তিন দিন আগে থেকেই কাউণ্টডাউন শুরু করে দিয়েছিলাম, যাচ্ছি সুন্দরবন। “ভ্রমণ বাংলাদেশ” নামক অ্যাডভেঞ্চার-ট্র্যাভেল বেইসড দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংগঠনের আয়োজনে; Sundor Sundorban Safary – 2013 (Season-2) নামক প্লেজার ট্রিপে। অবশেষে বৃহস্পতিবার, এলো সেই দিন; রাত সাতটায় ট্রেন। দুপুরের পরে রিপোর্টিং বসকে বলে বিকাল চারটায় বেরিয়ে গেলাম অফিস থেকে। গুলশান থেকে গন্তব্য নিউমার্কেট-আজিমপুর হয়ে কমলাপুর। আজিমপুর হয়ে যাওয়ার কারন আমার লাগেজ/ব্যাগেজ। আমার বন্ধু মনা’র বলা সত্ত্বেও তার বাসায় আগের রাতে ব্যাগ দিয়ে আসিনি। ভাবলাম তিন ঘণ্টা যথেষ্ট সময় গুলশান হতে আজিমপুর হয়ে ব্যাগ নিয়ে কমলাপুর যেতে। কিন্তু বিধিবাম, গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে চারটা ক্রস করলো। আজিমপুর পৌঁছলাম ছয়টার পরে, আমাদের মহান ট্রাফিক ব্যাবস্থার কল্যাণে। কোথায় ভেবেছিলাম বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রওনা হব, কোথায় কি? পড়িমরি করে ছুটলাম ব্যাগ নিয়ে কমলাপুরের উদ্দেশ্যে, ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টার উপরে। সিএনজি চালক ভাইয়েরা যেতে রাজি হলেন না। শেষে পেলাম এক রিকশাওয়ালা ভাইকে, রিকশাতো নয়-যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়া চালাল। সাতটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে কমলাপুর পৌঁছলাম। ধরতে পারলাম ট্রেন, আমি ট্রেন মিস করিনি।
কমলাপুর থেকে খুলনাগামী “চিত্রা এক্সপ্রেস” আসলো সাড়ে সাতটার পর। আমার কষ্টের তাড়াহুড়ো বিফলে গেল। রাত পৌনে আঁটটায় ট্রেন ছাড়ল। পথে বিমান বন্দর ষ্টেশন এবং গাজীপুর ষ্টেশন থেকে আরো কিছু ভ্রমণসঙ্গী উঠলো, মোট ৪৬ জন আমরা। পরে আরো কয়েকজন খুলনা থেকে যোগ দেয়ায় ৫০ ছাড়িয়েছিল আমাদের ভ্রমণ দলের সদস্য সংখ্যা। সারা রাত ট্রেনে সবাই গল্প করে করে পার করে দিলাম। ট্রেনে পরিচয় হল নুপুর আপু এবং মহী ভাইয়ের সাথে। অসম্ভব মিশুক এবং উৎফুল্ল দম্পতি। সারা ট্যুরে আমার বেশিরভাগ সময় কেটেছে তাদের সাথে। রাতে ট্রেনে ডিনার খেলাম নান-রুটি গরুর মাংস দিয়ে, চলন্ত ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কোন পাত্র ছাড়া এই মেন্যু খাওয়াটা ছিল খুব থ্রিলিং।
শুক্রবার সকাল সাতটা নাগাদ আমরা খুলনা পৌঁছলাম। রেলস্টেশনের পেছনেই ভেড়ানো ছিল আমাদের পরবর্তী তিনদিনের ডেরা, মটর ভেহিকেল “রিয়ামনি”। সকালের নাস্তা খিচুড়ি, ডিম ভাঁজা, বেগুন ভাঁজা, আচার...... আহা...! আমাদের পুরো ট্যুরে বাবুর্চি এবাদুর ভাই (নামটা নিয়ে আমি কনফিউজড, এমাদুর/এবাদুর) এবং তার দলের সার্ভিস ছিল অসাধারণ। নাস্তা শেষে আমাদের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্ব