সদ্য তখন পেরিয়েছি কলেজ জীবন, এলাকার বন্ধুবান্ধবের দল প্রায়ই এখানে সেখানে বেড়াতে যাই। ঠিক সেই সময়ে একটা প্ল্যান ছিলো বিরিশিরি যাওয়ার আরেকটা ছিলো গাড়ো পাহাড় ভ্রমণের। তো গাড়ো পাহাড়ের জন্য হালুয়াঘাট পর্যন্ত গিয়েও যাওয়া হয় নাই, দলের সবার অসহযোগীতা এবং বিরোধীতায়, সেই গল্প আরেকদিন হবে। আর বিরিশিরি যাওয়ার প্ল্যান ছিলো বাল্যবন্ধু মনা’র সাথে। তবে মজার ব্যাপার তখন যাওয়া না হলেও প্রায় পনেরো বছর পর বিরিশিরি গেলাম সেই মনা এবং তাদের ভ্রমণ সংগঠন “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর সাথে।
বিরিশিরি ভ্রমণমনার বিয়ের পর মনে হয় মাস খানেক সময় পার হয়েছে, মনার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী মিনি’কে নিয়ে গেল সেই ট্যুরে। প্রায় আঠারো জনের একটা দল ছিল সব মিলিয়ে। আমরা লালবাগ হতে মনা, মিনি, টুটুল ভাই সহ কয়েকজন সরাসরি চলে গেলাম মহাখালী টার্মিনাল। আমি বাসা হতে নাস্তা না করে বের হয়েছিলাম, দলের বেশীরভাগ সদস্যই নাস্তা করে এসেছে; ফলে আমি মহাখালী বাস টার্মিনাল এর ভেতর চায়ের দোকানে গিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। সাড়ে আটটা নাগাদ এক এক করে দলের প্রায় ১২ জনের মত জড়ো হলে বিরিশিরিগামী বাসে করে আমরা রওনা হয়ে গেলাম বিরিশিরি’র উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যে আমাদের দলের সাথে কামাল ভাই, তুহিন ভাই এবং মেজবাহ ভাই যোগ দিলেন, তাদের সাথে সেটাই ছিলো প্রথম ভ্রমণ। বাস টার্মিনাল হতে বের হয়ে তেমন কোন জ্যামে আটকালো না, তবে টঙ্গী পার হওয়ার পর গাড়ীর গতি কমে এলো। আর ময়মনসিংহ রোডের অবস্থা তখন খুবই বাজে, ফলে “যত ঝাঁকি, তত নেকী” থিওরিতে আমরা দুপুরের পর পৌঁছে গেলাম বিরিশিরি। আগে থেকেই ভ্রমণ বাংলাদেশের স্থানীয় পরিচিত এক বড় ভাই, বাদল ভাই, আমাদের জন্য একটা টিনশেড এর চার রুমের কটেজ ঠিক করে রেখেছিলেন। আমরা প্রথমে বাস হতে নেমে বাদল ভাই এর রেস্টুরেন্ট দুপুরে খাবার সেরে নিয়ে চলে এলাম সেই কটেজে।
কটেজে এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে সবাই শেষ বিকেলে বের হলাম আশপাশটা ঘুরে দেখতে। গ্রাম্য পথ ধরে নদীর তীর আমাদের উদ্দেশ্য, গল্প আর হাসি ঠাট্টায় হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে আঁধার নেমে জানান দিলো সন্ধ্যার। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে কিছুটা দূরে একটা বটগাছের পাতার ফাঁকে কিছু আটকে আলো আঁধারীতে অনেকটা গাছে ঝুলে থাকা মানুষের অবয়ব তৈরী করেছিলো। মনার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী মিনি’কে সেটা ভূত বা কোন খারাপ আত্মা হতে পারে বলায় সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। হঠাৎ দেখা গেল সে সত্যিকার অর্থেই কান্না করে দিয়েছে। আসলে সে এরকম দল বেঁধে ঘোরাঘুরির মানুষ না, কিন্তু বিয়ে করেছে এক চির বাউন্ডুলে মনা’কে; যার প্রধান কাজ হচ্ছে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো। বেচার অনেকটা পথ হেঁটে ছিলো ক্লান্ত, আর সত্যি সে ভীষণ ভয়
পেয়েছিলো সেই সন্ধ্যাক্ষণে; যদিও পরবর্তীতে সে ভয়ের ব্যাপারটা সহজে স্বীকার করতে চায় নাই।
যাই হোক সেখান থেকে আমরা আমাদের কটেজে ফিরে এসে রাতে তেমন কিছু করার ছিলো না। আমি, মহি, মনির, সোহেল আমরা কটেজের সামনের খোলা মাঠে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম, পরে কটেজের সামনের বারান্দায় সবাই মিলে গল্প হল জম্পেশ। রাত নয়টার আগে আগে আমরা আবার চলে গেলাম বাদল ভাই এর কটেজে। রাতের খাবার খাওয়ার পর এবার ঘুমানোর পালা। কিন্তু এতো দ্রুত কি আর ঘুম আসে, তাই ছোট ছোট দলে নিজেরা নিজেদের মত করে সময় কাটাতে লাগলাম।
