দুবলার চর হয়ে জোছনা রাতে হিরণ পয়েন্ট

দুবলার চর হয়ে জোছনা রাতে হিরণ পয়েন্ট
কটকা থেকে রওনা দিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দুবলার চর পৌঁছলাম দুপুরবেলা। এর মাঝে নিজেদের মত করে সময় কাটালাম সবাই। মাঝে রইল হালকা নাস্তা আর চা পাণ এর আয়োজন। দুপুরের খাবারের আগে আগে আমরা দুবলার চর পৌঁছে গেলাম। এখানে একেবারে একটি শুটকি পল্লীর তীর ঘেঁষে নোঙ্গর ফেললো আমাদের তরী “রিয়া মনি”। ফলে কোন তাড়া ছিলো না, চল্লিশ জনের দলের সকলে নিজেদের মত করে দুবলার চরে নেমে ঘুরে দেখতে লাগলো চারিপাশ। কারও চললো ফটোগ্রাফি, কেউ কেউ শুটকি কিনতে খোঁজ খবর করতে শুরু করে দিলেন। আমি অনেকটা সময় মনা’র সাথে লঞ্চের সম্মুখের অংশে বসে ছিলাম, একসময় নামলাম বিখ্যাত দুবলার চরে।

কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে দুবলার চর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা । দুবলার চর একটা জেলে অধ্যুষিত গ্রাম, সারাবছর এখানে শুটকি চাষ হয় না। মূলত বর্ষা মৌসুম শেষ হলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা প্রভৃতি অঞ্চল হতে জেলেরা চলে আসে দল বেঁধে এই দুবলার চরে, গড়ে এখানে অস্থায়ী ডেরা। মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় চলে প্রায় চার মাস ব্যাপী শুটকি চাষ। তবে এখানে শুটকি চাষ এর জন্য নিতে হয় অনুমতি, সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের সদর দপ্তর বাগেরহাট থেকে এই অনুমতি সংগ্রহ করতে হয় শুটকি চাষ করতে আসা জেলেদের।

তবে দুবলার চর শুটকি’র চাইতে বেশী বিখ্যাত “রাসমেলা”র জন্য। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান “রাসমেলা” এবং এই সময়ের পূণ্যস্নান এর জন্য প্রতি বছর বাংলা ক্যালেন্ডারের কার্তিক মাসে অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাতে এখানে জড়ো হয়। ইতিহাস মতে, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিভজন নামক এক বনবাসী লোক, যিনি ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের এক ভক্ত, এই রাসমেলার গোড়াপত্তন করেন। এখানে মূলত তিনদিন ব্যাপী রাসমেলা হয়, যে মেলায় হিন্দু পুণ্যার্থী ছাড়াও দেশী বিদেশী অন্য ধর্মের পর্যটকদেরও আগমন ঘটে। রাসমেলার পূণ্যস্নানে প্রতিটি পুণ্যার্থী দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। এই সময় নানান বাদ্যযন্ত্রর বাজনার সাথে চলে ভজন-কীর্তন।

দুবলার চর মূলত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানে দেখা মেলে লাল বুক মাছরাঙা, মদনটাক পাখির; আমিও দেখেছিলাম। অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো ছবি তোলার, কিন্তু মোবাইল এর দূর্বল ক্যামেরা দিয়ে দূর থেকে ছবি তোলা যাচ্ছিলো না। আবার পাখিদের পেছনে ছুটেও লাভ হচ্ছিলো না, হুট করে তারা উড়াল দেয় কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই। এখানে হরিণের পালের দেখা মেলে যখন তারা দুবলার চরে ঘাস খেতে আসে।

দুবলার চর থেকে আমরা রওনা হই হিরণ পয়েন্ট এর উদ্দেশ্যে। প্ল্যান ছিলো বিকেলে হিরণ পয়েন্ট পৌঁছে এখানকার প্রাণপ্রাচুর্য অবলোকন করা। হিরণ পয়েন্ট এর আরেক নাম ‘নীলকমল’, এটি মূলত একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য যা ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। হিরণ পয়েন্ট একটি অভয়ারণ্য হওয়ায় এই স্থান অনেক বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি এবং সরিসৃপের পাশাপাশি প্রচুর পাখী দেখা যায় যার মধ্যে রয়েছেঃ সাদা বুক মাছরাঙা, হলুদ বুক মাছরাঙা, কালোমাথা মাছরাঙা, লার্জ এগ্রেট, কাঁদা খোঁচা, ধ্যানী বক প্রভৃতি। আর এই কারণে পাখীপ্রেমী এবং বার্ড ফটোগ্রাফী’র লোকজনের কাছে হিরণ পয়েন্ট ভীষণ জনপ্রিয়। এছাড়া সুন্দরবন এর যে সকল এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম একটি স্থান হলো এই হিরণ পয়েন্ট। এখানে রয়েছে প্রচুর কাঁকড়ার আবাস, চারিদিকে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় রঙ-বেরঙের প্রজাপতি। 

কিন্তু আমাদের মন্দ ভাগ্য, জোয়ার ভাটার ফেরে পড়ে আমাদের লঞ্চ পথিমধ্যে আটকে গেল একটি ডুবো চরে। প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে আটকে ছিলাম আমরা। আর এর ফলে আমরা যখন হিরণ পয়েন্ট পৌঁছলাম ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমাকাশে। সন্ধ্যের পরপর আমাদের লঞ্চ সেখানে পৌঁছলে আমরা আমাদের ইঞ্চিন নৌকায় করে দুই দলে ভাগ হয়ে দু’বারে গেলাম ‘নীলকমল অভয়ারণ্য’ ভ্রমণে, ততক্ষণে আকাশে পূর্ণচাঁদ। সেখানে ছিলো ওয়াচ টাওয়ার, কাঠের তৈরী তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়াক ট্রেইল। সেগুলোর কোনটাই উপভোগ না করা গেলেও, সেখানে টাওয়ার এর কাছে গিয়ে টেলিটক মোবাইল এর নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলে অনেকেই ফোনে আপনজনের সাথে ফোনালাপ সেরে নিচ্ছিলো। ফেরার সময় আমি দ্বিতীয় দলে ছিলাম, ফলে প্রথম দলকে নিয়ে যখন ইঞ্চিন নৌকা আমাদের তরী ‘রিয়ামনি’র দিকে যাত্রা করেছে, সেই সময় আশেপাশে ঘুরে দেখলাম। অন্ধকারে পূর্ণ চাঁদের আলোয় অদ্ভুত এক ঘোর লাগা পরিবেশ মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলো সেই সময়টুকু।

গল্পের ছবিসকল


ভ্রমণকালঃ ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩



আগের পর্ব পরের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