জোছনাস্নাত রাতের শেষে হাড়বারিয়া ভ্রমণ দিয়ে সমাপ্তি হল সুন্দরবন সাফারি ২০১৩'র

জোছনাস্নাত রাতের শেষে হাড়বারিয়া ভ্রমণ দিয়ে সমাপ্তি হল সুন্দরবন সাফারি ২০১৩'র
  • করমজলের ছাউনিঘরে ভ্রমণসাথীদের আড্ডা
দ্বিতীয় দলের সাথে আমাদের লঞ্চ ‘রিয়ামনি’তে যখন হিরণ পয়েন্ট হতে ফিরছিলাম ইঞ্চিন নৌকায় করে তখন রাত নেমেছে নীলকমল নদীর বুকে, আকাশে নিয়ে পূর্ণ চাঁদ। জোছনার ফিনকিতে স্নাত চারিধার। শুধু যদি ইঞ্চিন নৌকার শব্দটুকু না থাকতো, তাহলেই হতো, একেবারে অন্য জগতের এক অনুভূতি। মায়াবী চাঁদের জাদুর জোছনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে ফিরলাম আমাদের জলতরী’তে। এরপর কিছুক্ষণ চললো নিজেদের মত আড্ডাবাজি। আর তারপর পরিবেশন হল রাতের খাবার, এদিনের আয়োজনে অতিরিক্ত হিসেবে ছিলো বারবিকিউ। সাথে ভেজিটেবল রাইস, চিকেন, বিফ, মিক্সড ভেজিটেবল এবং সালাদ। ভরপুর খানাপিনা শেষে ছাঁদে সামিয়ানার নীচে বসলো গানের আসর। তার আগে আমাদের এক ভ্রমণ সঙ্গীর ১৬ জিবি কার্ডের পুরোটাই শেষ, দেড় দিন ছবি তুলে। প্রতি মিনিটে একটা করে ছবি তুললেও কেম্নে কি? আল্লাহ্‌ মালুম তার পিকচার সাইজ কি ছিল! যাই হোক আমার ল্যাপটপ হতে কিছু ডাটা এক্সচেঞ্জ করে উনি উনার কার্ড ফ্রি করে নিলেন। 

এরপর রাতে ছাঁদে বসলো গানের আসর। প্রথমে দুয়েকজন হেঁড়ে গলায় গান ধরলে শুরু হলো অন্তক্ষরী (গানের অন্ত তথা শেষের বর্ণ দিয়ে পরবর্তী গান শুরু করা, হিন্দিতে যাকে বলে আন্তাকসিরি)। প্রথমে ছেলে মেয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে খেলা শুরু হলেও এক সময় সব গেল গুবলেট হয়ে। শিশুসুলভ উৎফুল্লতায় প্রায় সবাই ভুলে গেলো কে কোন দলে। অনেকটা সময় বেশ মজায় কাটলো। একটা সময় এই আসর শেষ হলে যে যে যার যার কেবিনে চলে গেল এক এক করে। আমি আমার কেবিনে এসে জানালা খুলে দিলাম। একসময় লঞ্চের বাতিগুলো নিভে গেলে সম্মুখের চরাচর চাঁদের আলোয় অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরী করলো। কেবিন হতে বের হয়ে সামনে রাখা চেয়ার গিয়ে বসলাম, পেছনে কেবিনের জানালা খুলে দিলাম আর ভেতরে ল্যাপটপে মৃদু শব্দে চালিয়ে দিলাম পছন্দের কিছু গান। এক সময় দুয়েকজন করে অনেকেই এসে এখানকার চেয়ারটায় বসলো। সঙ্গী পরিবর্তন হলেও আমি ছিলাম প্রায় রাত দেড়টা পর্যন্ত বসে। কিন্তু সেই সময়ে একটা ভুল করেছিলাম, মাথায় কোন শীত টুপি না দেয়ায় পরদিন ভুগলাম সর্দিতে। সাথে ছিলো হালকা জ্বর জ্বর ভাবও। যাই হোক, রাত দুটো নাগাদ গেলাম ঘুমাতে। 

