127 Hours 2010 (মুভি রিভিউ) সাধারণ এক ফাটল যখন মৃত্যুর ফাঁদ

আপনার ছুটির দিনটি নিজের মত করে কাটাতে বের হয়ে যদি আপনি আটকে যান এমন কোন ফাঁদে যেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই, নেই কোন সাহায্যের এতটুকু সম্ভাবনা; মৃত্যু ছাড়া আর কোন আশাই নেই; সেই অবস্থায় নিজেকে চিন্তা করতেই শিউরে উঠে দেহমন। আর এরকম সত্য ঘটনা অবলম্বনেই নির্মিত ছবি 127 Hours। শখের ভ্রমণ অনেক সময়ই হয়ে ওঠে মৃত্যু ফাঁদ; আমাদের দেশে ইদানীং প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটছে; পাহাড়ে, সমুদ্রে পর্যটক এর মৃত্যু প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। ঘটনাগুলোর ময়নাতদন্ত করে অনেকে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষন দিয়ে থাকেন, দেন নানান পরামর্শ। আসলে ভ্রমণে বিপদ হুট করেই আসে; বলে কয়ে আসে না। তাই তো মানুষের ভ্রমণ থেমে থাকে না। 

দেশে বিদেশে, যুগে যুগে মানুষ সময় সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়েছে ভ্রমণে, সাহসীরা ভ্রমণের সাথে এডভেঞ্চার এক্টিভিটিস এ। আমাদের দেশেও হাজারো মানুষ যে কোন ছুটির অবসরেই বেড়িয়ে পরেন ঘর হতে ভ্রমণের নেশায়। কেউ দল বেঁধে, কেউবা একাকী। কেউ আরাম আয়েশে কোন পছন্দের ডেস্টিনেশনে কাটিয়ে আসেন অবসর সময়টুকু; কেউ আবার অদম্য রোমাঞ্চের নেশায় বুঁদ হয়ে বের হয়ে পড়েন হাইকিং, ক্লাইম্বিং বা মাউন্টেনিয়ারিং এর জন্য। যার যার নিজের পছন্দে মানুষ মাত্রই চায় অবসর সময়টুকু কাটিয়ে দিতে। 

সদা হাস্যজ্জল তরুন মাউন্টেইনিয়ার, ট্রাভেলার জন এরন র‍্যালস্টোন নিয়মিতই ছুটিতে বেড়িয়ে পড়েন নানান জায়গায় ভ্রমণে। এরকমই এক ভ্রমণ ছিলো দক্ষিণ-পূর্ব উতাহ এর জনমানবহীন গিরিসংকট জন ক্যানিয়নে; সময়টা ২০০৩ সালের এপ্রিল মাস। নিজের মত করে বেড়াতে থাকেন জন; চলার পথে দুই তরুনীর সাথে দেখা হয়; তাদের গাইড করেন গন্তব্যে যেতে। আনন্দদায়ক কিছুটা সময় পার করে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে সামনে এগিয়ে যান নিজ গন্তব্যে। সবকিছুই চলছিল আর দশটা আগের ভ্রমণগুলোর মতোই। হাতে ছিল তার সবসময়ের সাথী ভিডিও ক্যামেরা। 

হুট করেই চলতি পথে অসতর্কতায় পা পিছলে যায় আর তাতেই বাঁধে যত বিপত্তি। সেই ক্যানিয়নের এক ফাটলের ভেতর পড়ে গিয়ে একটা হাত খুব ভয়ঙ্করভাবে আটকে যায় বড়সড় এক পাথরের নীচে। সাথে থাকা খাবার-পানীয়'র রসদ ছিলো অল্প; ছিলো না এমন কোন গিয়ার যা দিয়ে নিজেকে নিজে উদ্ধার করতে পারেন। আর এমন জায়গায় আটকে যান যেখানে কোন মানুষের পৌঁছানোর সম্ভাবনা শুণ্যের কোঠায়। আর এখান থেকেই সিনেমার গল্প শুরু। ধীরে ধীরে শেষ হতে থাকে খাবার, শেষ হয় পানীয়। নানান চেষ্টা করেও হাতটাকে মুক্ত করতে ব্যর্থ জন একসময় হেলুসিনেশনে ভুগতে থাকেন। তার আগের জীবনের নানান ঘটনা তার চোখে ভেসে আসে; কখনো আবার দেখেন নিজেকে মুক্ত হিসেবে।

