রিজুক ঝর্ণা ভ্রমণ - বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩

রিজুক ঝর্ণা ভ্রমণ - বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩

গল্পের ছবিসকল

  • সাঙ্গু নদীর পাড়ে পাহাড়ি প্রকৃতি
  • চারিদিকে সবুজের সমারোহ
  • নদীর পাড়ে পাহাড়ের ঢালে জুমঘর
  • মেঘ ছেয়ে গেছে আকাশ জুড়ে
  • রিজুক ঝর্ণার পাদদেশে আমাদের দলের ভ্রমণসাথীদের ফটোগ্রাফী চলছে
মাঝে মাঝে আমরা এমন অনেক কিছুই চাই, যা সময় ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্ত হয়। এমন অনেক চাওয়া থাকে যা পরবর্তীতে মনে হয় কেন এমন চেয়েছিলাম ? অথবা অনেক সময় চাওয়া আর পাওয়া’র মধ্যকার তফাৎটা পুরো ব্যাপারটাকেই বদলে দেয়। সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি আকাশটাকে ছুঁয়ে দেখব। যদি আকাশটাকে নাও ছুঁতে পারি, মেঘটাকে ছুঁয়ে দেখার শখ ছিল। কিন্ত সেই চাওয়া যদি এমন সময় পূরণ হয়, যখন তা বিষফোঁড় হয়ে দেখা দেয়; তবে তাঁর চাইতে নির্মম আর কি হতে পারে। 
সকালবেলা যখন বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাজারের উদ্দেশে রওনা হই, তখন পাহাড় আর মেঘের মিতালী দেখে প্রতিমুহূর্ত রোমাঞ্চিত হয়েছি। নীলাকাশে মেঘের ভেলা ডানা মেলে জড়িয়ে রেখেছে চিরহরিৎ পাহাড়ের দলগুলোকে। সর্পিল বাঁক নেয়া পাহাড়ি পথ বেয়ে, কখনো খাঁড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠেছে “চাঁন্দের গাড়ী”, আবার কখনোও বা ১৫০-১৬০ ডিগ্রি বাঁকানো পথে ছুটে চলেছে তেরজন পর্যটকের দল নিয়ে। সেই সময়ে মনের গভীরে একটি কামনা জেগে উঠেছিল, “যদি মেঘগুলো আমাদের গাড়ী যে পাহাড় দিয়ে ছুটে চলেছে সেই পাহাড়টাকে ঐভাবে জড়িয়ে ধরত! আমরা থাকতাম মেঘের আলিঙ্গনে! 
রিজুক ঝর্ণা, বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩ ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সাথে “সুন্দরবন সাফারি” ট্রিপ দেয়ার পর প্রায় প্রতি মাসেই ট্যুরে বের হওয়া শুরু হয়ে গেল। ২০ জুন ২০১৩ এর রাতের বাসে করে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকা থেকে প্রায় দশজনের দল। আমি আর আমার সাথে আমার অফিস কলিগ রুমি ভাই, সাথে বাল্যবন্ধু মনা এবং মনার নববধু মিনি, সুন্দরবন ট্রিপে পরিচয় হওয়া নুপুর-মহি দম্পতি, শাহরিয়ার-মুন দম্পতি সাথে নতুন ভ্রমণবন্ধু হাসিব এবং মনিরুল। দলনেতা হিসেবে যোগ দিলেন তাহসিন শাহেদ। আমাদের এগারোজনের দল ফকিরাপুর হতে বাসে করে রওনা হয়ে পরদিন সকালে পৌঁছলাম বান্দরবান। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর ২০০১ সালে একবার পার্বত্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, রাঙ্গামাটি এবং কাপ্তাই লেকে ভ্রমণ করেছিলাম। এরপর আর পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়া হয় নাই। দীর্ঘদিনের ভ্রমণ বিরতি ভেঙ্গে শুরু হওয়া ভ্রমণকালের এই পর্বে প্রথমবার এলাম পার্বত্য চট্টগ্রাম আর অতি অবশ্যই বান্দরবান এ প্রথমবারের মত। বাসে টিকেট নিয়ে এক দম্পতির ঝামেলা মেটাতে এগিয়ে গেলেম মনা ভাই, উনার ইউনিক পরিবহণে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকায় উনি মোবাইল ফোনে কথা বলে সমস্যা মিটালে বাসে সেই দম্পতির সাথে আমাদের দলের পরিচয় হয়ে গেল এবং উনারাও যোগ দিলেন আমাদের ভ্রমণ দলে। ফলে আমাদের দল দাঁড়ালো লাকি থার্টিন এ। 
রিজুক ঝর্ণা, বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩দীর্ঘ দশ ঘণ্টার যাত্রা শেষে সকাল আটটা নাগাদ আমাদের বাস পৌঁছে গেল বান্দরবান। বাস হতে নেমে আমরা গেলাম একটা সরকারী রেস্ট হাউজে, আগে থেকে বলে রাখা ছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলাম দুঃসংবাদ, ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা বান্দরবান চলে আসায় নাকি আমাদের রুম বুকিং বাতিল হয়েছে। সারারাত বাস জার্নি করে ক্লান্ত দেহে এই খবরে সবাই কিছুটা হতাশ হলাম। কিন্তু আমাদের দলনেতাদ্বয়, তাহসিন এবং মনা দ্রুতই হোটেল হিলটন এ রুম বুক করলেন। অতঃপর আমরা হোটেলে ব্যাগ-এন্ড-ব্যাগেজ রেখে একটি ল্যান্ডক্রুজার জীপ ওরফে চাঁন্দের গাড়ী ভাড়া করে যখন রওনা হই রুমার উদ্দেশ্যে, তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা অতিক্রম করেছে। বান্দরবান ভ্রমণে আজকের গন্তব্য রিজুক ঝর্ণা। 