এদিন ঘুম থেকে খুব সকালে উঠার তাড়া ছিলো না। সবাই আয়েশ করে ঘুমিয়ে নিলাম, আটটার দিকে সকালের নাস্তার আয়োজন ছিলো। নাস্তা শেষ আমরা গেলাম এই ট্যুরের শেষ স্পট "হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র" ভ্রমণে। খুলনা থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং মংলা বন্দর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে এই হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। হাড়বাড়িয়া সংলগ্ন ক্যানেল কুমিরের অভয়ারণ্য; প্রায়শই কুমির দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময় বাঘের কাঁচা পায়ের ছাপও দেখা যায় এই হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের আশেপাশে। আমরাও বাদ গেলাম না, দেখা পেলাম বাঘের পায়ের ছাপের, আমাদের বনরক্ষী গাইড এর কাছ থেকে জানলাম ছাপটি একেবারেই কাঁচা, বাঘটি ভোররাতের দিকেই গিয়েছে এই পথ দিয়ে। এখানে অনেক সময় মায়া হরিণের আনাগোনাও পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। 

হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র’র প্রবেশমুখেই দেখতে পাবেন নামফলক এবং এর থেকে একটু এগিয়ে গেলে হাতের ডানপাশে বন বিভাগের কার্যালয়। তা থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে একটি খাল রয়েছে এবং এই খালের উপর রয়েছে একটি ঝুলন্ত সেতু যা এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিকট একটি চিত্তাকর্ষক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মরণে এই খাল খনন করা হয়। খালের উপরের ঝুলন্ত সেতুর মাঝখানে গোলপাতার ছাউনি দেয়া একটি বিশ্রামাগার রয়েছে, সেখানে বেঞ্চি পাতা আছে, পর্যটকদের বসার জন্য। আমরা কয়েকজন গিয়ে সেখানে ফিরতি পথে বসে গল্প করেছিলাম। 

তার আগে গিয়েছে জাঙ্গল ট্রেকিং এ। খালের গাঁ ঘেঁষে দুটি পথ চলে গেছে। আমরা ডানের পথ ধরে এগিয়ে গেলাম। এই পথ দিয়ে বন ক্রমশ গভীর হয়েছে। কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে একটি “ওয়াচ টাওয়ার” এর; যা এখন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নড়বড়ে এই “ওয়াচ টাওয়ার”এর সামনে থেকে কাঠের তৈরী হাঁটাপথ শুরু হয়েছে, এই ট্রেইল প্রায় এক কিলোমিটার এর কিছুটা বেশী দীর্ঘ। এই পথ দিয়ে সবাই সারি বেঁধে হাঁটতে শুরু করলাম। চারিদিকের বুনো পরিবেশ এবং নিস্তব্ধতার মাঝে আমাদের নিজেদের মধ্যে বলা কথা বড়ই বেমানান লাগছিল। তাই একে অপরকে ইশারায় চুপ থাকতে বলছিলাম, আবার কেউ কেউ নিজেই সজোরে কথা বলে নিষেধ করছিলো শব্দ করতে। 

