ঢাকা সাইকিং ক্লাব এবং একজন আজহারুল ইসলাম মাসুম


মার্কেটিং বর্তমানে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়েছে। ব্যাবসায়িক ব্যাবহারের গণ্ডি পেড়িয়ে আজ তা একান্ত ব্যাক্তিগত জীবনের চৌহদ্দিতে পৌঁছেছে। আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাক্তিগত জীবনলিপি শেয়ার করে অনেকে সেলিব্রেটি পর্যায়ে পৌঁছেছেন। কিন্তু সমাজে এমনও অনেক ব্যাক্তি আছেন যারা কাজ করে যান নীরবে, নিভৃতে। এমন একজন মানুষ ছিলেন আমাদের প্রিয় আজহারুল ইসলাম মাসুম। বাংলাদেশের প্রথম সাইক্লিং ক্লাব “ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব” এর প্রতিষ্ঠাতা শুধু নয়, তিনি ছিলেন এদেশে সাইক্লিংকে জনপ্রিয় করার বীজ বপনকারী স্বপ্নদ্রষ্টা। সারাজীবন আড়ালে থেকে হারিয়ে গেলেন এই সাইকেল অন্তপ্রাণ মানুষটি। আমি সাইক্লিং নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের সবার কাছে বিনীত অনুরোধ রাখছি, অকাল প্রয়াত এই মানুষটির অবদান আজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে। 


মিলেনিয়াম ২০০০ এর ডামাডোলের সময় "ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" হতে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। সেখান থেকেই এই সদা প্রচার বিমুখ আজহারুল ইসলাম মাসুম এবং তার "ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" সম্পর্কে কিছু লেখা তুলে রাখতে চাই আজকের যুগের অনলাইন প্লাটফর্মে। 

"ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" 

যৌবনের ধর্মই নতুন কিছুর সন্ধান, নতুন কিছু  সৃষ্টি। যৌবন মানেই নতুনের পাণে ছুটে চলা। নতুন দিগন্ত রেখায় নতুন সূর্যোদয়ের অপর নামই যৌবন। আর এই যৌবনের ধর্ম অনুসারেই সৃষ্টি "ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" এর। একঝাঁক তরুণ এক ছায়াতলে মিলিত হয়ে গড়ে তোলে "ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" যার মূলে ছিলেন পুরাতন ঢাকার কৃতি সন্তান আজহারুল ইসলাম মাসুম। এই কর্মঠ ও সাংগঠনিক মানুষটি অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দৃঢ় ধৈর্য্য ও প্রত্যয়ের সাথে ক্লাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত হাল ধরে ছিলেন ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব এর। ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব এর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক চড়াই উৎরাই, অনেক বন্ধুর পথ। 

আশির দশকের তরুণ বয়স থেকেই আজহারুল ইসলাম মাসুম এবং তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব সাইকেল ও সাইক্লিং এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ধীরে ধীরে সাইক্লিং হয়ে ওঠে তাদের প্রাণ স্পন্দন। সাইক্লিং পিপাসার পথ ধরেই তারা সাইক্লিং এ মনোনিবেশ করেন এবং জাতীয় পর্যায়ে সফল সাইক্লিষ্ট হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর থেকেই তারা তাগিদ অনুভব করেন এমন একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার যা তাদের সুপ্ত সাইক্লিং পিপাসা পরিপূর্ণভাবে নিবারন করতে সক্ষম হবে। আর এই তাগিদ থেকেই ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে "ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব" যা দেশের সবচাইতে পুরাতন সাইক্লিং ক্লাব নিঃসন্দেহে। 

তারপর থেকে বিগত ত্রিশ বছরে ঢাকা সাইক্লিং ক্লাব বিভিন্ন সময়ে সফলভাবে আয়োজন করেছে সাইক্লিং প্রতিযোগিতা, সাইকেল র‍্যালী, রোড রান এবং সাইক্লিং, মিনি ম্যারাথন সহ আরও নানান ক্রীড়া ইভেন্টের। যৌবনকে যেমন কোন গন্ডিতেই বাঁধা যায় না, তেমনি এই যুবকদের কর্মকান্ডও শুধু ক্রীড়া ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা যায় নাই। বিভিন্ন সময়ে নানান সামাজিক সমস্যায় এগিয়ে এসেছে এই ক্লাবটি। দেশের প্রাকৃতিক দূর্যোগে এগিয়ে এসেছে সমাজসেবায়, আয়োজন করেছে মাদক প্রতিরোধ বিষয়ক র‍্যালী, সাইক্লিং ট্যুর, এগিয়ে এসেছে পরিবেশ দুষণ এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশে ও বিদেশে সাইকেল ট্যুর এর মাধ্যমে। জাতীয় নানা উৎসব এবং বিভিন্ন পালা পার্বনে নানান কর্মসূচী পালন করেছে এই ক্লাবটি। 

