বিরিশিরি ভ্রমণ - সোমেশ্বরী নদীতে জলকেলি

বিরিশিরি ভ্রমণ - সোমেশ্বরী নদীতে জলকেলি

গল্পের ছবিসকল

  • অপরাহ্ণ'র সোমেশ্বরী
  • সন্ধ্যা লগণে সোমেশ্বরী নদীর তীর
  • হেঁটে চলা, দলের সাথে
  • কবি রফিক আজাদের তৈরী গাছের উপর বাঁশ খড়ের ছাউনি দেয়া বসার ঘর
  • আকাশ ভরা চাঁদের আলো
  • বারবিকিউ নাইট
  • ভ্রমণ বাংলাদেশের দল নদীর পাড়ে
  • 'বালু বাবা'-সেরকম মাস্তি
চীনা মাটির পাহাড় দেখে আমরা এবার রওনা হলাম বিরিশিরি বিজিবি ক্যাম্প এর উদ্দেশ্যে। সেখান হতে সোমেশ্বরী নদীর দৃশ্য এবং নদীর অপর পাড়ে পাহাড়ি ভারতীয় মেঘালয় রাজ্যের ভুখন্ডর পাহাড়ি জনপদ চোখে পড়ে। এখানে এসে আমরা জুম্মার নামাজের জন্য স্থানীয় মসজিদে চলে গেলাম ছেলেরা, মেয়ের দল নদীর তীরে গাছের ছায়ায় বসে গল্প জুড়ে দিলো। নামাজ শেষে সবাই আশেপাশে ঘুরে দেখলাম। নদীর ঘাটে একটা বিজিবি’র ট্রলার করে কয়েকজন অফিসার আসলো কোথাও থেকে। ইচ্ছে হচ্ছিলো তাদের সেই বোট নিয়ে এই সোমেশ্বরী নদীর উৎসমুখে চলে যাই, তারপর সেখান হতে নদীপথে একেবারে সোমেশ্বরী হয়ে কংস পাড়ি দিয়ে নেত্রকোনা শহরের ঘাটে গিয়ে নামি। কিন্তু চাইলেই তো আর সব ইচ্ছে পূরণ হবে না, এখানে শুধুমাত্র বিজিবি’র বোটই চলে, স্থানীয় নৌকা বিজিবি ক্যাম্প পাড়ি দিয়ে উপরের দিকে আর যায় না। 
বিরিশিরি ভ্রমণ বিরিশিরি ভ্রমণ এই নদীর উৎসমুখ ভারতের মেঘালয় রাজ্যে; ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। সেখান হতে মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড় এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সোমেশ্বরীর মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোন মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ীয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয় ভাবে শিবগঞ্জ ঢালা নামে খ্যাত। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। এ স্রোতধারাটি চৈতালি হাওর হয়ে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে কংশ নদী সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে পাহাড়ীয়া ঢলে আত্রাখালি নদী নামে সোমেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদীটির সৃষ্টি হয়। সুসঙ্গ দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে আত্রাখালী। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আত্রাখালি নদী এখন বেশ খরস্রোতা। 
বিরিশিরি ভ্রমণ বিরিশিরি ভ্রমণ আমরা সেখান হতে দুপুরের খাবার স্থানীয় হোটেলে সেরে নিয়ে বিকেলবেলা ফিরে এলাম আমাদের ডেরায়। ফেরার পথে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ এবং হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধতে ছবি তুললাম সবাই। 
আর হ্যাঁ, আরেকটা অন্যরকম জিনিষ দেখলাম। কবি রফিক আজাদ ১৯৯৭ সালে ‘বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল অ্যাকাডেমি’র প্রধান পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে বিরিশিরি আসেন। এখানে উনি দায়িত্বে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। গারোপাহাড়ের সানুদেশেই মধুপুর গড়, চুনিয়া, পাশে গুণি গ্রাম – রফিক আজাদের জন্মও এখানেই। দায়িত্বে থাকা কালে উনি বেশ কিছু কাব্যিক কাজ করেছিলেন, তার একটি আমরা দেখলাম একটা গাছের উপর বাঁশ খড়ের ছাউনি দেয়া বসার ঘরের মত ছোট্ট করে তৈরী করা একটা স্থাপনা। এখানে বসে কবি রফিক আজাদ কবিতা লিখেছেন বলে জানা গেল। 