এবং ট্যুর ডিটেল ব্রিফিং হয়, এই ফাঁকে “রিয়ামনি” যাত্রা শুরু করেছে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। আমাদের প্রথম ডেসটিনেশন “করমজল” টুরিস্ট স্পট। দুপুর তিনটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম করমজলে। সারা রাতের জার্নির কারনে কেবিনে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ‘উ লা লা... উ লা লা’ শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি করমজল স্পটের ঘাটে “রিয়ামনি” ভিড়েছে আর পার্শ্ববর্তী অপর একটি ষ্টীমার থেকে ‘উ লা লা... উ লা লা’ বাজনা ভেসে আসছে। ‘উ লা লা’র দৌড়াত্ম বুঝতে পারলাম এই সুন্দরবনেও পৌঁছে গেছে। বনের প্রাণীরাও হয়ত এই গানের তালে তালে এখন নাচের আসর বসায়! এখানটা মোটামুটি পিকনিক স্পটের মত। আরো কয়েকটি ষ্টীমার-লঞ্চ দেখলাম ঘাটে ভেড়াতে।
করমজলের পর আমাদের গন্তব্যস্থল কটকা। সন্ধ্যার পর লঞ্চ দুই পাশে বনের ঝোপ রেখে ছুটে চলছে লোনা জল ভেদ করে, আকাশে তখন পূর্ণিমার রূপসী চাঁদ। এর সাথে যোগ করলাম কিছু রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত। আহা! প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা খোলা ডেকের সম্মুখভাগে বসে ছিলাম তন্ময় হয়ে। কি অপূর্ব সৌন্দর্য ভাই, বলে বুঝাতে পারব না। রাতের খাবার শেষে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে গেলাম বারোটার পর। সকাল পাঁচটায় উঠবো বলে। কারন সূর্য ওঠার আগে নাকি বাঘ পানি খেতে আসে কটকায়, মাঝে মাঝে দেখা পাওয়া যায়। যদিও দেখা পাইনি। তবে হরিনের পাল দেখেছি। মায়াবী হরিনের পাল, ভীতু নয়নের চাহনি, অস্থির দৌড়ঝাঁপ। সকালে স্যালো ইঞ্জিনের বোটে করে গেলাম জামতলা সী-বীচে। পথে পেলাম হরিনের পালের দেখা। জামতলা সী-বীচ ভাল লেগেছে। কক্সবাজারের বীচের মত নয়। তবে অনেকটা ইনানি বীচের মত, তবে এখানে রয়েছে প্রবালের বদলে সিডরে ভেঙে পড়া গাছের গুড়িগুলোর শৈল্পিক ভগ্নাবশেষ।
কটকা থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল দুবলার চর। শনিবার দুপুরের মধ্যে আমরা পৌঁছলাম দুবলার চর। এখানকার নীল সমুদ্রে পাখিদের উড়ন্ত রুপ অসাধারণ। এখানে দেখেছি মাছরাঙ্গা পাখি। সবচেয়ে মজা এবং দুঃখের ব্যাপার, আমি কোন ক্যামেরা নেইনি সাথে। পুরো ভ্রমনে মোবাইল ছিল একমাত্র আশ্রয়। কিন্তু মাছরাঙ্গা’র ছবি মোবাইলে তোলা যায়নি।
পরবর্তীতে হারবাড়িয়ায় দেখা কাঠঠোকরা ছবিও তুলতে পারিনি। দুবলার চরে ঘণ্টা দেড়েক কাটিয়ে আমরা রওনা দেই হিরন-পয়েন্টের অভিমুখে। পথে ডুবো চরে আটকে দেরী হয়ে যায়। হিরন-পয়েন্ট পৌঁছী যখন, সন্ধ্যা তখন প্রায় হয় হয়। স্যালো ইঞ্জিনের বোটে করে হিরন পয়েন্ট স্পটে যখন পৌঁছেছি তখন আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। দেরী হওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে দিল অপরুপা পূর্ণিমার চাঁদ। দুই ভাগে “রিয়ামনি”তে ফেরার কারনে প্রায় আধঘণ্টা অতিরিক্ত ছিলাম সেখানে, উপভোগ করেছি চাঁদের অপরুপ রুপকে। মনে মনে গেয়েছি “ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে...”।
