মুরাপাড়া জমিদার বাড়ীর আঙ্গিনায় (বাংলার জমিদার বাড়ি - পর্ব ১৭)



ঢাকার খুব পাশেই অবস্থিত এই জমিদার বাড়ীটি’র মত টানা লম্বাটে জমিদার বাড়ী আমি খুব কম দেখেছি। অনেকটা উনিশ শতকের ইউরোপীয় বিল্ডিংগুলোর মত, দেখলেই অনেক সিনেমায় দেখা বিভিন্ন ভবনের কথা মনে পরে যায়। মাস দুয়েক আগে নারায়ণগঞ্জ হান্টের লিস্টে ছিল এই মুরাপাড়া জমিদার বাড়ী, ভ্রমণ শুরুই করেছিলাম এই জমিদার বাড়ী দিয়ে। 

সকালের নাস্তা গুলিস্তানের রাজধানী হোটেলে সেরে নিয়ে বাস ধরলাম পুলিশ বক্সের কাছ থেকে। গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জগামী বাসে উঠে নেমে পড়তে হবে রূপসা বাস স্ট্যান্ডে। এখানে একটি ব্যাপার বলে রাখি, নারায়ণগঞ্জের মোগরাপাড়া বলে আরকেটা স্থানের বাস যায় হকি স্টেডিয়াম এর নিকট থেকে, সেটা কিন্তু মুরাপাড়া নয়। মোগরাপাড়া যেতে হবে আপনি যখন ঐতিহ্যবাহী পানাম নগরী ভ্রমণে যাবেন। যাই হোক, রূপগঞ্জগামী বাসে করে রূপসা নেমে সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় করে চলে গেলাম মুরাপাড়া জমিদার বাড়ী, যা বর্তমানে মুরাপাড়া ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 


পিচ ঢালা রাস্তা হতে কম্পাউন্ডে ঢুকতেই প্রথমে হাতের বাম পাশে চোখে পড়বে জিউর মন্দিরটি, ভগ্নাবস্থায় এখনো টিকে আছে এটি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনি অবশ্যই এই মন্দিরের কাছে দাঁড়িয়ে পড়বেন। এখান থেকে আরেকটু এগিয়ে গেলে পড়বে একটি পুকুর, যার পেছনে টানা দাঁড়িয়ে রয়েছে মুরাপাড়া জমিদার বাড়ীটি। সেদিন শুক্রবার থাকায়, কলেজ বন্ধ ছিল, ফলে ফাঁকা জমিদার বাড়ীর প্রাঙ্গনে আমরা এগিয়ে গেলাম পুকুর ঘিরে থাকা কাঁচা পায়ে হাঁটার রাস্তা ধরে। 




(কচুরিপানায় ঢেকে গেছে পুরো পুকুরটি) 

১৮৮৯ সালে জমিদার প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জি ৪০ হেক্টর জমির উপর নির্মাণ শুরু করেন এই জমিদার বাড়ীটি। ১৮৯৯ সালে তার ছেলে বিজয় চন্দ্র এর প্রাথমিক পর্যায়ের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। বিশাল এই জমিদার বাড়িতে প্রায় একশত’র উপরে কক্ষ রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোতেই পাবেন কারুকার্যের ছোঁয়া। এই জমিদার বাড়ীতে রয়েছে কাছারিঘর, অতিথিশালা, নাচঘর, পুজা মণ্ডপ, বৈঠকখানা, ভাঁড়ার সহ বিভিন্নভাগে ভাগ করা অংশ। 



ইতিহাস খোঁজ করে জানা যায়, জমিদার বাবু রাম রতন ব্যানার্জী তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং জমিদারদের ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠ পুরুষ। তিনি ছিলেন নাটোরের রাজার এক বিশ্বস্ত কর্মচারী। তার সততার পুরস্কার হিসেবে তিনি মুড়াপাড়া এলাকায় বেশকিছু জায়গির সম্পত্তি লাভ করেন। 


বাবু রাম রতন ব্যানার্জী মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। রাম রতন ব্যানার্জীর পুত্র পিতাম্বর ব্যানার্জী এবং তৎপুত্র প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জী শাহজাদপুরের জমিদারি ক্রয় করে জমিদারি বর্ধন করেন। কথিত আছে, জমিদারি ক্রয় সূত্রে প্রতাপ ব্যানার্জীর সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। ১৮৮৯ সালে প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পৈতৃক এজমালি পুরনো বাড়ি ত্যাগ করে আলোচ্য এ প্রাসাদের পেছনের অংশ নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। 


প্রতাপ চন্দ্র ব্যানার্জীর পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী ১৮৯৯ সালে প্রাসাদের সম্মুখ অংশের একতলা ভবন নির্মাণ ও সেখানে ২টি পুকুর খনন করার পর হৃদরোগে মারা যান। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জীর দুই সুযোগ্য পুত্র জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও আশুতোষ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৯০৯ সালে প্রাসাদটির দোতলার কাজ সম্পন্ন করেন। 


এ অঞ্চলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। কারণ তিনি দু’বার দিল্লির "কাউন্সিল অব স্টেট"র পূর্ববঙ্গ থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রজা সাধারণের কল্যাণসাধনের জন্য স্থাপন করেছেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পুকুর। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। ফলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর প্রতাপশালী সেই রাজবাড়িটি বিরান হয়ে যায়। 


এরপর ১৯৪৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। তৎকালীন সরকার এখানে একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। কিছুকাল এটি কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পরে ১৯৬৬ সালে এখানে হাইস্কুল ও কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 


(এভাবেই ইতিহাসের দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়াবে এক হারানো জমিদারের স্মৃতিগাঁথা) 

এখনো টিকে থাকা জমিদার বাড়ীগুলোর মধ্যে ঢাকার খুব কাছেই রয়েছে বেশ কয়েকটি যার মধ্যে এই মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ীটি অন্যতম। জমিদার বাড়ির মূল ভবনটিই কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার পাশে ১৯৯৫ সালে আরও একটি প্রশাসনিক ভবন নির্মিত হয়। আরও অনেক জমিদার বাড়ী’র মত এটিও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের দেশের বেশীরভাগ জমিদার বাড়ীর চাইতে তুলনামুলক ভালো অবস্থায় রয়েছে এই জমিদার বাড়ীটি। কিন্তু কষ্ট করে মূল ভবনের পেছন দিকে চলে গেলে দেখবেন কিভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে এই জমিদার বাড়ীটিও। 



জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ। 




যে কোন ছুটির দিনে বেড়িয়ে পড়তে পারেন এই জমিদার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। এখান থেকে বেড়িয়ে চলে যেতে পারেন নারায়ণগঞ্জের অন্য যে কোন দর্শনীয় স্পটে। সেটা হতে পারে পানাম নগরী, হাজীগঞ্জ আর সোনাকান্দা দুর্গ। ভালো একটা ছুটির দিন উপভোগ করতে বেড়িয়ে পড়ুন খুব শীঘ্রই। 


Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