জামতলা সৈকত - সুন্দরবন সাফারি ২০১৩

জামতলা সৈকত - সুন্দরবন সাফারি ২০১৩
এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম, তাই ভোরবেলাই ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখনও আলো ফুটে নাই চারিধারে। আজ সুন্দরবন ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন, আমরা গতকাল খুলনা হতে রওনা দিয়ে করমজল ঘুরে রাতে চলে এসেছি কটকা। রাতে এখানেই নোঙ্গর করা ছিল আমাদের এই ট্রিপের মোটর ভেহিকেল, একটি ছোট তিনতলা লঞ্চ, নাম যার “রিয়া মনি”। আমার কেবিনটি ছিল দোতলা’র একেবারে সম্মুখে, সিঙ্গেল কেবিন। চারফিট বাই ছয়ফিট হবে সর্বসাকুল্যে হয়তো। কেবিন হতে বাইরে বের হতে দেখি বাইরেটা ভীষণ ঠান্ডা, শীত করছে। দ্রুত কেবিনে ঢুঁকে গরম কাপড় পরে নিয়ে ফের বাইরে বের হয়ে আমার কেবিনের জানালার বাইরের দিকে রাখা চেয়ারগুলোর একটায় বসলাম। আঁধার ফুঁড়ে যদি কিছু দেখা যায়। একটা দূরবীন নিয়ে এসেছি, সেটা কেবিনে ঢুঁকে ব্যাগ থেকে নিয়ে এলাম। ধুর অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না!
ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করলে একে একে সকল ভ্রমণসঙ্গীর দেখা মিলতে লাগলো। আকাশ কিছুটা আলোকিত হলে নদীর পাড়ে ছোট একটা হরিণের পাল এলো পানি খেতে। তিন চারটা হবে সব মিলে। আলো আঁধারিতে দূরবীন এর চাইতে খালি চোখেই ভাল লাগছিলো দেখতে। এরপর সবাই তৈরী হয়ে নিলে আমরা লঞ্চের সাথে বাঁধা ইঞ্চিন নৌকায় চেপে বসলাম, উদ্দেশ্য কটকা জামতলী সৈকত। লঞ্চ হতে ইঞ্জিন নৌকা কটকা খাল ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে গেলে জেটিঘাট এর দেখা পেলাম। এই খালপথ শেষ হয়ে যেখানে, সেখান থেকে পূর্বদিকে এগিয়ে গেলে ‘কচিখালি’ নামক একটা টুরিস্ট স্পট রয়েছে।
সুন্দরবন ভ্রমণ সুন্দরবন ভ্রমণ যাই হোক, খাল ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে হাতের ডান পাশে দেখা গেল একটা ছোট্ট জেটি, আমাদের ইঞ্জিন নৌকা সেখানে ভেড়ানো হলে আমরা জেটিতে নেমে এগিয়ে গেলাম সম্মুখ পাণে। এখানে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু একটা ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। সেখানে উঠে চারিদিকের চমৎকার দৃশ্যের দেখা মেলে। আমিও উপরে উঠলাম, আমার মোবাইলের ছোট্ট ক্যামেরায় তুললাম কিছু ছবি। দুঃখের ব্যাপার, আমি এই ভ্রমণে কোন ক্যামেরা নেইনি সাথে; পুরো সুন্দরবন ভ্রমনে মোবাইল ছিল একমাত্র আশ্রয়। সেখান হতে রওনা হলাম এখানকার সমুদ্র সৈকত এর পথে, যা ‘জামতলা সৈকত’ বলে পরিচিত। 
সুন্দরবন ভ্রমণওয়াচ টাওয়ার হতে প্রায় তিন কিলোমিটার উত্তরে জামতলা সৈকত পর্যন্ত হেঁটে যেতে প্রায় আধঘন্টার উপর লাগলো। চারিপাশের বনজ পরিবেশ দেখতে দেখতে আমার মত আলস্যপ্রেমীদের আরেকটু বেশীই সময় লাগলো। কটকার এখানটায় পূর্বদিকে রয়েছে ঘনবন আর মধ্যখানে মিষ্টি জলের পুকুর যা পাণের জন্য এখানকার কোস্টগার্ড, ফরেস্ট অফিসার ও স্থানীয় জেলেরা ব্যবহার করে থাকে। জামতলা সৈকত এর পূর্বপ্রান্তের শেষ মাথা গিয়ে মিশেছে কচিখালি, সেখানটা আবার বাঘ দেখার জন্য বিখ্যাত। ঘন বনের মাঝে তিনটা টিলা রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় ‘টাইগার টিলা’। যদিও আমরা সেদিকে যাই নাই, আমাদের গন্তব্য ছিলো জামতলা সৈকত। 
সুন্দরবন ভ্রমণ জামতলা সৈকতে পৌঁছে দেখা গেল সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ বৃক্ষের কান্ড এখনো টিকে আছে ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। ভাঙ্গা সেই গাছের কান্ডগুলো নিজেই একেকটা ভাস্কর্য যেন। অনেকেই সেখানে ছবি তুললো, কেউ কেউ সৈকতের জলের প্রান্ত ছুঁয়ে আনমনে হেঁটে বেড়াতে লাগলো পূর্বদিকে। বেশকিছুটা সময় এভাবে কাটিয়ে ফেরার পালা। আর তখনই দেখা মিললো বিশাল এক হরিণ পালের। 
আমাদের চল্লিশজনের দলটা ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে ফিরছিলাম জেটির দিকে। একেবারে সম্মুখে একটি বছর দশেকের বালিকা আরেক বছর ত্রিশের ভ্রমণসঙ্গীনির সাথে দৌড়াদৌড়ি করে সামনে এগুচ্ছিলো। হঠাৎ তাদের চিৎকারে সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। সবাই এক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। পরে দেখা গেল হুট করেই তারা প্রায় ২৫-৩০টি হরিণের এক পালের একেবারে মুখোমুখি, আর তাতেই হতভম্ব হয়ে নাকি খুশীতে সেই চিৎকার, সঠিক কারণ কোনটা তা কিন্তু জানা হয় নাই। কাছাকাছি যারা যারা ছিলো তারা ছবি তুলতে লাগলো; আর হরিণের পাল মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ধীরে ধীরে বনের দিকে পা বাড়ালো। জামতলা সৈকত যাওয়ার এই পথে খোলা প্রান্তে প্রতিদিনই ভোরবেলা হরিণের পালের দেখা পাওয়া যায়।
জামতলা সৈকত থেকে ফিরে সকালের নাস্তার পালা। এদিনের নাস্তায় ছিলো পরাটা-লুচি,সবজি,বুটের ডাল, হালুয়া। হালুয়াটা খুবই সুস্বাদু ছিলো। এরপর চা নিয়ে চলে এলাম তিনতলার ছাঁদে। সেখানকার চেয়ারে বসে চা পাণ করতে করতে দেখছিলাম চারিধার। আমাদের লঞ্চ এখন চলছে দুবলার চর এর উদ্দেশ্যে। যেহেতু দুপুর পর্যন্ত কোন কাজ নেই, তাই আমরা কয়েকজন পূর্ব পরিচিত একসাথে তাদের রুমে বসে কার্ড খেললাম অনেকটা সময়। এরপর অনেকেই গোসল সেরে নিলো। আমি এক সময় আমার কেবিনে গিয়ে মৃদু শব্দে গান ছেড়ে বসে প্রকৃতির রূপসুধা পাণ করতে লাগলাম।

ভ্রমণকালঃ ২৬ জানুয়ারী, ২০১৩



মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