ঝর্ণার প্রতারণা - খইয়াছড়া

ঝর্ণার প্রতারণা - খইয়াছড়া
এক সপ্তাহের ব্যাবধানে পর পর দুইবার ঝর্ণা আমার সাথে প্রতারণা করলো। এই কি তার প্রেমের খেলা? সত্তেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, 
"ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!  তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন-বর্ণা! "
গত সপ্তাহে বান্দরবান ট্যুরে “রিজুক ঝর্ণা” পৌঁছে ঝর্ণার পানিতে ভেজার সৌভাগ্য হয়নি বৃষ্টিতে ঝর্ণায় সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলের ভয়ংকর রূপের কারনে। এক সপ্তাহের ব্যাবধানে একই কারনে একেবারে কাছাকাছি গিয়েও দর্শন হল না দেশের সর্বোচ্চ সাত স্তর বিশিষ্ট ঝর্ণা “খইয়াছড়ার”। 
সপ্তাহের ব্যাবধানে আবার ছুটে চলা প্রকৃতির টানে। গত সপ্তাহের বান্দরবান ট্যুর নিয়ে লেখেছি “ভয়ংকর সুন্দরীতমা বান্দরবান” শিরোনামে আমার আগের লেখায়। গত বৃহস্পতিবার রাত ১১:৩০ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সম্মুখের ছবিরহাটে পৌছাই “ভ্রমন বাংলাদেশ” আয়োজিত “Day long Trip: খৈইয়াছড়া ঝর্না ,মহামায়া,মুহুরী প্রজেক্টে” ইভেন্টে যোগ দিতে। রাত ১২:৩০ নাগাদ মোট ৫০ জনের দল তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে একটি ২৮ সিটের কোস্টার এবং দুটি ১২ সিটের মাইক্রবাস নিয়ে যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের উদ্দেশ্যে।
আমি আর আমার সহকর্মী খালেদ ওমর রুমি ছিলাম ২৮ সিটের গাড়িতে। ঘণ্টা দেড়েক গাড়ি ঠিকঠাক চলার পর গাড়িতে যান্ত্রিক ত্রুটি দ্দেখা দেয়। পুরোটা পথ বার বার গাড়ি থেমে থেমে কুমিল্লা ক্যান্টরমেণ্ট পৌঁছাই ফজরের আগে আগে। শেষ পর্যন্ত সেই গাড়ি বাদ দিয়ে কুমিল্লা হতে একটি ৪২ সিটের মিনিবাস ভাড়া করা হয়। দীর্ঘ আট ঘণ্টায় ২০০ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছই মিরেরসরাই। আমাদের সঙ্গী অপর দুই মাইক্রবাসের ২৪ জন সঙ্গী ইতোমধ্যে সকালের নাস্তা সেরে মহামায়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। আমরা দ্রুত নাস্তা সেরে রওনা হলাম মহামায়ার দিকে।
মহামায়া পৌঁছে আগে থেকে ভাড়া করে রাখা ফাইবারের তৈরি বোটে করে আমরা ২৮ জনের দলটি রওনা হই। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃত্রিম লেক মহামায়া। চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা, মাঝে মাঝে লেকের বুকে ছোট পাহাড়ি দ্বীপের ন্যায় ভূখণ্ড। কোথাও কোথাও ঢালু পাহাড়ের গায়ে কিছু লোককে দেখলাম চাষাবাদে ব্যাস্ত, কিছু জায়গায় গরু চড়াতে দেখ গেল। এই রকম বাঁক ঘুরতে ঘুরতে এগুতে থাকি আমরা। হঠাৎ একটি বাঁক ঘুরতে দেখা মেলল এক বিশাল গুই সাপের, ঢালু বাক বেয়ে জলে নামার মুহূর্তে তার সাথে দেখা। কিন্তু তিন তিন জন ফটোগ্রাফার ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে ব্যাস্ত থাকলেও তিনজনই মিস করেছে ওই গুইসাপটিকে, তারা ছিল বিপরীত দিকে মুখ করে।
হঠাৎ একটি বাঁক ঘুরার সময় প্রবলবেগে পানি পরার শব্দে সবাই সচকিত হলাম। বাঁক ঘুরতেই চোখে পড়ল সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে নেমে আসা এক বিশাল ঝর্ণার, যা ছিল আমাদের জন্য সারপ্রাইজ। কারণ, আমরা কেউ জানতাম না যে, এখানে কোন ঝর্ণা আছে। আমাদের বোটটি ঝর্ণার পাশের ঢালুতে ভেড়ানো মাত্রই সবাই নেমে পড়লাম ঝর্ণার পাশে ফটোসেশনে ব্যাস্ত হতে। ঝর্ণার প্রবল বেগ দেখে কেউ সাহস পায় নাই তার নীচে যেতে। এর পর ফিরে এসে দেখা পেলাম আমাদের অগ্রবর্তী দলের, সেই রাতে ছবিরহাট থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর আবার একত্রিত হলাম আমরা। 
