পরদিন সকাল সাতটার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি দলের প্রায় সবাই উঠেছে ঘুম থেকে। এদিন আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে ছিলো বান্দরবান এর কিছু জনপ্রিয় স্পট। শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, স্বর্ণমন্দির, মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র এবং সবশেষে নীলাচল এ সূর্যাস্ত দেখে ট্যুরের সমাপ্তি। গতকাল রাতের সেই ভয়াবহ গাড়ী ভ্রমণের স্মৃতি আজকে সকালবেলায়ও যেন তাড়া করছিলো আমাদের অনেককেই। গতকালই সিদ্ধান্ত হয়েছিলো যে গতকালকের গাড়ী আজ যেন না নেয়া হয়। গাড়ী পরিবর্তন করে অন্য একটা গাড়ী সকাল বেলাই ঠিক করে রেখেছিলো আমাদের দলনেতাদ্বয়, মনা এবং তাহসিন। আমরা আটটা নাগাদ গতকাল রাতে যে রেস্টুরেন্টে ডিনার করেছিলাম, সেই ‘তাজিংডং রেস্টুরেন্ট’ এই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম এবং যেহেতু নীলগিরি থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর প্রায় পেড়িয়ে যাবে; তাই আমাদের দলের সবার জন্য দুপুরের লাঞ্চের অর্ডার করে দেয়া হলো। এরপর সকাল সাড়ে আটটার কিছু পরে আমরা রওনা হলাম আজকের সাইট সিয়িং এ, প্রথম গন্তব্য শৈলপ্রপাত।
বান্দরবান শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি রোডে পড়েছে এই শৈলপ্রপাতটি। অন্যান্য ঝর্ণা থেকে এটি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এ শীতল পানির প্রবাহ ঢালু পাথরের প্লেট দিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছে। যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি। ঝর্ণার হিমশীতল পানি এখানে সর্বদা বহমান। এই ঝর্ণার পানিগুলো খুবই স্বচ্ছ এবং হীম শীতল। পাহাড়ের নীচের দিকে এই প্রপাতের ধারা বয়ে চলেছে, সারা বছর জুড়েই শীতল পানির প্রবাহের কারণে এর আশেপাশেই গড়ে উঠেছে পাহাড়ি জনপদ।
এই শৈলপ্রপাতের পাশেই দেখা যাবে বম সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি। আমরা যখন পৌঁছোই সেখানে, কিছু বম নারী কাপড় কাচ্ছিলো একপ্রান্তে। শৈলপ্রপাতে নামার জন্য সিঁড়ি রয়েছে, সেটা দিয়ে সহজেই প্রপাতের জলের ধারে নেমে পড়লাম আমরা একে একে সবাই। তুললাম কিছু ছবি। নীলগিরি যাওয়ার পথে পড়ে বলে প্রায় সারা বছরই এখানে পর্যটকের আনাগোনা লেগে থাকে। আর সে কারনেই এখানে গড়ে উঠেছে বেশকিছু হস্তশিল্পের দোকান যেখানে বমদের তৈরী চাঁদর, মাফলার, শীত পোষাকের পাশাপাশি বেত ও বাঁশের নানান তৈজসপত্র এবং শোপিস বিক্রি হয়। পর্যটকের শখ করে সেসব স্যুভেনিয়র হিসেবে কিনে নিয়ে যান।
শৈলপ্রপাত হতে এবার আমরা ফের যাত্রা শুরু করলাম, পথে থামা হলো চিম্বুক পাহাড়ে। সেখানে একটু ঢুঁ মেরে সরাসরি রওনা হলাম নীলগিরি। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের নীলগিরি পাহাড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতেকে ২২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পর্যটন কেন্দ্রে সেনাবাহিনী পরিচালিত কটেজ রয়েছে; যদিও সেগুলো ভাড়া অত্যাধিক এবং সহজে বুকিং দেয়া যায় না অথবা খালি থাকে না। তবে নীলগিরিতে ভোরবেলা চারিধারে মেঘে ঢেকে যায়, চারিপাশের নীচু পাহাড়ি এলাকাগুলো তখন থাকে মেঘের নীচে, যা সত্যি নয়নাভিরাম। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন মেঘের কোন চিহ্নই নাই, প্রখর রোদ। আমাদের গাড়ী পার্কিং করিয়ে টিকেট কেটে সকলে ঢুঁকে পড়লাম নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে।