রাতে “রিয়ামনি”র ছাদে বসলো গানের আসর। সবাই গলা ছেড়ে ধরল গান। গান শেষে সবাই গেলাম রাতের খাবার খেতে। আহ! বারবিকিউ!! পেট পুরে সবাই খেয়ে বসলাম টুটু ভাই, মনা, নুপুর আপু, মহী ভাই সহ আরও কয়েকজন মিলে আড্ডা দিতে। রাত দেড়টা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। হাসির সব জোকস শুনতে শুনতে পেটে খিল ধরে গেল।
পরদিন সকালে পৌঁছলাম হারবাড়িয়া।
এখানে দেখলাম বাঘের তাজা পায়ের ছাপ। চমৎকার বনজ সৌন্দর্য। হারবাড়িয়া ঘুরে দুপুরের আগে “রিয়ামনি” রওনা হল খুলনা, আমাদের যাত্রা শুরুর স্থানের দিকে। রূপসা ব্রিজের কাছে লঞ্চ থামান হল, ব্রিজটি দেখে ভাল লাগলো। আর্কিটেকচারাল ভিউ অপূর্ব। এখানে ভাল গরুর দুধের চা পাওয়া যায় শুনে ১০-১২ জন গেলাম চা খেতে। এসে দেখি “রিয়ামনি” আমাদের রেখে ছেড়ে দিয়েছে। স্যালো ইঞ্জিনের বোটে করে ছুটলাম তার পিছু পিছু। কিন্তু ধরতে পারলাম না। স্যালো ইঞ্জিনের বোটে করে লঞ্চ ঘাটে এসে দলের সাথে জুড়লাম। তবে মজা পেয়েছি এই ঘটনায়। রাতের খাবার শেষে রবিবার রাত আটটার “সুন্দরবন এক্সপ্রেসে” চরে রওনা হলাম ঢাকার অভিমুখে। পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় পৌঁছলাম ঢাকায়। অপূর্ব একটি ভ্রমণের ইতি হল। কিন্তু রেশ কাটেনি এখনও। সারাবেলা লঞ্চের দুলুনি এখনও মিস করছি।
সুন্দরবন ভ্রমণে কোন বাঘ-কুমির দেখিনি। বাঘ এখন প্রায় দেখাই যায়না। বাঘ দেখতে হলে যেতে হবে আরও গহিন বনে, যেখানে আমরা সাধারন টুরিস্টদের যাওয়াটা একটু কঠিন। তবে বনের সৌন্দর্য সেতো কম নয়। গহীন বনে গেলেই যে বাঘের দেখা পাবেন এমনটা নয়। বাঘের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এক বনরক্ষী দীর্ঘ আঠারো বছর বনে কাটিয়েও কখনো বাঘের দেখা পায়নি। বাঘের সংখ্যা যে ভাবে কমে আসছে, অদুর ভবিষ্যতে মানুষ বাঘ দেখতে সুন্দরবন যাবে না, কারন তখন বাঘ থাকবে না সুন্দর বনে। মানুষ সুন্দরবন যাবে শুধু সেই বনটাকে দেখতে, যেখানে একসময় বাঘ থাকতো, রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমাদের জাতীয় পশু।
সবশেষে ধন্যবাদ “ভ্রমণ বাংলাদেশ”কে এবং এর সদস্যদেরকে। যারা ভ্রমনপ্রিয় মানুষ, পছন্দ করেন দেশের আনাচে-কানাচেতে ঘুরে বেড়াতে তারা যোগাযোগ করতে পারেন এই ভ্রমণ পাগল দলটির সাথে এই ঠিকানায়ঃ ভ্রমণ বাংলাদেশ
গল্পের ছবিসকল
আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণের দলের জামতলা সৈকতের পাণে ঘাসবন ধরে পথচলাধ