কটেজে ফিরে সন্ধ্যার পর আয়োজন চললো বার-বি-কিউ এর। আগে থেকেই সকল সরঞ্জামাদি নিয়ে আসা হয়েছিলো, আর বাদল ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট মুরগী মেরিনেট করে রাখা ছিলো। সাতটা নাগাদ ধরানো হল আগুন, কয়লা লাল হতে সেখানে সপে দেয়া হল মশলা মাখা মাংসের টুকরোগুলোকে। বেশ সময় নিয়ে মনার তত্ত্বাবধানে বারবিকিউ রেডি হলে বাদল ভাই এর রেস্টুরেন্ট থেকে চলে এলো পরাটা এবং সালাদ, সাথে ছিলো বুটের ডাল। জম্পেশ খানাপিনা শেষে পুরো কটেজের বাতি নিভিয়ে দিয়ে চাঁদের আলোয় চললো গল্প, কেউ কেউ ধরলো সুরেলা গলায় প্রিয় কোন গান। আকাশে পূর্ণ চাঁদ না থাকলেও আমাদের উৎসাহে পূর্ণতার কমতি ছিলো না। গান-গল্প’র পাশাপাশি ছিলো নানান রকম খুনসুটি আর দুষ্টুমি ভরা যত কৌতুক কথন। এভাবে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত চললো আমাদের সেদিনের আসর। এরপর আসতে আসতে দল ছোট হতে লাগলে একসময় আমিও ঘুমাতে গেলাম। 
বিরিশিরি ভ্রমণ বিরিশিরি ভ্রমণ পরদিন আমাদের দুপুরের শেষ বাস ধরে ঢাকা ফিরতির পালা। এর আগে সকালে নাস্তা শেষে বের হলাম সোমেশ্বরী তীরে। সেখানে গিয়ে টুটুল ভাই তার ঢাকা থেকে আনা বিশাল ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন করলেন, আমরা সবাই সোৎসাহে তাতে যোগ দিলাম। এরপর আমি তাহসিন সোহেল মহি মারুফ নেমে পড়লাম এক এক করে হাঁটু জলের নদীতে। একটু গভীরতার খোঁজে এগিয়ে গেলাম মাঝখানে। কোথায় কি, নদীর মাঝখানে ছোট্ট একটা চরের মত একখন্ড জমিত বসে পড়লাম। চললো দুষ্টুমি, আর সেই পথধরে আমাকে দেয়া হল বালিচাপা। বালির মাঝে গর্ত করে আমাকে শুইয়ে দিয়ে চললো বাঁদরামি। এক সময় আমার একটা নামও দেয়া হল, “বালু বাবা!”। আমাদের দলে এক সময় যোগ দিলো মহি পত্নী নুপুর এবং জুবায়ের ভাইও। মন খুলে আনন্দ করলাম সবাই মিলে। বাকীদের প্রতিও হাতছানি দিয়েছি জলে ভেজার, কিন্তু হাতছানি দূর্বল ছিলো বলেই প্রতীয়মান হয়েছিলো; কেননা আর কেউ সেই ডাকে সারা দেয় নাই। 
অনেকটা সময় এসব দুষ্টুমি করে ফিরে এলাম কটেজে। গোসল শেষে তৈরী হয়ে নিলাম প্রস্থানের জন্য, ব্যাগপত্তর ঘুছিয়ে ফেলে বেলা সাড়ে বারোটার দিকে আমরা বাদল ভাই এর রেস্টুরেন্ট গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ একটু আগেই সেরে নিলাম। ফিরতে হবে সেই ভয়ংকর খারাপ রাস্তা ধরে, ঝাঁকি-নেকী’র দোলায় দুলে… ভাবতে মন খারাপ হয়ে গেল। আমার রয়েছে আবার ব্যাক পেইন এর সমস্যা। তো কি আর করা, প্রায় দেড় যুগের আক্ষেপ ঘুচিয়ে অবশেষে বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘বিরিশিরি ভ্রমণ’ সম্পন্ন করে দুপুর দুইটার দিকে রওনা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজলো, কেননা মহাখালী হতে বাসায় ফিরতে অনেকটা পথ জ্যাম ঠেলে ফিরতে হয়েছিলো।  

ভ্রমণকালঃ ২১-২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩



আগের পর্ব

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