কুল্লু মানিকারান ভ্রমণ
মানালি শহরে আগের রাতে পৌঁছে তেমন আর ঘোরাঘুরি করা হয় নাই। সকালবেলা একটু দেরী করেই আজ ঘুম থেকে উঠলাম, আজ সাত-সকালে দৌড়ঝাঁপ করার হ্যাপা নেই। ফ্রেশ হয়ে রুমে তালা দিয়ে নীচের হোটেল রিসিপশনে নেমে দেখি দলের বাকীরা বসে আছে। আমি যেতেই ডাইনিং এ নাস্তা দিল, এর ফাঁকে হোটেলের ম্যানেজার জানাল গতকাল রাতে প্রথম পাহাড় চুড়োয় এবারের সিজনে বরফ পড়েছে এবং তা আমাদের হোটেলের সামনে হতে দেখা যাচ্ছে। আমি নাস্তার টেবিল থেকে উঠে বাইরে এলাম, হ্যাঁ ঐ তো হোটেলের রাস্তা ধরে দিগন্তে আকাশের কাছে যে পাহাড় চুড়ো, তার উপর সাদা বরফের চাদর বিছানো। যদিও সাইজে ছোট চাদর, তবুও বরফ তো পাওয়া গেল, হোক না দূরে। সেই কাশ্মীর থেকে দলের সবাই বরফ নিয়ে চিন্তিত। আমি তো মাঝে মাঝে ফাজলামো করে বলছিলাম, ঢাকায় গিয়ে ফ্রিজ খুলে যত ইচ্ছে বরফ দেখে নিয়েন। গুলমার্গ গণ্ডোলা করে আফারওয়াত পিকে গেলে বরফ পেতাম, কিন্তু আমরা যখন কাশ্মীরের গুলমার্গ গেলাম, তখন গণ্ডোলা তথা ক্যাবল কার বন্ধ, রিপেয়ার এন্ড মেইনটেনেন্স এর জন্য। যাই হোক, আমরা নাস্তা শেষ করতেই দেখি বিপিন (আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড) তার গাড়ী নিয়ে হাজির। আমাদের আজকের গন্তব্য মানিকারান, কুলু ভ্যালী হয়ে মানিকারান যাব, উষ্ণ প্রস্রবণ ঘিরে গড়ে ওঠা একটা ধর্মীয় তীর্থক্ষেত্র দেখতে।
হোটেল থেকে বের হয়ে সেই মায়াবী পাহাড়ি পথে পড়ল আমাদের গাড়ী, মিনিট দশেকের মধ্যেই। মাঝখানে বিয়াস নদী রেখে আমরা এগিয়ে চললাম একপাশ দিয়ে পাহাড়ি উপত্যকার জেলা কুলু দিয়ে। পুরো কুলু থেকে মানিকারান পর্যন্ত রাস্তাটা এতো বেশী সুন্দর ছিল যে, আমি খুব উপভোগ করেছি এর সৌন্দর্য। অদ্ভুত সুন্দর, শান্ত, মায়াময়, কেমন একটা ঝিমুনি ধরে যায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে। ও আচ্ছ, ভাল কথা বলে নেই, মানালি হতে মানিকারান যাওয়ার পথে আমরা কুলু ভ্যালীতে কিছুটা এডভেঞ্চার করে নিলাম, আধঘণ্টার একটা বোট রাফটিং, পাহাড়ি পাথুরে নদী বিয়াসের হিমশীতল জলে। সেই গল্প আগামী পর্বে না হয় করা যাবে। এখন চলেন এগিয়ে যাই মানিকারানের দিকে।
মানিকারান মূলত পার্বতী নদীর তিরে অবস্থিত পার্বতী নামক গ্রামে অবস্থিত একটি তীর্থকেন্দ্র যা মূলত গড়ে উঠেছে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ’কে কেন্দ্র করে। হিমাচলের কুলু জেলার ভুনতার এলাকার উত্তর পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম ভুনতার। মজার ব্যাপার হিমাচল প্রদেশে কিন্তু ভুনতার নামে একটা চেইন আউটলেট আছে আমাদের আড়ং টাইপের। চারিদিকে চিরহরিৎ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা এই এলাকা শীতে শুভ্র বরফের চাদরে ঢেকে যায়। আর এই শান্ত প্রকৃতির মাঝে রয়েছে প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়, শীতে কাবু এলাকায় সারাবছর প্রবাহমান এক উষ্ণ প্রস্রবণ। আর এই প্রস্রবণ’কে ঘিরে হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ গড়ে উঠেছে।
প্রচলিত মিথ অনুসারে, ভগবান শিব এবং পার্বতী, একদিন পাহাড়ঘেরা সবুজভূমি অতিক্রম করছিলেন। সেখানকার সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তারা সেখানে কিছু সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। বিশ্বাস করা হয় যে, তারা এখানে প্রায় এগারো শত বছর অতিবাহিত করেছিলেন!!! যাই হোক, ঐ সময়ে পার্বতী তার কানের একটা দুলের মুক্তো, যা “মানি’ নামে পরিচিত, হারিয়ে ফেলেন এখানকার জলে। তিনি হতাশ হয়ে শিব’কে তা খুঁজে দিতে বললে, তিনি তার অধস্তনদের আদেশ দেন সেই “মানি” খুঁজে দিতে। যাই হোক, তারা ব্যর্থ হয় তা খুঁজে পেতে। শেষে শিষনাগ নামক দেবতা ঐ এলাকার পানিকে উদ্বেলিত করে তোলেন ফুটন্ত পানির ন্যায়। আর এই রূপকথা থেকে এই এলাকার নাম হয়েছে মানিকারান। বলা হয়ে থাকে, এখানে দর্শন দেয়ার পর আলাদা করে আর কারো কাশী দর্শন করার দরকার নেই। বিশ্বাস করা হয়, এখানকার পানির রয়েছে ঔষধি এবং রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। এখানে দুটি মন্দির রয়েছে, একটি শিব মন্দির, অন্যটি রামচন্দ্র মন্দির।
