কাশ্মীর বেড়াতে যাব শুনে পরিচিত সবাই কাশ্মীর থেকে শাল আনার জন্য বলতে লাগলো। নেটে ঘাটাঘাটি করে খোঁজ করা শুরু করলাম কি কেনা যেতে পারে কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়ে। কিছুক্ষণ খোঁজখবর করতেই মাথা ঘুরে গেল। সবার মুখে যে “পশমিনা শাল” এর এতো নাম শুনেছি, সেই পশমিনা শাল এর আকাশ ছোঁয়া মূল্য। বেশ কয়েকজন কাশ্মীর থেকে শাল আনাতে চেয়েছিল, তাদের মূল্য বলতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তবে আমি মোটামুটি খোঁজখবর করে সকল ভ্রমণসাথীকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, কি কি শপিং করা যেতে পারে, কোথা থেকে, কেমন মূল্য হবে ইত্যাদি। যাই হোক, মজার ব্যাপার হল, সবাইকে যেমন নির্দেশনা বা পরামর্শ দেয়া হয়েছিল সবাই তার বিপরীত কাজগুলো করেছে বেশীরভাগ সময়।
আমরা কাশ্মীর গিয়েছিলাম কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে জম্মু দিয়ে। কলকাতা থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পরেরদিন সকালে দশটার পরে পৌঁছই দিল্লী। দিল্লী থেকে দুপুর তিনটার পরে আমাদের ট্রেন, জম্মুর উদ্দেশ্যে। মাঝখানের সময়টুকুতে আমাদের পরিকল্পনা ছিল দিল্লীর বিখ্যাত “লাল কেল্লা” এবং “কুতুব মিনার” ঘুরে দেখার। দিল্লী পৌঁছে ষ্টেশনের লকারে সবার লাগেজ রেখে মেট্রো ষ্টেশনে গিয়ে সবাই মেট্রো যোগে এসে নামলাম কুতুবমিনার ষ্টেশনে।
সেখানে থেকে অটোরিকশা যোগে কুতুবমিনার রওনা হলাম। পথিমধ্যে অটোরিকশা এসে থামল সরকারী এক কুটির ও ক্ষুদ্রশিল্পের শো রুমে, নাম “দিল্লী হাট”। আমি চরম বিরক্ত হলাম, হাতে সময় কম, একি যন্ত্রণা! যাই হোক, ড্রাইভারের অনুরোধে আমরা ওখানে থামলাম। এখানে গেস্ট নিয়ে আসলে ওরা নাকি এক লিটার তেল পায়! অন্য একজন বলল, কমিশনও পায়। যাই হোক, সবাইকে বললাম, মিনিট পাঁচেকের চোখের দেখা দেখেই আমরা বের হয়ে যাব এখান থেকে। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর চৌকশ দোকানির পাল্লায় পড়ে আধঘণ্টার উপরে সময় গচ্চা দিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল শপিং করতে। ফলাফল? সেদিন লালকেল্লা দেখা হয় নাই আর :( এখানকার কালেকশন আসলেই ভাল, মূল্য একটু বেশী মনে হয়েছে। জামাকাপড় থেকে শুরু করে গয়না, শো-পিস সবকিছুই এখানে সাজানো রয়েছে।
কাশ্মীর পৌঁছে প্রতিটি স্পট থেকেই সবাই অল্পবিস্তর কেনাকাটা করতে ব্যস্ত ছিল। কেউ কেউ তো ২০০-৩০০ রুপীতে পাশমিনা কিনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে লাগলো। কিন্তু পশমিনা শাল যে আগে দেখে নাই, বা এ সম্পর্কে কোন ধারনা নাই, তাকে কেমনে বুঝাই এই মূল্যে কখনো কোন পশমিনা শাল কেনা অসম্ভব এবং হাস্যকর শোনায়। একটি সেমি-পশমিনা শালের সর্বনিম্ন মূল্য ৩০০০ রুপী’র কাছাকাছি, পশমিনা শাল দশ থেকে বারো হাজার