দলের সাথে নিয়ে আসা হয়েছে কয়েকটা তাবু। পর্যাপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও তাবু পিচ করা হলো, কারণ আমার মত কয়েকজনের ভূত চেপেছে তাবুতে থাকতে হবে। তাবু টাঙ্গিয়ে আমরা গল্প করছিলাম, রাত দশটার পরে দেখি টুটুল ভাই কটেজ হতে টর্চ নিয়ে কোথাও যাচ্ছে, তাকে জিজ্ঞেস করতে জানলাম দলের সর্বশেষ সদস্য তাহসিন এর বন্ধু মারুফ ঢাকা থেকে একা এসেছে, যদিও তার স্ত্রী দলের সাথেই সকাল বেলা চলে এসেছে, অফিসের কাজে বেচারা শেষ মুহুর্তে আটকে পড়েছিলো। সে বাসে করে এসেছে, তাকে রিসিভ করতে টুটুল ভাই এর সাথে কটেজ হতে কিছু দূরে মূল রাস্তার উপর একটা কালভার্টে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। অল্প কিছু সময় পরই মারুফ এর বাস আমাদের দেখে ব্রেক করলো এবং মারুফকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা কটেজে ফিরে যার যার রুমে চলে গেলাম, পরের দিন সারাদিন সাইট সিয়িং ট্যুর, তাই ঘুমাতে হবেই।
পরদিন ভোর বেলাই ঘুম ভেঙ্গে গেল, ঘুম থেকে উঠে দেখি কামাল ভাই, তুহিন ভাই আর মেজবাহ ভাই নিজেদের মত করে তৈরী হয়ে বের হচ্ছে, সাথে ক্যামেরা। আমি কটেজের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসলাম, ধীরে ধীরে সবাই ঘুম থেকে উঠে একে একে তৈরী হয়ে নিলে সবাই মিলে সকালের নাস্তা সেরে রওনা দিলাম বিজয়পুর এর চীনামাটির পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই আমরা রিকশাযোগে চলে এলাম সোমেশ্বরী নদীর তীরে। এখানে এসে খেয়া পার হলাম, যদিও নদীতে তেমন পানি নেই, হাঁটু পানি হবে, দুয়েক জায়গায় হয়তো এর চাইতে বেশী থাকতে পারে। নুড়িবালুর কারনে নদীর তলদেশ বেশ এবড়ো থেবড়ো, তাই গভীরতার এই তারতম্য দুয়েক জায়গায়। রিকশা সহ নদী পার হয়ে আমরা ফের রিকশা করে চলে গেলাম বিজয়পুরের চীনা মাটির পাহাড়ের দিকে।
দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বিজয়পুরে সাদা মাটি অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতির সম্পদ হিসেবে সাদা মাটির অন্যতম বৃহৎখনিজ অঞ্চল এটি। ১৯৫৭ সালের দিকে সর্বপ্রথম এখানে চীনা মাটি তথা সাদা মাটির খনিজ সন্ধান পাওয়া যায়। ছোট বড় টিলা, পাহাড় এবং সমতল ভূমি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই খনিজ এলাকার দৈর্ঘ প্রায় ১৫ কিলোমিটারের মত। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম এখান থেকে সাদামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩ শত বৎসরের চাহিদা পুরণ করতে পারে।
রঙিন নানান বর্ণের ছোট ছোট পাহাড়গুলো খনন করার পর মাঝে সৃষ্ট গর্তে পানি জমে নীল স্বচ্ছ পানির লেক এর মত তৈরী হয়েছে যা দেখতে সারা বছর দেশী-বিদেশী পর্যটক এখানে ছুটে আসেন। আমরা সেখানে পৌঁছে আমাদের নিজেদের মত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে দেখতে লাগলাম। কেউ কেউ ঢাল বেয়ে উঠে গেল পাহাড়ের উপরে, কেউ বা আমার মত গাছের ছায়া দেখে সবুজ ঘাসের উপর বসে গেল। যেহেতু আমাদের কোন তাড়া নেই, তাই নিজেদের মত করে সময় কাটাতে লাগলাম।
গল্পের ছবিসকল
ভ্রমণ বাংলাদেশ দল চীনামাটির পাহাড়ের পাশে
ভ্রমণ বাংলাদেশ দল চীনামাটির পাহাড়ের পাশে
সোমেশ্বর নদী
বিরিশিরি ২০১৩ ট্যুরে আমাদের আবাসস্থল
চীনামাটির পাহাড়ের উপরে আমরা
চীনা মাটির খনিস্থ নীল জলের লেক
চীনা মাটির পাহাড় এবং এর নীল জল
দলের ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে সোমেশ্বরি'র তীরের বালুকাবেলার
মন্তব্যসমূহ