শিখ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, গুরু নানক দেব ১৫৭৪ বিক্রামি পঞ্চিকা বর্ষে মানিকারান আসেন, সাথে ছিলেন ভাই বালা এবং ভাই মারদানা। এই মানিকারান অতিক্রম করার সময় ভাই মারদানা তীব্র ক্ষুধার্ত হন, কিন্তু তাদের কাছে কোন খাবার ছিল না। গুরু নানক, ভাই মারদানা’কে স্থানীয় লঙ্গরখানার দিকে পাঠালেন। স্থানীয় লোকেরা তাদের আটা দান করলেন রুটি তৈরি করে খাবার জন্য। কিন্তু সমস্যা হল সেখানে কোন আগুন ছিল না রান্না করার জন্য। গুরু নানক দেব, তখন মারদানা’কে একটি পাথর ইশারা করে তা সরিয়ে ফেলতে বললেন। ভাই মারদানা সেটা সরাতেই সেখান দেখতে পেলেন একটা উষ্ণ পানির ধারা প্রবাহমান। মারদানা সেই উষ্ণ প্রস্রবনে আটার কাই দিয়ে তৈরি চাপাতির দলা সেখানে ধরলেন রুটি তৈরির জন্য। কিন্ত মারদানা অসাবধানতার কারনে সেই দলা সেখানে ডুবে গেল। তখন গুরু নানক দেব তাকে বললেন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে বললেন যে, যদি চাপাতির দলা সেখান থেকে ভেসে উঠে, তবে একটা চাপাতি সে ভগবানের নামে উৎসর্গ করবে। মারদানা যথারীতি প্রার্থনা করল, এবং সত্যি সত্যি সেখানে সেই আটার চাপাতির দলা ভেসে উঠল। এই ঘটনা’কে কেন্দ্র করে মানিকারানে গড়ে উঠেছে একটি শিখ গুরুদুয়ারা।
হিন্দুদের শিব মন্দির আর শিখদের গুরুদুয়ারা, একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো। উষ্ণ প্রস্রবণের উপর স্থাপনা দুটি অবস্থিত। জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়ে বলে, যারা ভেতরে গেছে, তারা টের পেয়েছে কি প্রচণ্ড উত্তাপ সেই জলধারার। ভেতরে পবিত্র জল পান করার ব্যবস্থা আছে, আছে বিশ্রাম, পুজো, আহারের ব্যবস্থাও। আমি আর ভেতরে না গিয়ে আশেপাশে খোঁজ করতেই দেখি, গাড়ী যেখানে পার্ক করা হয়েছে, সেটি একটি পাঁচতলা ভবন। দিলাম ভোঁ দৌড়, উপরে উঠে অসাম ভিউ পেলাম, অনেক ছবি তুললাম, আর সেই সব ছবি গেল জলে। 😟
মানিকারান পৌঁছে আমরা যে যার মত ঘুরে দেখতে লাগলাম। আমি যথারীতি চারিদিকের ভিডিও করছিলাম, একফাঁকে আমাদের ড্রাইভার বিপিনের মজাদার সাক্ষাৎকারও ভিডিও করলাম... সবই আজ ইতিহাস, আর দীর্ঘশ্বাস। বিপিন ঐ জায়গার একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বলল, একদিন রাতের বেলা পাহাড় হতে একটা বিশাল পাথর ধসে পড়ে এই বিল্ডিং এর উপর এবং বিল্ডিং ভেদ করে বের হয়ে এসে পড়ে প্রবাহমান জলধারার উপর। এই দুর্ঘটনায় সাতজন মারা যায়।
মানিকারান যাওয়ার পথে বিয়াস নদীর অপর পাশে একটা তিব্বতীয় মনস্ট্রি দেখতে পেয়েছিলাম। বিপিন’কে বললাম, আমরা কি ওখানে যাব? ও বলল, সেটা আমাদের শিডিউলে নাই। আমরা দেখব মানালি’র তিব্বতীয় মনস্ট্রি, এটা হল কুলু তিব্বতীয় মনস্ট্রি। আমি ওকে, জিজ্ঞাসা করলাম, কোনটা বেশী সুন্দর? সে বলল, অবশ্যই এটা। আমি ওকে বললাম, আমি এই কুলু তিব্বতীয় মনস্ট্রি দেখতে চাই। ও বলল, ওটা অন্য পথে, ঘুরে যেতে হবে। ফেরার সময় যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার বেশী ঘুরতে হবে। আমি হেসে শুধু বললাম, “আরে ইয়ার, এয়স্যা কিউ কারতা, লেকে চালো না উহা...”। তো মানিকারানে ঘণ্টা দেড়েকের মত সময় কাটিয়ে আমরা ফিরতি পথে যাত্রা করলাম, পথে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে এবার যাত্রা সেই তিব্বতীয় মনস্ট্রি’র উদ্দেশ্যে। আগামী পর্বে সকালের বোট রাফটিং আর বিকেলের এই তিব্বতীয় মনস্ট্রি ভ্রমণের গল্প থাকবে।
মন্তব্যসমূহ