পরপর দুদিন চান্দের গাড়ীতে দীর্ঘ ভ্রমণ এর কারণে আমার ব্যাকপেইন সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় দ্বিতীয় দিন নীলগিরি থেকে ফিরে আমি হোটেলে চলে এসেছিলাম কিছুটা সময় পশ্চাৎদেশ’কে আরাম দেয়ার জন্য। এই সময়ে আমাদের ভ্রমণদল গেল মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স ভ্রমণে। কেরানীহাট-বান্দরবান সড়ক ধরে বান্দরবানের প্রবেশমুখের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার আগে বেশকিছু ছোট ছোট টিলা আকৃতির পাহাড়ে ঘেরা একটি লেককে ঘিরে এই পর্যটন কমপ্লেক্সটি গড়ে উঠেছে যা পরিচালিত হয় জেলা প্রশাসনের অধীনে। এখানে স্বচ্ছ পানির লেকে বোটিং এবং ঝুলন্ত সেতু আপনাকে মনে করিয়ে দেবে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক এর কথা। আগত পর্যটকদের জন্য নানান বিনোদন এর ব্যবস্থাপনা রয়েছে এখানে যার মধ্যে রয়েছেঃ চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, সাফারি পার্ক, প্যাডেল বোট, ক্যাবল কার, চা বাগান অন্যতম। এই মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের পাশেই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এর মোটেল রয়েছে পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য। যাই হোক, এত বিনোদনের চাইতে আমার বিশ্রাম বেশী জরুরী থাকায় আমি সে যাত্রায় মেঘলা ভ্রমণ থেকে বিরত ছিলাম। সেখানে ভ্রমণ শেষে ঘন্টা দেড়েক পরে আমাকে আর রুমি ভাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পুরো দল এবার রওনা হলাম স্বর্ণমন্দির এর উদ্দেশ্যে।
বান্দরবান শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পুরপাড়া এলাকায় পাহাড়ের চুড়ায় এই বৌদ্ধ মন্দিরটি ১৯৯৫ সালে স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে মিয়ানমার হতে নির্মাণ শিল্পী এনে এই মন্দিরের পুরো কাজ সম্পন্ন হয় ২০০৪ সাল নাগাদ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র এই তীর্থস্থানটির বাইরের অংশে ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে তিব্বত, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভূটান, মায়ানমার,কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের শৈলীতে সৃষ্ট ১২টি দন্ডায়মান বুদ্ধ আবক্ষ মূর্তি রয়েছে যা ধর্মীয় অনুসারীদের পাশাপাশি এখানে আগত পর্যটকদেরও দৃষ্টি আকর্ষন করে থাকে। মন্দিরের ভেতরের অংশে রয়েছে মায়ানমারের কাঠের শিল্প-কর্মের অসাধারণ সুন্দর রিলিফ ভাষ্কর্য। মন্দিরের মেরুন আর সোনালী রঙ দিয়ে অঙ্গসজ্জা’র কারণে দূর থেকে মন্দিরটিকে দেখলে মনে হয় যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো হয়েছে পুরো মন্দিরের অবকাঠামোটিকে। এই সজ্জা থেকেই মূলত এর নাম “স্বর্ণ মন্দির” হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই মন্দিরের পাশেরি পাহাড়ের উপরেই রয়েছে একটি ঐতিহ্যবাহী পুকুর যা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে ‘দেবতা পুকুর’ বলে পরিচিত। নানান বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং পূর্ণিমা তিথিতে শত শত পুন্যার্থী এই পুকুর পাণে জড়ো হয়ে থাকে।
এই স্বর্ণমন্দির বান্দরবান বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম দ্রষ্টব্য তালিকায় থাকে এবং কিছু ড্রেস কোড মেনে পর্যটকদের টিকেট কেটে ঢুকতে হয় এখানে। তো আমরা এখানে প্রবেশ করতে গিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমাদের দলের শাহরিয়ার বেচারার পড়নে ছিলো থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। স্বর্ণমন্দিরের গেটে বসা দুই তরুন কিছুতেই তাকে ভেতরে ঢুকতে দিবে না। কারণ হাফ প্যান্ট পড়ে ভেতরে ঢোকা নিষেধ। কি যন্ত্রণা! শাহরিয়ার তার থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টটাকে টেনে নীচে নামিয়ে গোড়ালির নীচে নিয়ে আসলো। অনেকটা এরাবিয়ান জোব্বার মত পায়ের পাতার কাছে ঝুলছে। তার পরেও রাজী হয় না তাকে ভেতরে ঢুকতে দিতে, অনেক বুঝিয়ে অবশেষে তাদের রাজী করাতে হয়েছিলো। আমরা যখন স্বর্ণমন্দিরে প্রবেশ করি তখন মধ্য বিকেল এর সোনালী আলো মন্দিরের সোনালী রঙে প্রতিফিলিত হয়ে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো চারিধার। চললো একগাদা ফটোসেশন। এর পর সেখান হতে আমরা রওনা হলাম আমাদের এবারের ভ্রমণের শেষ গন্তব্য ‘নীলাচল’ এর দিকে।