হারবাড়িয়া ভ্রমণ শেষে আমারদের লঞ্চ দুপুর নাগাদ রওনা দিলো খুলনা অভিমুখে। রূপসা ব্রীজের কাছে এসে পাড়ে ভিড়ানো হলো লঞ্চ রিয়ামনি’কে; আমরা নেমে পড়লাম ব্রিজটি ঘুরে দেখতে। চমৎকার আর্কিটেকচারাল ভিউ, কিছু ছবি তোলা হলো। এই ফাঁকে একজন বললো এখানে ভালো গরুর দুধের চা পাওয়া যায় কাছেই। আমরা ১০-১২ জনের দল গেলাম সেই চা পাণ করতে আর এই ফাঁকে রিয়ামনি আমাদের রেখে রওনা দিয়ে দিয়েছে। এরপর ফোন আর ফোন, দৌড় আর দৌড়। স্যালো ইঞ্জিন নৌকাটি আমাদের সাথে ছিলো, সেটিতে করে আমরা ছুটলাম লঞ্চের পেছন পেছন। যতই লঞ্চকে ধরার চেষ্টা করা হল, লঞ্চ যেন ততই দূরে সরে যেতে লাগলো। শেষে সিদ্ধান্ত হল লঞ্চ ঘাটে চলে যাক, আমরা এই ইঞ্জিন নৌকায় করে ঘাটে চলে যাবো। ভালই একটা এডভেঞ্চার হল এই লঞ্চ মিস করা আর ধরার চেষ্টার মাঝে। 

সন্ধ্যের পরে সবাই গল্পগুজব করে সময় পার করে দিলাম। এরপর রাত সাতটা নাগাদ রাতের খাবার সেরে নিয়ে আমরা রাত আটটার “সুন্দরবন এক্সপ্রেস” এ চড়ে রওনা হলাম ঢাকা অভিমুখে। ফেরার সময় সিটের যে একটু ঝামেলা ছিলো (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য) তা মিটিয়ে ফেলা হয়েছিলো, ফলে সবাই আরামসে যার যার সিটে আসন গেড়ে দশটা এগারোটা পর্যন্ত গল্পগুজব করে এক সময় ক্লান্ত বদন নিদ্রার কোলে আশ্রয় নিলো। 

সকাল ছয়টা নাগাদ কমলাপুর রেল ষ্টেশনে পৌঁছে শেষ হল তিনদিনের চমৎকার একটা ভ্রমণ। আর যে কোন সমাপ্তির মাঝেই একটা করুণ রাগিণী’র সুর থাকে প্রচ্ছন্ন মিশে। সবাই যখন সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলো, অনেকের চোখে মুখে সেই রাগিণী’র সুর খেলা করছিলো। বেশীরভাগ ভ্রমণ সাথীই একে অপরের সাথে এই ট্যুরে প্রথম পরিচয়, কিন্তু তিনদিন একসাথে আনন্দঘন এতগুলো মুহুর্ত কাটানোর পর কেমন একটা মায়ার বাঁধন তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। আসলেই কিন্তু তা সত্য। এই ট্যুরে প্রথম সাক্ষাত হওয়া কমপক্ষে দশজন মানুষের সাথে পরবর্তীতে ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সাথে অথবা নিজেরা অন্য আরও অসংখ্য ট্যুর দিয়েছি। আসলে এই ট্যুরে থেকেই সহপাঠী, সহকর্মী, প্রতিবেশী, আত্মীয় এসকল শব্দের পাশাপাশি ট্যুরমেট বা ভ্রমণসাথী বলেও যে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয় তা প্রথম জেনেছিলাম। তাই এই ট্যুর আমার জন্য বিশেষ একটা ট্যুর হয়ে থাকবে আজীবন। যদিও আগে অনেক ট্যুর করেছি, করেছি ট্যুর আয়োজন; কিন্তু সবই পরিচিত বন্ধু বান্ধব, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে। কিন্তু সেই ট্যুরই ছিলো প্রথম এতগুলো অচেনা অপরিচিত মানুষের সাথে ভ্রমণে বের হওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা। আর তাই আমার ভ্রমণ জীবনের পথচলায় এই অভিজ্ঞতার প্রথম পাঠ দেয়ার জন্য ভ্রমণ বাংলাদেশ এর নিকট থাকবো আজীবন কৃতজ্ঞ।

ভ্রমণকালঃ ২৬, ২৭ ও ২৮ জানুয়ারী, ২০১৩

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