শুক্রবার সকালে খুলনায় ট্রেন হতে নেমে আমাদের তিন দিনের আবাস “রিয়া মনি” নামক মোটর ভেহিকেল এ চেকইন করার পর আমরা ফ্রেশ হয়ে নিলে সকালের নাস্তা পরিবেশন করা হল। পুরো ট্যুরে ছিলেন ‘এবাদুর/এমাদুর’ নামের এক বাবুর্চি ভাই এবং তার দল। দারুন সব সুস্বাদু এবং মজাদার খাবার পরিবেশন করে তিনদিন আমাদের উদরপূর্তির পাশাপাশি রসনাবিলাসে বুঁদ করে রেখেছিলেন। তো প্রথম দিন সকালের নাস্তায় ছিলঃ খিচুড়ি, ডিম ভাঁজা, বেগুন ভাঁজা, আচার! আহা, এর চাইতে ভালো আর কি হতে পারে। নাস্তা শেষে সবাইকে লঞ্চের ছাঁদে একত্রিত করা হলে পরে ট্যুরের লিডার, ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সভাপতি টুটুল ভাই সবার সাথে পরিচিতি পর্ব সেরে নিয়ে তিনদিনের ট্যুরের প্ল্যান আরেকবার ব্রিফ করে দিলেন। এরপর সবাইকে যার যার রুম বুঝিয়ে দেয়া হলো এবং এরই মাঝে খেয়াল করলাম আমাদের লঞ্চ রিয়ামনি চলতে আরম্ভ করেছে রূপসা নদীর জল ভেদ করে।
পরিচয় পর্ব এবং নাস্তা শেষে চা পাণ করতে করতে কিছুটা সময় গেল, এরপর চলে এলাম নিজের কেবিন এ। গতকাল সকাল থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, সেখান থেকে কমলাপুর, ট্রেনে সারারাত নির্ঘুম ট্রেন জার্নি (সিটের সমস্যার কাহিনী আগের পর্বেবলেছিলামঃ সুন্দরবন সাফারী ভ্রমণ ২০১৩ (যাত্রা শুরুর গল্প) ) শেষে আজ এই সময়ে দু’চোখ ভরে ঘুমেরা জড়ো হচ্ছিলো। কেবিনে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে শুয়ে পড়লাম এবং কখন গভীর ঘুমে ডুবে গেছি নিজেও জানি না। হঠাৎ ‘উ লা লা... উ লা লা’ শব্দে হালের ক্রেজ হিন্দি চটুল গান শুনতে পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
অন্ধকার কেবিনে বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি, বাসায় আছি বলে ভ্রম হলো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আমি তো সুন্দরবন বেড়াতে এসেছি। কেবিনের জানালায় দেয়া ভারী পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দেখতে পেলাম আমরা চলে এসেছি আমাদের প্রথম ডেসটিনেশন “করমজল” টুরিস্ট স্পট। দুপুর তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম করমজলে। করমজল স্পটের ঘাটে “রিয়ামনি” ভিড়েছে আর পার্শ্ববর্তী অপর একটি ষ্টীমার থেকে ‘উ লা লা... উ লা লা’ বাজনা ভেসে আসছে। ‘উ লা লা’র দৌড়াত্ম বুঝতে পারলাম এই সুন্দরবনেও পৌঁছে গেছে। বনের প্রাণীরাও হয়ত এই গানের তালে তালে এখন নাচের আসর বসায়! এখানটা মোটামুটি পিকনিক স্পটের মত। আরো কয়েকটি ষ্টীমার-লঞ্চ দেখলাম ঘাটে ভেড়াতে। হায়রে সুন্দরবন ভ্রমণ, এই শব্দে বনের পশুপাখী তো দূরের কথা, মানুষই পালাবে। অথচ, সুন্দরবন ট্যুরের গাইড লাইনে আমাদের বলে দেয়া হয়েছিলো কোন উজ্জ্বল রঙের জামাকাপড় আনা যাবে না। লঞ্চ হতে কোন স্পটে নামার সময় কোন পারফিউম ব্যবহার করা যাবে না। এখন মনে হচ্ছে সবই বৃথা, এরকম শব্দ আর লঞ্চের ইঞ্চিন এবং জেনারেটর এর শব্দে পশুপাখী লঞ্চ হতে দৃষ্টিগোচর হয় এমন ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না।
রূপসা নদী শেষে পশুর নদী শুরু হলে সেখান হতে কিছুদূর সামনে ঢাংমারী খাল এর পরেই “করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র”। খুলনা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার আর মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের অন্তর্গত চাঁদপাই রেঞ্জে এর অবস্থান। ঢাংমারী খাল এর পাশে রয়েছে আরেকটি অভয়াশ্রম, নাম “ঢাংমারী ডলফিন অভয়াশ্রম”। করমজল’কে বলা হয়ে খুলনা-মংলা অংশে দিয়ে সুন্দরবন এ প্রবেশের দরজা। অন্য আরেকটি দরজা হল সাতক্ষীরা দিয়ে। ১৯৮৮ সালে করমজল টহলফাঁড়ি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৯৫ সালে এখানে বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। ২০০২ সালে Sundarban Management Support (SMS) প্রকল্পের আওতায় এ কেন্দ্রের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। কুমির প্রজনন শুরু হয় ২০০৫ এ। এখানকার মূল আকর্ষণ লোনাপানির কুমির এর কৃত্রিম প্রজনন। ক্রমে হ্রাস পেতে থাকা এই প্রজাতির কুমিরের বংশ রক্ষায় এই প্রজনন কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এখানে কুমিরা ছাড়া চিত্রা হরিণ এর একটি খামারও রয়েছে। পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য এখানে “মাঙ্কি ট্রেইল” নামে প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা একটা কাঠের তৈরী ব্রিজ ওয়াকওয়ে রয়েছে। এ ছাড়াও আছে ২টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, ডলফিন যাদুঘর, ৬টি গোলাকার বিশ্রামঘর, বাঘের কঙ্কাল, কংক্রিটের তৈরি সুন্দরবনের মানচিত্র, একটি বিশ্রামাগার, ঘাটবাঁধানো বৃহদাকার একটি পুকুরসহ মোট তিনটি পুকুর।
করমজল ভ্রমণ এর আগে ছিলো দুপুরের খাবার পর্ব। সেখানে সুস্বাদু সব খাবার, ইয়া বিশাল মাছের পেটি, পাতে দুই পিস দিতে হেই হেই করে উঠলাম। টুটুল ভাইকে অনেক কষ্টে বুঝালাম, একটা খেয়ে শেষ করি; প্রয়োজন হলে আবার নেয়া যাবে। টুটুল ভাই রান্নাবান্নার আয়োজন করতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করেন বলে মনে হল। খাবার পর্ব শেষে লঞ্চের উপরে গিয়ে দেখি লঞ্চের ছাঁদের চারিধার দিয়ে সাজানো চেয়ারে অনেকেই বসে আছে, আমি সদ্য পরিচয় হওয়া নুপুর-মহী দম্পতির সাথে গিয়ে বসলাম, কিছুক্ষণ পর মনা’ও এসে যোগ দিল। বিকেল বেলার ফুরফুরে শীতল হাওয়া দারুন লাগছিল। পশুর নদীর বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলযান “রিয়ামনি”, দুপাশে তীরে গোলপাতার সারি, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ। সব মিলিয়ে ভালো লাগছিলো, ইতোমধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে এসেছিলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য কটকা, সেখানেই রাতে নোঙ্গর করবে আমাদের তরী, সকালবেলা কটকা এবং জামতলা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ হবে।
সন্ধ্যের পরপর আমার কেবিনে গিয়ে গান শুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর কেবিন এর দরজায় নক, খুলে দেখি প্রায় সমবয়সী চারপাঁচ জনা ছেলেপুলের দল। “ও ভাই কি গান শুনেন, অন্য কোন গান বাজান”। আমি শুনছিলাম প্রিয় আইয়ুব বাচ্চুর গান, লো ভলিউমেই। যাই হোক, তাদের কথায় গান পাল্টালাম। আমি যে গান ছাড়ি, কিছুক্ষণ পর আবার নক এর শব্দ। আসলে আমার কেবিন একেবারে লঞ্চের সম্মুখে হওয়ায়, আমার কেবিনের জানালার পাশেই, লঞ্চের একেবারে সামনের দিকে ছিল সাত আটটা চেয়ার, ভ্রমণকারীদের বসার জন্য। সবাই সেখানে বসে ছিলো। এরপর ব্যান্ড, আধুনিক, নজরুল, রবীন্দ্র যেটাই ছাড়ি তাদের উৎপাত। অবশেষে যখন বুঝলাম সব কয়টা ফাজিলের দল, আমি মনা’র বন্ধু জানতে পেরে আমার সাথে ফাইজলামি করছে; আমি গান বন্ধ রেখে কেবিন হতে বের হলাম। পরবর্তীতে এই ফাজিলগুলোর কয়েকটার সাথে অনেক ট্যুর দেয়া হয়েছে, অনেক মজার স্মৃতি রয়েছে।
সন্ধ্যের চা নাস্তা এবং এরপর এখানে সেখানে আড্ডাবাজি শেষে রাতের খাবারের পালা। রাতের খাবার শেষে চলল মনা এবং টুটুল ভাই এর কেবিনে আড্ডার আসর। প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত চললো সেই আসর। এর মাঝে হঠাৎ অন্য পাশের কেবিন হতে নাক ডাকার শব্দকে মোটর এর কোন মেকানিক্যাল ত্রুটি ভেবে দৌড়ে নীচে গিয়ে মোটর আর জেনারেটর চেক করে আসা হলো। পরে আবিস্কার হলো আমাদের সাথে বেড়াতে আসা এক স্যার এর নাক ডাকার শব্দ এটা। সেই স্যারের সাথেও পরবর্তীতে অনেক ট্যুর দেয়া হয়েছে। রাত বারোটা নাগাদ গেলাম ঘুমাতে, খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠতে হবে, তখন নাকি হরিণ এর দল পানি পাণ করতে আসে এখানে। মাঝে মাঝে দেখা মেলে বাঘেরও। তাই ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেলাম, ভোরবেলা উঠতেই হবে, যদি বাঘ মামার দেখা মেলে।
মন্তব্যসমূহ