এভাবে কাটে মিনিট, ঘন্টা শেষে দিন; এক দিন, দুই দিন, এমন করে পাঁচদিনের বেশী আটকে থাকেন সেই ফাঁদে। আর অপেক্ষা করতে থাকেন মৃত্যুর। ভিডিও ক্যামেরায় বাবা মা সহ আপনজনদের উদ্দেশ্যে শেষ কথোপকথন রেকর্ড করে যান এবং ভিডিওর শুরুতেই জন তার বিশদ পরিচয় এবং ঠিকানা দিয়ে অনুরোধ করে যদি তার মৃত্যুর পর কেউ এই ক্যামেরাটি উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে সোপর্দ করে এই আশায়। 

সুদীর্ঘ ১২৭ ঘন্টা এই ফাঁদে আটক অবস্থায় জন উপলব্ধি করে নিজের জীবনের নানান ভুলভ্রান্তি; উপলব্ধি করে জীবনের চরম সত্য। এক সময় সে উপলব্ধি করে এই ক্যানিয়নের ফাটলটি তার জন্মের পর থেকেই তার জন্য অপেক্ষায় ছিল। সে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলো এই ফাঁদে এসে আটকে পড়ে মারা যাবে বলেই। একটা প্রচলিত কথা আছে; যার মৃত্যু যেখানে আছে, তাকে সেখানে যেতেই হবে এবং সেখানেই তার মৃত্যু হবে। এই চরম সত্য কথাটি মেনে নিয়ে কি জন হাল ছেড়ে দিয়েছিলো? নাকি শেষ শক্তিটুকু থাকা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলো নিজেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সে কি নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলো? সেই ফাঁদ থেকে অক্ষত অবস্থায় জন উদ্ধার হয়েছিলো নাকি তার মৃতদেহ উদ্ধার করে বাবা-মা'র নিকট পৌঁছেছিলো জানতে হলে আপনাকে মুভিটি দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত। 

২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেয়াম 127 Hours মূলত Aron Ralston এর আত্মজীবনী Between a Rock and a Hard Place অবলম্বনে নির্মিত। সিনেমাটি পরিচালনা, সহ-রচনা এবং প্রযোজনা করেন ড্যানি বয়েল। ব্রিটিশ এবং মার্কিন যৌথ প্রযোজনার এই সিনেমাটির প্রযোজনায় ছিলো এভারেস্ট এন্টারটেইনমেন্ট, ফিল্ম৪ প্রডাকশন্স, হ্যান্ডমেইড ফিল্মস এবং ক্লাউড এইট ফিল্মস।

সিনেমাটি তিনটি গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়, যার মধ্যে ছিল সেরা নাট্য চলচ্চিত্র অভিনেতা, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক সুর। ও হ্যাঁ, এর মৌলিক সুর দিয়েছিলেন উপমহাদেশ এর সেরা সুরকার এ আর রহমান। চিত্রনাট্য রচনা করেন বিউফয় এবং তাকে এই কাজে সহায়তা করেন বয়েল  ড্যানি বয়েল, কলসন, এবং রহমান এর আগেও একত্রে কাজ করেছেন বয়েলের ২০০৮ সালের স্লামডগ মিলিয়নিয়ার চলচ্চিত্রে। 

127 Hours এছাড়াও নয়টি ব্রিটিশ একাডেমি চলচ্চিত্র পুরস্কারে মনোনীত হয়, যার মধ্যে ছিল অসাধারণ ব্রিটিশ চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালনা, সেরা প্রধান চরিত্রে অভিনেতা, সেরা উপযোগকৃত চিত্রনাট্য, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা সম্পাদনা, এবং সেরা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত। এর বাইরে চলচ্চিত্রটি ৮৩তম একাডেমি পুরস্কারে ছয়টি মনোনয়ন পায়, যার মধ্যে ছিল সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা উপযোগকৃত চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক সুর, সেরা মৌলিক গান, এবং সেরা চলচ্চিত্র সম্পাদনা। এটি আটটি ব্রডকাস্ট চলচ্চিত্র সমালোচক সংঘের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়; যার মধ্যে ছিল সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, সেরা উপযোগকৃত চিত্রনাট্য, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা সম্পাদনা, সেরা গান, এবং সেরা শব্দগ্রহণ।[৩৭] চলচ্চিত্রের মূল গান "ইফ আই রাইজ" সেরা গান বিভাগে ক্রিটিকস চয়েস চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। জেমস ফ্র্যাঙ্কো সেরা অভিনেতা বিভাগে নিউ ইয়র্ক চলচ্চিত্র সমালোচক অনলাইন এবং ডালাস-ফোর্ট ওউর্থ চলচ্চিত্র সমালোচক সমিতির পুরস্কার লাভ করেন।

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