২০০৬ সালের শুরুর দিকে বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে “নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স” প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগার পাড়ার পাহাড় চূড়ায় গড়ে তোলা হয় এই পর্যটন কেন্দ্রটি। আমি প্রথমবার ভ্রমণ করেই এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এরপর আমি বান্দরবান গেলে শেষ বিকেল হতে সন্ধ্যেটা এখানে কাটাতে পছন্দ করি। এই নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর দেখা যায় এবং মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে প্রায়শই এখান থেকে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতও দেখা যায়। এখানে গড়ে তোলা হয়েছে ‘শুভ্রনীলা’,‘ঝুলন্ত নীলা’, ‘নীহারিকা’ এবং ‘ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট’ নামে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্রামাগার যা পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষন জোগায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ছয়শত ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই জায়গা হতে সূর্যাস্ত দেখা বাড়তি প্রাপ্তি এবং এই কারণে এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পর্যটকদের থাকার অনুমতি রয়েছে। নীলাচলে ভোরবেলা খেলা করে যায় মেঘেদের দল। সে এক আলাদা সৌন্দর্য!
আমরাও এখানে বসে রইলাম। এর মাঝে আমাদের দলের ছয়জন আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হয়ে গেল কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে; আর আমাদের বাস রাত নয়টার পরে, ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। আমরা যখন সূর্যাস্তের অপরূপ রূপসুধা পাণে ব্যস্ত, তখনই পূর্বাকাশে বিশাল এক রংধনুর দেখা মিললো এবং আরও অবাক করে দিয়ে সেই রংধনুর মাঝে প্রায় পূর্ণ চাঁদ শেষ বিকেলের আকাশে!!! উপস্থিত সকল পর্যটকের হর্ষোল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিধার। অনেকে ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো এই বিরল দৃশ্য ফ্রেমে ধরে রাখার নিমিত্তে; আবার আমার মত অনেকে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলো দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের পাণে। এরই মাঝে এক ভিখারী তার বাঁশিতে সুর তুলে বাজাতে লাগলো প্রেমময় গানের সুর। পুরো পরাবাস্তব এক পরিবেশ তৈরী করলো সব মিলে।
সন্ধ্যে মিলিয়ে আসার সাথে সাথে সকল পর্যটক বের হয়ে যেতে থাকলে একেবারে শেষ দলের সাথে আমরাও বের হয়ে এলাম। নীলাচলের প্রবেশমুখে থাকা দোকানে সবাই মিলে চা পাণ করে আমরা চলে এলাম হোটেলে। এখানে এসে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষে হোটেলের রিসিপশনে রাখা ব্যাগপত্তর নিয়ে চলে এলাম পায়ে হাঁটা দূরত্বের বাস কাউনাটারে। নির্ধারিত সময়ে বাসে চেপে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আগামীকালই সকালে ঢাকা পৌঁছে অফিস করতে হবে যে।
গল্পের ছবিসকল
মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের ঝুলন্ত ব্রীজ
স্বর্ণমন্দির চত্বরে ভ্রমণ বাংলাদেশ এর আমরা
এক্কেবারে রাজকীয়ভাব - বোকা পর্যটকের
রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে বান্দরবানের পাহাড়ী পরিবেশ
অপূর্ব সেই রংধনু
মায়াবী সেই গোধূলিলগ্নে নীলাচলে, সাথে অদ্ভুত সেই রংধনু
মন্তব্যসমূহ