প্রথমে দলের সবাই নিজেদের মত করে ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু একটু পরই এলেন দুই দলনেতা, শুরু হলো তাদের ফটোশ্যুট। নীলগিরির হেলিপ্যাডে নানান রঙ্গে, নানান ঢঙ্গে প্রখর রোদে আমাদের পোজ দিতে হল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাবত চলা ফটোশ্যুটে একসময় বিরক্ত হয়ে রেগে গেলাম। ভাই মাফ কর! ছবি তুলতাম না। ফটোশ্যুটের কয়েকটা শেয়ার করলাম। যাই হোক এরপর নিজেদের মত করে ঘুরে দেখলাম, কিন্তু সূর্যের তেজ বড্ড জ্বালাতন করছিলো। গরমে অতিষ্ঠ্য হয়ে পাহাড়ের ঢালের আগে একটা বেঞ্চি ফাঁকা দেখে গিয়ে বসে পড়লাম আমি আর রুমি ভাই। অবারিত প্রান্তরের পাণে চেয়ে সবুজ পাহাড়ের সারি দিকে চেয়ে থাকতে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। সাথে পাহাড়ের ঢাল হতে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস আসছিলো। অনেকটা সময় বসে থেকে রুমি ভাই বেঞ্চ হতে নেমে সবুজ ঘাসে গিয়ে বসলে আমি বেঞ্চে শুয়ে পড়লাম। চোখে রোদ পড়তেই রোদ চশমা দিলাম, আহ শান্তি। পাজি ফটোগ্রাফারেরা এখানে এসেও ছবি তুলে নিলো। 😜
বেলা বারোটার আগে আগে আমরা নীলগিরি থেকে নেমে রওনা হলাম ফিরতি পথে, বান্দরবান শহরের দিকে। প্রায় তিনঘন্টার জার্নিতে আমার শুরু হলো ব্যাক পেইন, অসহ্য কষ্ট হচ্ছিলো বসে থাকতে। এদিকে নুপুর-মহি দম্পতি আতকা প্ল্যান করে ফেললো, তারা এখান থেকে কক্সবাজার যাবে, সেই দলে মনা-মিনি এবং বাসে পরিচয় হওয়া সেই দম্পতি যারা আমাদের দলের সদস্য হয়ে গিয়েছিলো তারাও যোগ দিলো। আমাদের যেহেতু রবিবার অফিস, তাই রাগ হচ্ছিলো সাথে ওদের হিংসেও হচ্ছিলো। এসবের চাইতে বেশী ব্যাকপেইন এর যন্ত্রণা কষ্ট দিচ্ছিলো।
বেলা তিনটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বান্দরবান শহরে। সরাসরি হোটেলে না গিয়ে আমাদের গাড়ী থামলো তাজিংডং রেস্টুরেন্টে। সেখানে আগে থেকে সকালে অর্ডার করে যাওয়ায় আমাদের খাবার আলাদা করে রাখা ছিলো; আমরা হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই খাবার পরিবেশন করলো। খাবার দাবার পর্ব শেষ হলে দল রওনা হলো মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের দিকে, আমি হোটেলে চলে এলাম, আমার ঘন্টাখানেক বিশ্রাম দরকার। আমার সাথে রুমি ভাইও সাথী হলেন, দুজনে হোটেলে চলে এলাম, বাকীরা চলে গেল মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে ঘোরাঘুরি শেষে ঘণ্টাখানেকের বেশী সময় পর ওরা হোটেলের কাছে এসে ফোন দিলে আমরা দুজন আবার যোগ দিলাম তাদের দলে। আমাদের নিয়ে গাড়ী চললো এবার স্বর্ণমন্দির আর নীলাচল ভ্রমণে। প্রথম গন্তব্য স্বর্ণমন্দির।
গল্পের ছবিসকল
যাত্রাপথে পাহাড়ি নদীর বেয়ে যাওয়া পথে কালভার্ট টাইপ ব্রীজ
মন্তব্যসমূহ