রিজুক ঝর্ণা, বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩পাহাড়ি পথে যখন আমাদের “চাঁন্দের গাড়ী” ছুটে চলেছে, আমরা তখন ব্যাকুল হয়ে উপভোগ করছি দিগন্ত জোড়া পাহাড়ের সারির সাথে সাদা মেঘের ভেলার মিতালী, উপরে স্বচ্ছ নীলাকাশ। আমি বসেছিলাম গাড়ির সামনের সিটে, ড্রাইভারের পাশে। জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টি দিয়ে লুটেছি প্রকৃতির রুপ। Y জংশনে চেক পোস্টে আমাদের গাড়িটি থামলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি কামেরার মেমোরিতে প্রকৃতির এই অপার্থিব রুপকে ধরে রাখতে। সেখান থেকে পরবর্তী যাত্রাবিরতি ছিল পিক সিক্সটি-নাইনে। পিক সিক্সটি-নাইন হল বাংলাদেশের স্থলযান চলাচল যোগ্য সর্বোচ্চ স্থান। সেখানে আবারও ফটোসেশন। এবার পাহাড়ের মাঝে রুপোলী ফিতের ন্যায় যোগ হয়েছে সাঙ্গু নদী। আবার যাত্রা শুরু করে যখন পৌঁছলাম রুমা বাজার, তখন সূর্য মধ্যরেখা পার করে পশ্চিমের দলে। দুপুর ২.৩০ নাগাদ আমরা শ্যালো-ইঞ্জিন চালিত বোটে করে রওনা হলাম রিজুক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। 
রিজুক ঝর্ণা, বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি রিজুক জলপ্রপাত। সব মৌসুমেই সচল রুমা জলপ্রপাতের স্বচ্ছ পানি ঝরে পড়ে সরাসরি নদীতে। রিজুক, রেমাক্রি ওয়াহ এবং তেছরী প্রপাত-এই তিন অপরূপা অরণ্য কন্যাকে দেখতে প্রতি বছর ভিড় করেন হাজার হাজার পর্যটক। আমাদের লক্ষ্যস্থল রিজুক ঝর্ণা। বোট ছুটে চলছে পাহাড়ি নদীপথ ধরে। আমাদের দলের সবাই টুকটাক গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আকাশ মেঘলা হয়ে উঠতে শুরু করলো, আর আমাদের দলের সবাই একে একে বোটের ছাঁদে উঠতে শুরু করলো। আমি প্রথমে তেমন পাত্তা দিলাম না, আমি নৌকার ছাউনির ভেতর বসে রইলাম। একে একে সবাই ছাঁদে উঠে লম্বা সারি করে বসে পড়ল। মেঘলা আকাশের নীচে আমাদের পাহাড়ি নদীর জল ফুঁড়ে ছুটে চলা! আমি সবেমাত্র ভাবছি, নাহ! আমিও না হয় ছাঁদে চলে যাই। ভাবতে ভাবতেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। সবার সে কি আনন্দ ধ্বনি! এমন বৃষ্টিতে কে কবে ভিজেছে? কিন্তু সাথে থাকা মোবাইল, ক্যামেরা, ঘড়ি আরও কত কি সবাই উপর থেকে আমার কাছে পার্সেল করতে থাকলো। একসময় আমি সবার জিনিসপত্র সামলাতে হিমসিম খেতে লাগলাম। সবার পার্সেল করা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সামলে আমি আটকা পড়লাম নীচে, আর উপরে সবাই খুশীতে হৈহুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। 
রিজুক ঝর্ণা, বান্দরবান ভ্রমণ ২০১৩রিজুকে পৌঁছে সবার চক্ষু চড়কগাছ। ফুলে ফেঁপে বিশাল জলরাশি নিয়ে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ি জলধারা। প্রবল বেগে বিশাল জলরাশির এই পতন তলে যাওয়ার সাহস কেউই করে উঠতে পারি নাই। তাঁর উপর কিছুদিন আগে এমন বৃষ্টির সময় ঝর্ণার জলে গোসল করতে যেয়ে বিপদে পড়েছিল কয়েকজন পর্যটক। তাতে কি? সাহস করে কাছাকাছি গিয়ে চবি তুলতে কেউ ভুল করে নাই। তবে ঝর্ণার পানি এত বেশী পরিমাণ মাটি নিয়ে আসছিল পাহাড়ি পথ বেয়ে যে, সেই পানিতে নিশ্চয়ই কেউ ভিজতে রাজী হবে না। পাহাড়ি মাতাল ঝর্ণার পাশে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরতে মন চাচ্ছিলো না কারোরই। কিন্তু আমরা রওনা হতেই অনেক দেরী করে ফেলেছি আর তার সাথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাই এক সময় রওনা হলাম আমরা ফিরতি পথে। আর তখনই টের পেলাম ভয়ঙ্কর সুন্দরীতমা বান্দরবান এর। অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে যেন ফিরে এলাম সেদিন। সেই গল্প হবে পরের পর্বে।             

ভ্রমণকালঃ ২১ জুন, ২০১৩



পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