রুপী’র কম নয়। সেখানে ২০০-৩০০ রুপীতে বিভিন্ন টুরিস্ট স্পটে পশমিনা বলে সাধারণ মানের শাল বিক্রয় হচ্ছে, সেগুলো কিনে মহাখুশি অনেকে। আমি আর কিছু বলি নাই, যার যার টাকায় সে কেনাকাটা করছে; আমার কথা বলাটা শোভন দেখায় না। শেষের দিন আমরা গেলাম শ্রীনগর এর গভর্নমেন্ট এম্পরিয়ামে। অনেকটা আমাদের আড়ং টাইপের দোকান, পণ্যের মান খুবই ভাল, এবং দামও একটু চড়া। মূল্যে কিছুটা বেশী দিয়ে হলেও গুণগত এবং মানসম্মত পণ্য পাওয়া যায় এখানে। কয়েকজন এখান থেকে সেমি-পশমিনা শাল কিনল, ৩০০০-৩৫০০ রুপীর মধ্যে।
এগুলোই ছিল সবচেয়ে কম মূল্যের। ট্যুরের শেষ দিন, হাতে সবার টাকা-পয়সা শেষের দিকে। তাই এখান থেকে তেমন কেনাকাটা করা হল না। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড 'সাহিল' তার পরিচিত একটা বড়সড় দোকানে নিয়ে এল। ত্রিতলা এই দোকানের নীচের তলায় কাপড়ের কালেকশন, দ্বিতীয় তলায় জ্যাকেট-সোয়েটার সাথে নানান গহনা, তৃতীয় তলায় শো-পিস সহ আরও নানান সরঞ্জামের সমাহার। এই দোকান থেকেই মূলত আমরা বেশীরভাগ কেনাকাটা করেছিলাম। সাহিলের কল্যাণে আমরা সর্বোচ্চ ত্রিশ শতাংশ মূল্যছাড় পেয়েছিলাম। আসুন দেখি কিছু কাশ্মীরি শালের ছবিঃ
কাশ্মীর শপিং এ আরও ছিল মসলা এবং ড্রাই ফ্রুট। পাহেলগাঁও থেকে গুলমার্গ যাওয়ার পথে একটা দোকানে আমাদের গাড়ী থামল। সাহিলের পরিচিত এই দোকান থেকে সবাই নানান মশলাজাতীয় দ্রব্যাদি কিনেছিল। জাফরান, এলাচ থেকে শুরু করে কালিজিরা মতন একটা মসলা, মধু, অনেক সমৃদ্ধ ছিল এই দোকানের কালেকশন। আর গুলমার্গ থেকে শ্রীনগর আসার পথে আমরা একটা আপেলের বাগান পরিদর্শন করেছিলাম। সেই বাগানে একটা ছোট্ট দোকান ছিল, যা থরেথরে সাজানো ছিল কাশ্মীরের বিখ্যাত নানান ড্রাই ফ্রুট দিয়ে। Dried Blackberries, Salted Pistachio, Dried Figs Anjeer, Kashmiri Walnuts Akhrot, Kashmiri Almonds (Kagzi Badam), Dried Apricots Khurmani, Dried Apple Pulp সহ আরও বেশকিছু নাম না জানা শুকনো ফল। এছাড়া ফলের জুস, জ্যাম-জেলি, আচার, মধু, হারবাল প্রসাধনী এবং সুবিখ্যাত পানীয় “কাহওয়া”। এখান থেকে আমি কিনেছিলাম কেজি চারেক শুকনো ফল আর এক কৌটো “কাহওয়া”।
এগুলো ছাড়া, পাহেলগাঁও এর চান্দানওয়ারি থেকে কিনেছিলাম কিছু কাশ্মীরি ট্র্যাডিশনাল অরনামেণ্ট। আর হাউজবোটে ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালাদের শিকারা হতে হাতে তৈরি গহনার বাক্স, ছোট কয়েন ব্যাগ, মেয়েদের হাতব্যাগ, শো-পিস এসব।
আপনি কাশ্মীর ভ্রমণে গেলে যাই কেনাকাটা করেন না কেন, একটু খোঁজ খবর করে ভাল দোকান থেকে দাম একটু বেশী দিয়ে হলেও ভালো জিনিসটাই কেনার চেষ্টা করবেন। এই ছিল আমাদের কাশ্মীর ভ্রমণের শেষ উপাখ্যান। আগামী পর্বে কাশ্মীর’কে বিদায় জানিয়ে আমরা ছুটবো দিল্লীর পথে, গন্তব্য সিমলা-মানালি।