সেদিন রিজুক ঝর্ণার ঘোলাটে পানি আর তীব্র স্রোতের কারণে ঝর্ণার পাশে দাড়িয়ে সবাই ছবি তুলে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে নিলাম। অতঃপর যাত্রা শুরু করলাম রুমা বাজারের দিকে। ফিরতি পথে চোখে পড়ল অসংখ্য ছোট ছোট পাহাড়ি স্রোতধারা যা মিনি ঝর্ণা বলে চালিয়ে দেয়া যায়। দুপুরের খাবার রুমা পৌঁছেই সেরে নেয়ায় এবং রুমা বাজারের কাছাকাছি রাস্তা খারাপ থাকায় আমরা রুমায় অবস্থিত ব্রিজের নীচে বোট হতে নেমে রাস্তার পথ ধরি। আগে থেকে ড্রাইভারকে বলে দেয়ায় সে গাড়ী নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। সবাই এক কাপ গরম চা খেয়ে ভেজা শরীরেই রওনা হলাম বান্দরবান শহরের উদ্দেশ্যে। এখানে আমরা অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলি। যার খেসারত পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় দিতে হয়েছিলো।
গাড়ী যখন ফিরতি যাত্রা শুরু করলো তখন ঘড়িতে বিকাল ৫টা ছুইছুই। আমার মনে কেন জানি কু-ডেকে উঠলো। কারণ আসার সময় প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা ছিল। তারমানে ফিরতে ফিরতে রাত ৮তা-৯টা বেজে যাবে। আঁধারে এই বাঁকানো পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয়া, কেন জানি খানিকটা ভয় পেলাম। রুমা বাজার থেকে বান্দরবান শহরের দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। ১৫-২০ কিলোমিটার গাড়ী চলল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। তার পর নামল অন্ধকার। হঠাৎ সামনের কাঁচে ঘোলাটে ধোঁওয়া! ঘটনা কি, এই সময়ে কুয়াশা! ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এইটা কুয়াশা না, মেঘ! সেই মেঘ সকালে যেই মেঘ দেখে আফসোস করেছি কেন সে আমাদের এই পাহাড়ে নেই?
এখন সেই মেঘ আমাদের পথ নিয়ে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে। আমি ছিলাম চান্দের গাড়ীর ড্রাইভারের পাশের সিটে, সামনের অংশে। দুই-তিন হাত সামনের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। ১৫০-১৬০ ডিগ্রি বাঁকানো পাহাড়ি পথ, ঘন কুয়াশার ন্যায় মেঘে ঢাকা সম্মুখ পথ, তার সাথে গোদের উপর বিষফোঁড় হিসেবে জুটল তুমুল বৃষ্টি। তরুন ড্রাইভার আমাকে আশ্বস্ত করতে লাগল এই বলে যে, আল্লাহ্ চাহে তো আমরা ভালয় ভালয় পৌঁছে যাব। প্রায় দুই ঘণ্টা দম বন্ধ অবস্থায় পাহাড়ি সেই বাঁকানো ঘন আঁধারি পথে হেডলাইটের আলো দিয়ে পথ ঠাউর করে এসে পৌছাই বান্দরবান শহরে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর সময়টুকু পার করলাম এই দুই ঘণ্টায়।
প্রতিটি বাঁক পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল এই বুঝি গাড়ী খাঁদের অতলে পড়ে হারিয়ে যাবে আমাদের নিয়ে। আমি যতবার জমাট মেঘের অন্তরাল ভেদ করে পথ ঠাওর করার চেষ্টা করেছি, ততবারই বিফল হয়েছি, দেখা গেছে আমি যেদিকে পথ বাঁক নিয়েছে ভেবেছি সে দিকে পাহাড়ি খাঁদ, পথ তার বিপরীতে! পাহাড়ি পথে মেঘের ভেতরে তুমুল বৃষ্টি, এই অবস্থায় যদি কেউ পথ পাড়ি দিয়ে থাকেন সেই বুঝবেন কি ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা। বার বার তখন মনে হচ্ছিল কেন সকালে মেঘের ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলাম? শখের সেই চাওয়া যে এত ভয়ঙ্করভাবে পাওয়া হবে তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।
আমি অনেকটা সময় চেষ্টা করেও পথের দিক ঠাওর করতে পারছিলাম না, অথচ আমাদের ড্রাইভার, বছর বিশ বাইশের যুবক, সে কিভাবে গাড়ী চালাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। তার হেড লাইটের আলোও তেমন জোরালো না, সাথে তার গ্লাস ওয়াইপারও ঠিকমত কাজ করছিলো না। আমি অনেকক্ষণ দোয়া দুরুদ পাঠ করে কাটিয়ে দিলাম। একসময় আর থাকতে পারলাম না, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে পথ এর দিক কেমন করে ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারছে? উত্তরে সে যা বললো, আমি শুনে আরও ভয় পেলাম। সে সামনে দেখে গাড়ী চালাচ্ছে না!!! জানালা দিয়ে কালো পিচ ঢালা রাস্তা আর তার পাশে প্রান্তে থাকা লাল মাটির অংশ দেখে সে পথ বুঝে চালাচ্ছে। এমন বৃষ্টির দিনে রাতের বেলা নাকি এভাবেই গাড়ী চালায়!!!! আমার দোয়া দুরুদ পড়ার গতি আরও বেড়ে গেল।
অবশেষে রাত নয়টার কাছাকাছি সময়ে আল্লাহ্র অশেষ রহমতে সুস্থ অবস্থায় পৌঁছাই বান্দরবান শহরে। এরপর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবাই মিলে তাজিংডং নামক এক রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে যাই। বান্দরবান থানার নিকটেই সেই রেস্টুরেন্ট এর খাবারের স্বাদ কিন্তু খুব ভালো ছিলো। সবাই আয়েশ করে খেয়ে দেয়ে রাতের নীরব রাস্তায় হেঁটে হেঁটে হোটেলের পাণে এগুতো লাগলাম। এর মাঝেই সিনেমা নিয়ে আলোচনা চলে এলো, তিন বন্ধুর গল্প নিয়ে তৈরী তিনটি হিন্দি সিনেমা দিল চাহতা হ্যায়, জিন্দেগী না মিলে গি দুবারা আর থ্রি-ইডিয়টস; আমার মুখে এই তিন ছবির নাম এক কাতারে শুনে শাহরিয়ার পত্নী মুন গেল ক্ষেপে, তার মতে 'জিন্দেগী না মিলে গি দুবারা' কোন মতেই অন্য দুই সিনেমার ধারে কাছে যেতে পারে না। এই নিয়ে চলল তর্ক। এসব করতে করতে অনেকটা সময় রাতের নির্জন রাস্তায় কাটিয়ে আমরা এক সময় চলে এলাম আমাদের হোটেলে। এরপর যার যার রুমে গিয়ে ঘুমাবার আয়োজন। আগামীকাল এর প্ল্যানে আছে নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির আর মেঘলা। আমি আর রুমি ভাই আমাদের রুমে ঢুঁকে আরও অনেকটা সময় ইতিংবিতিং নানান গল্প করে ঘুমাতে গেলাম রাত বারোটার পর।
মন্তব্যসমূহ