এরপর আমাদের যাত্রা খইয়াছড়ি ঝর্ণার উদ্দেশে। বার দুয়েক ভুল পথে আগে পেছনে যেয়ে অবশেষে খইয়াছড়ি ঝর্ণার রাস্তা খুঁজে পেলাম আমরা। গাড়ী ছেড়ে দিয়ে আমরা মাটির পথ ধরে হাটা শুরু করলাম। প্রথমে ইট বিছানো পথ কিছুক্ষণ পাড়ি দিয়ে শুরু হল মাটির পথ ধরে হাটা। মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে, কখনো খেতের আইল দিয়ে, কখনোবা গৃহস্থের উঠোন দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। একসময় রাস্তা কঠিন হতে লাগলো। ঝোপ-ঝাড়, বুনো পথ পাড়ি দিতে দিতে একসময় পাহাড়ি ঝিরি ধরে এগুতে লাগলাম। পাহাড়ি ঢলের খরস্রোতা পানিপথ পাড়ি দিতে হল তিনবার, হাতে হাত ধরে শিকল গড়ে আমরা প্রতিটি বাঁক পাড়ি দিলাম। কি ভয়াবহ স্রোতের টান, পায়ের নীচে বড় বড় পাথর। স্রোতের ধাক্কায় বেশ কয়েকবার টাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে বেঁচেছি আমরা। 
আমরা প্রায় দশজনের দল বাকীদের থেকে পিছিয়ে পড়ি অনেকটা। পথে বুনে ঝোপ-ঝাড় পাড়ি দেয়ার সময় আমাদের বিভিন্নজন আক্রান্ত হই বুনো জোঁকের দ্বারা। বহু চরাই-উতরাই পাড়ি দিতে দিতে এগুতে থাকি খইয়াছড়ি ঝর্ণার দিকে। পথে বিভিন্ন জনবসতি পড়েছে, সেখানকার মানুষরা জানালো পাহাড়িঢল নেমেছে, আমরা যেন ঝরনায় না যাই। তারপর এগুতে থাকি। চতুর্থ পাহাড়ি ঢলের ঝিরিপথ পাড়ি দিচ্ছিলাম আমরা, তখন উপর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ পেলাম, আমাদের অগ্রবর্তী দল ফিরে আসছে। ঝর্ণা আর মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ, এই দূরত্বে আমাদের যাত্রা বন্ধ করতে হল। পঞ্চম এবং শেষ পাহাড়ি ঢলটি ছিল প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী। স্রোতের টান এতই ভয়াবহ ছিল যে, প্রায় দশ-পনের জনের মানব বন্ধন তৈরি করেও পাড়ি দেয়া যাচ্ছিলোনা। আমাদের দলনেতা রবিউল হাসান মনা সহ আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ ট্র্যাকার অভিমত দিলেন তাদের ১২-১৫ বছরের ট্র্যাকিং জীবনের অভিজ্ঞতায় তারা কোন ঝর্ণার ঝিরিপথে এমন স্রোতের মুখোমুখি হননি। তাই কিছুটা হতাশা নিয়ে আমরা ৫০ জনের দল ফিরতি পথ ধরি।
ফিরে এসে গ্রামের পুকুরে এবং পার্শ্ববর্তী বসতবাড়িতে গোসল সেরে আমরা বিকেলবেলা লাঞ্চে যাই একটি রোড সাইড লোকাল হোটেলে। একটি কথা বলা হয় নাই, ফিরতি পথে সবার মাঝে ছিল জোঁক আতঙ্ক। একে একে অনেকের শরীরে পাওয়া যাচ্ছিল জোঁকের আক্রমনের চিহ্ন। দুই জনের প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। একজনের অবস্থা ছিল খুবই সিরিয়াস। সবশেষে বিকেল ছয়টার দিকে ঢাকা অভিমুখে রওনা দিয়ে রাত সাড়ে বারটা নাগাদ ঢাকায় এসে পৌছাই। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, গত সপ্তাহে যেমন মিস করেছি রিজুক ঝর্ণায় পৌঁছেও ঝর্ণায় ভেজার আনন্দ থেকে, তেমনি এবার এত কষ্ট উপেক্ষা করে এত কাছে পৌঁছেও দর্শন হয় নাই দেশের এই অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে। ইনশাল্লাহ আগামীতে কোন একদিন তার দর্শন হবে।

গল্পের ছবিসকল


ভ্রমণকালঃ ৩০ জুন, ২০১৩

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