সুন্দরবন সাফারী - Sundarban ভ্রমণ ২০১৩ (যাত্রা শুরুর গল্প)

সুন্দরবন সাফারী - Sundarban ভ্রমণ ২০১৩ (যাত্রা শুরুর গল্প)

তিন দিন আগে থেকেই কাউণ্টডাউন শুরু করে দিয়েছিলাম, যাচ্ছি সুন্দরবন। “ভ্রমণ বাংলাদেশ” নামক অ্যাডভেঞ্চার-ট্র্যাভেল বেইসড দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংগঠনের আয়োজনে; Sundor Sundorban Safary – 2013 (Season-2) নামক প্লেজার ট্রিপে। ফেসবুকে প্রতিদিন দুইবার করে কাউন্টডাউন, আর এত ঘন্টা বাকী, ইয়াহু… মার্কা স্ট্যাটাস। আসলে ২০০৪ সালের পর আক্ষরিক অর্থে কোনখানে ব্যক্তিগতভাবে বেড়াতে যাচ্ছি। ২০০৪-২০১২, দীর্ঘ আট নয় বছর কোথাও বেড়াতে যাই নাই। ঢাকার বাইরেও না। ও হ্যাঁ, একবার ঢাকার বাইরে ধামরাই গেলাম ছোট মামার বিয়েতে আর ২০১০ এ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন নিয়ে কক্সবাজার, সেখানে ছিলাম আয়োজক হিসেবে। সেই গল্প আরেকদিন হবে। মূলত ছাত্রাবস্থায় যেমন নিজের জন্য বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বেড়াতে যেতাম প্রতিবছর, সেরকম আর যাওয়া হয় না। আগে দুই ঈদে প্ল্যান থাকতো ঈদের পর বেড়াতে যাবো, বেশীরভাগ সময় সেই ট্যুর প্ল্যান হতো কক্সবাজার অথবা সিলেট কেন্দ্রিক। যাই হোক, অপ্রাসঙ্গিক গল্প বাদ, আসি মূল গল্পে।

প্রতীক্ষার পালা শেষ করে অবশেষে এলো বৃহস্পতিবার, এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন; রাত সাতটায় ট্রেন। চাকুরীজীবি মানুষ, বাসা পুরাতন ঢাকার লালবাগ আর অফিস গুলশান, ট্রেন ধরতে হবে কমলাপুর থেকে। তাই দুপুরের পরে রিপোর্টিং বসকে বলে বিকাল চারটায় বেরিয়ে গেলাম অফিস থেকে। গুলশান থেকে গন্তব্য নিউমার্কেট-আজিমপুর হয়ে লালবাগ; বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগপত্তর নিয়ে ছুটতে হবে কমলাপুর। যদিও বাল্যবন্ধু রবিউল হাসাক খান মনা, যাদের সংগঠন হচ্ছে ভ্রমণ বাংলাদেশ, উনি হলেন তার সাধারণ সম্পাদক সাহেব; বলেছিলেন বাসা হতে অফিস যাওয়ার পথে আগের রাতে তার বাসায় ব্যাগপত্তর দিয়ে আসতে। কিন্তু আগেরদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটার উপরে বেজে গিয়েছিলো আর শরীরও ছিলো ক্লান্ত। তাই ভেবেছিলাম আজ বাসায় ফিরে গোসল করে সতেজ হয়ে রওনা হয়ে যাবো কমলাপুর।

ভেবেছিলাম তিন ঘণ্টা যথেষ্ট সময় গুলশান হতে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে তৈরী হয়ে ব্যাগ নিয়ে কমলাপুর যেতে। কিন্তু বিধিবাম, অফিস থেকে বের হয়ে গুলশান এক নম্বর গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকটা সময়, আজিমপুরগামী গাড়ির দেখা নেই।  গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে চারটা ক্রস করলো। ভাগ্য খুব বেশী ভালো হলে যা হয়, তাই হল; আজিমপুর পৌঁছলাম ছয়টার পরে, আমাদের মহান ট্রাফিক ব্যাবস্থা এবং তার কল্যাণে সৃষ্ট নানান সিগ্ন্যালে আটকে থেকে আর তার সাথে ছিলো ট্রাফিক জ্যাম। কোথায় ভেবেছিলাম বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রওনা হব, কোথায় কি? পড়িমরি করে ছুটলাম ব্যাগ নিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে, ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টার উপরে। বাসা হতে বের হয়ে একটা রিকশাযোগে চলে এলাম সিএনজি স্ট্যান্ড, কিন্তু সিএনজি চালক ভাইয়েরা কমলাপুর যেতে রাজি হলেন না। 