একজন আজহারুল ইসলাম মাসুম - কুয়াশায় ঢাকা এক উজ্জল নক্ষত্র

প্রচার বিমুখ মানুষ আজহারুল ইসলাম মাসুম এর নাম এই প্রজন্মে যারা সাইক্লিং নিয়ে কাজ করে কয়জনা শুনেছে সন্দেহ আছে। তবে নব্বই দশকে এবং এর পরবর্তী সময়েও এই উদ্দমী ক্রীড়া সংগঠক, প্রাক্তন জাতীয় সাইক্লিষ্ট এবং আন্তর্জাতিক ট্যুরিষ্টের পরিচিত ছড়িয়ে পড়ে দেশের গন্ডী পেড়িয়ে বিদেশেও। 

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সাইক্লিংয়ে হাতেখড়ি হয় মেজো ভাই মজনু'র সহযোগিতায়। ধীরে ধীরে সাইকেলের সাথে তার গড়ে ওঠে সখ্যতা, হৃদয়ের সম্পর্ক, গড়ে ওঠে নিখাদ ভালবাসা। নিজগন্ডীতে নানা বাঁধা ও সীমাবদ্ধতার কারনে সেই শৈশবে তিনি সাইকেল থেকে একটু দূরে সরে যান এবং মেতে ওঠেন ফুটবল ও টেনিসে। কিছুদিন এই দুটোতে ব্যস্ত থাকার সময় তার সাথে পরিচয় হয় তৎকালীন বিখ্যাত সাইক্লিষ্ট জনাব, আব্দুল কুদ্দুস বাবুল-এর সাথে। প্রতিবেশী এই ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখেই সাইক্লিংকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণ আজহারুল ইসলাম মাসুম। পারিবারিক শত বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি সাইক্লিংকে ত্যাগ করতে পারেননি। তার পরিবারের কেউ তখন চায় নাই তিনি সাইক্লিষ্ট হন। কিন্তু প্রতিবেশী বড় ভাই আব্দুল কুদ্দুস বাবুল এর সহযোগীতায় এবং পারিবারিক শত বাঁধা উপেক্ষা করে তিনি ১৯৮৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র সাইক্লিং প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে সাফল্য লাভ করেন। তারপর তিনি পরপর তিনবার জুনিয়র সাইক্লিংয়ে শ্রেষ্ঠ সাইক্লিষ্ট হিসেবে জয়ী হন আর তার সাথে সাথেই শুরু হয় তার সাইক্লিষ্ট জীবন। 

আজহারুল ইসলাম মাসুম এর শ্রদ্ধেয় বড়বোন মিনা আহমেদ মাসুম এর সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। যদিও সেই কৈশোর বয়সে তিনি তাকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সাইক্লিং থেকে দূরে রেখে লেখাপড়ায় মনযোগী করতে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি মাসুমকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করেছেন তার সাইক্লিং জীবনে, যুগিয়েছেন উৎসাহ। পরিবারের আর এক সদস্য, যার কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন এই মিনা আহমেদের ছোট মেয়ে রিটা। যে সবসময় তার মামা আজহারুল ইসলাম মাসুমকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে গেছে সবসময়। 

সাইক্লিষ্ট আজহারুল ইসলাম মাসুম তার সাইক্লিং ক্যারিয়ারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলে খেলেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ বিজেএমসি, দিনাজপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থা, বাংলাদেশ আনসার প্রভৃতি। তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন সংগঠন থেকে বিভিন্ন লোভনীয় অফার থাকা সত্ত্বেও মাসুম প্রফেশনাল সাইক্লিষ্ট হিসেবে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ আনসার এর হয়ে খেলে গেছেন। 

আজহারুল ইসলাম মাসুম এর টুরিস্ট জীবন শুরু হয় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা সাইক্লিং এর মাধ্যমে ভ্রমণ করে। নিজ দেশের মাতৃরূপ প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়েই তিনি তৈরী করেন নিজের টুরিস্ট মনকে। দেশের ৬৪টি জেলা ভ্রমণ শেষে তিনি তৈরী হন বিশ্ব ভ্রমণের জন্য। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন নেপাল, ভারত, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, হংকং, ম্যাকাও, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, মালয়শিয়া সহ আরও অনেকগুলো দেশ যার প্রায় প্রতিটিতেই তার সঙ্গী ছিল দুই চাকার সাইকেল। 

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অতি অল্প বয়সে প্রয়াত হন এই কুয়াশায় ঢাকা উজ্জল নক্ষত্র, সদা নিভৃতচারী ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ মানুষটি। আল্লাহ তার বিদেহী আত্মাকে পরপারে শান্তিতে রাখুন। 

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