।
উফ, এইসব দেখে নিশ্চয়ই আর ভালো লাগছে না। চেনা জানা, বিখ্যাত স্থানে না গেলে কি আর ঘোরাঘুরি জমে? সেই সকালে লালবাগ কেল্লা দেখার পর থেকে কি সব দেখছি, তাই না? আসুন এবার সেইরকম আরেকটি বিখ্যাত স্থানে যাই, অতি পরিচিত আহসান মঞ্জিল।
আহসান মঞ্জিলঃ আহসান মঞ্জিল পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ-র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৮৫৯-১৮৭২ সাল। ১৯০৬ সালে এখানে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিষ্ঠাতাকাল ১৮৭২। আহসান মঞ্জিল কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। এখন এটি একটি জাদুঘর।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জালালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রংমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র রংমহলটি এক ফরাসি বণিকের নিকট বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুটির হিসাবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল। এরপরে ১৮৩৫-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। নওয়াব আবদুল গণি ১৮৭২ সালে প্রাসাদটি নতুন করে নির্মাণ করান। নতুন ভবন নির্মাণের পরে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ১৮৯৭ সালে ১২ই জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তীকালে নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন। এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম খিলান আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দু’টি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলার দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে।
তো আজ এই পর্যন্ত থাক, সূর্য প্রায় ডুবে ডুবে অবস্থা। এখান থেকে সদরঘাট বা ওয়াইজঘাট এলাকা খুব কাছেই, সেখানে গিয়ে নৌকা নিয়ে শেষ বিকেলের বুড়িগঙ্গায় একটু ঘুরে ঘুরে দেখেতে পারেন, সাথে বুড়িগঙ্গার প্রবীণ কোলে লাল সূর্যের হারিয়ে যাওয়া। আগামী পর্বে আবার বেড়িয়ে পড়া যাবে এই ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং এর উদ্দেশ্যে, শুরু করব নিমতলী গেট দিয়ে। এইফাঁকে খোঁজ করুন, নিমতলী গেট কি, কোথায়, কেন বিখ্যাত? ততক্ষণের জন্য বিদায় হে বন্ধু।