অবশেষে পেলাম এক রিকশাওয়ালা ভাইকে, রিকশাতো নয়-যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়া চালাল। পথে পল্টন মোড়ের আগে প্রেসক্লাব এর কাছে একটু জ্যামে পড়লাম; মনা ভাইকে ফোন দিয়ে জানালে বললো হেঁটে চলে আসতে কমলাপুর! মনে মনে ভাবলাম, “এ, পাগলায় কয় কি?”; আমার লাগেজটা ছিলো একটু বড়, ফলে সেটা নিয়ে পল্টন থেকে কমলাপুর হেঁটে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তারপরেও আরামবাগ এর চৌরাস্তা থেকে রিকশা ছেড়ে দিতে হলো লম্বা গাড়ির সারি দেখে, অনেকটা দৌড়াতে দৌড়াতে সাতটার মধ্যে কমলাপুর পৌঁছলাম। ধরতে পারলাম ট্রেন, আমি ট্রেন মিস করিনি। কিন্তু স্টেশনে পৌঁছে মনা ভাইয়ের ভেটকি মারা হাসির সাথে জানতে পারলাম ট্রেন লেট এবং এটা তিনি আগেই জানতেন, যখন আমি ফোন দিয়েছিলাম। মনে চাচ্ছিলো এক কামড় দিয়ে ধর থেকে কল্লাটা আলাদা করে দেই। 😜 মনে মনে গালি দিলাম, “শালা মনা পাগলা”। বাল্যবন্ধুকে গালি দেয়াই যায়, তাই না? 😉

কমলাপুর থেকে খুলনাগামীচিত্রা এক্সপ্রেসআসলো সাড়ে সাতটার পর। একে একে প্রায় চল্লিশ জনের দল ট্রেনে উঠে পড়লাম, পুরো একটা বগী যেন আমাদের দখলে চলে এলো। রাত পৌনে আঁটটায় ট্রেন ছাড়ল কমলাপুর ষ্টেশন হতে, পুরো দল কমলাপুর হতে ট্রেন ধরে নাই, পথে বিমান বন্দর ষ্টেশন এবং গাজীপুর ষ্টেশন থেকে আরো কিছু ভ্রমণসঙ্গী উঠলো, মোট ৪৬ জন আমরা। পরে আরো কয়েকজন খুলনা থেকে যোগ দেয়ায় ৫০ ছাড়িয়েছিল আমাদের ভ্রমণ দলের সদস্য সংখ্যা। এটা ছিলো আমার ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সাথে প্রথম ট্যুর। যদিও মনা এবং তার দলের দু’এক জনকে আগে থেকে চিনতাম। তারপরও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিলো এই ট্রিপে যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলো পরে আমার অতি প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী।

ট্রেন ছাড়তে একটা ঝামেলা দেখা দিলো, এক বড় ভাই, দুইজনের নাম রেজিস্ট্রেশন করেছেন, স্বামী-স্ত্রী; কিন্তু সাথে দুইটা বাচ্চা, ভালই বড় এবং বড় ছেলেটার কিছু শারীরিক সমস্যার কারনে তাদের মোট চারটি সিট ছেড়ে দিতে হলো। ফলে সারা রাত পুরোটা পথে মনা, রনী, বেলাল, আমি, মাহিদ জনি সহ কয়েকজন পালাক্রমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জার্নি করেছিলাম। এই ট্যুরে ট্রেনে পরিচয় হল নুপুর আপু এবং মহী ভাইয়ের সাথে। অসম্ভব মিশুক এবং উৎফুল্ল দম্পতি। তাদের সাথেই ট্যুর এর পুরোটা সময় কেটেছে আমার। ট্রেন গাজীপুরের কাছাকাছি পার হয়ে গেলে রাতের ডিনার সার্ভ করা হলো; কিন্তু ডিনার কি? নান-রুটি গরুর মাংস দিয়ে, চলন্ত ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কোন পাত্র ছাড়া এই মেন্যু খাওয়াটা ছিল খুব থ্রিলিং। যদিও মনে মনে দোস্তকে আরেকবার গালি দিলাম, তার বুদ্ধির ছিরি দেখে। খাওয়া দাওয়ার পর ছোট ছোট গ্রুপে গল্প আর আড্ডা দিলো অনেকে, কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু জেগে থাকা বাকীদের হট্টগোল তাদের সেই চেষ্টার বারোটা বাজাতে যথেষ্ট ছিলো।

পরদিন শুক্রবার ভোর ছয়টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম খুলনা। রেলস্টেশনের পাশেই বিআইডব্লিউটিএ লঞ্চ টার্মিনাল, তার কিছুটা আগে নোঙ্গর করা ছিল একটা ছোটখাটো দ্বিতল লঞ্চ; আসলে নীচের ইঞ্চিন সেকশন আর রান্নার ডেক এলাকাটা গণনায় নিলে একে ত্রিতল বলা যায়। আমরা সরাসরি ট্রেন থেকে নেমে ভ্রমণ বাংলাদেশ এর গাইডে সবাই মিলে উঠে পড়লাম আগামী তিনদিনের নিবাস “রিয়ামনি” নামক লঞ্চটিতে। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। 

গল্পের ছবিসকল


ভ্রমণকালঃ ২৩ ও ২৪ জানুয়ারী, ২০১৩



মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