কাশ্মীর - যাত্রা শুরু'র আগের গল্প
গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে “ভ্রমণ বাংলাদেশ” এর অফিসে গেলেই নোটিশবোর্ডে চোখ চলে যেত “মিশন কাশ্মীর” লেখাটার দিকে। মনের গহীনে একটা চাপা ইচ্ছে জেগে উঠলেও তেমন আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে নাই কখনো। প্রায়ই সবার ভিসা’র আবেদন, ভিসা প্রাপ্তি ইত্যাদি খবরগুলো পেতে থাকি কখনো অনলাইনে, কখনো অফলাইনে। কিন্তু গেল এপ্রিলে কাশ্মীরে বন্যা হওয়ায় ইভেন্ট পিছিয়ে দেয়া হল। কিন্তু ততদিনে সবার ভিসা নেয়া হয়েছে, অনেক প্রিপারেশন কমপ্লিট। তো কি করা? ভ্রমণ বাংলাদেশের অন্যতম চৌকশ দলনেতা তাহসিন শাহেদ (ব্লগার তাহসিন মামা) দল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন সান্দাকফু-মিরিখ-দার্জিলিং এর পথে, যে গল্প আপনারা ইতোমধ্যে পড়েছেন তাহসিন মামার ব্লগে। কিন্তু “মিশন কাশ্মীর” এর কি হল? ভ্রমণ বাংলাদেশের সাধারন সম্পাদক রবিউল হাসান খান মনা ট্যুর নতুন করে শিডিউল করলেন অক্টোবরে। তখন পর্যন্ত আমার সুদূর পরিকল্পনাতেও কাশ্মীর ভ্রমণের কোন সম্ভাবনা ছিল না। একে তো গত একবছরে আর্থিক অবস্থা বড়ই করুণ, তার সাথে আমার বিদেশ ভ্রমণের রাশি বুঝি ভাল নয়, ভয়াবহ মন্দ। ১৯৯৮ সালে পাসপোর্ট করার প্ল্যান করে ২০১৩ সালে পাসপোর্ট এর জন্য টাকা-পয়সা সহ সকল আনুসাঙ্গিক জমা দেয়া। অতঃপর দুই বছর পর সেই পাসপোর্ট হাতে পেলাম মে-জুনের দিকে। কারন? থাক সেই গল্প, সে এক বিশাল কাহিনী। তো পাসপোর্ট পাওয়ার পর মনের মাঝে অঙ্কুরোদগম হল কাশ্মীর যাওয়ার সাধের। কিন্তু কত প্রতিকূলতা, ভারতীয় ভিসা তো দূরের কথা, ই-টোকেন তখন সোনার হরিণ, আর যদি তা পাওয়া যায়ও, কিন্তু ভিসা’র নিশ্চয়তা কে দিবে?
তখন একদিন ঘটনাক্রমে মেজমামা’র বাসায় গেলেম, কথা প্রসঙ্গে কিভাবে যেন চলে এল ভারত ভ্রমণের কথা, সেই পথ ধরে কাশ্মীর ট্যুর। মেজমামী কি ভেবে বলল, জানি না, কিন্তু কথাটা পছন্দ হয়েছিল, ‘শোন, ধার করে হলেও বেড়ায়া আস, এখন যেহেতু সময় সুযোগ আছে, আবার চাকুরীতে ঢুকে পড়লে এত লম্বা ছুটি কখনোই পাবা না।’ কথাটা খুবই মনে ধরে গেল, বাসায় এসে আমার করিৎকর্মা ছোট ভাইকে বললাম, এরপরে সে নিজ দায়িত্বে ভিসা’র ব্যবস্থা করল, আমি ম্যানেজ করলাম অর্থের সংস্থান (অবশ্যই লোণ করে)। এদিকে মনা-তাহসিন, দুজনের কেউই এই ট্যুরে যেতে পারছে না, ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে। নানান ঘটনাক্রমে আমি হয়ে গেলাম ট্যুর লিডার, যে নিজেই কি না এই প্রথম দেশের বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে!!!
যাদের নিয়ে কাশ্মীর ট্যুরের প্ল্যান করা, একে একে সবাই বেঁকে বসল। কিই সব হাস্যকর যুক্তি, এই এই ব্যাক্তি গেলে আমি যাব, এই এই ব্যাক্তি না গেলে আমি যাব না। এক বড় ভাই বড়ই ক্লাসি, মুখে সরাসরি না বললেও উনার কারণ ছিল, আরও হাস্যকর, তা নাই’বা বললাম। একমাত্র ভরসা ছিল ভ্রমণ সঙ্গী, সামু’র প্রিয় ব্লগার, সাদা মনের মানুষ খ্যাত কামালউদ্দিন কামাল ভাই। উনি এবং উনার দুই বন্ধু স্থানীয়, ভিসা হাতে তৈরি ছিলেন এই ট্যুরের জন্য। এই ফাঁকে আমি ব্যস্ত ছিলাম নতুন ভ্রমণ সাথী যোগাড়ে, একইসাথে হোটেল, টিকেট এসবের খোঁজ করতে। টানা মাসখানেক সময় অনলাইনে যোগাযোগ করে মোটামুটি ভাল মানের এক এজেন্টের মাধ্যমে একটা পছন্দের ডিলাক্স প্যাকেজ রিজেনেবল প্রাইসে নিশ্চিত করতে পারলাম। কিন্তু সমস্যা তখনও ছিল দুটিঃ এক, ট্যুরের মেম্বার কনফার্ম করা, দ্বিতীয়, আমি চাচ্ছিলাম কাশ্মীর ভ্রমণ শেষে সিমলা-মানালি ট্যুর দিতে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মাত্র একজন ম্যানেজ হয়েছে যে ১৫ দিনের জন্য সময় বের করতে পারবে।
কিন্তু আসল ঝামেলা যে, তখন ঘাপটি মেরে বসে আছে তা কি আর জানতাম! মোটামুটি আটজনের দল কনফার্ম হওয়ার পর খোঁজ শুরু করলাম টিকেটের, আমাদের প্ল্যান ০৮ অক্টোবর, ২০১৫, বৃহস্পতিবার রাতের গাড়ীতে কলকাতা যাওয়ার, তার পরদিন রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে দিল্লী, পরদিন সেখান হতে জম্মু রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে জম্মু, সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে এজেন্ট কর্তৃক এক সপ্তাহের জন্য আমাদের রিজার্ভ গাড়ীটি। কিন্তু কলকাতা টু দিল্লী রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট করতে গিয়ে দেখি টিকেট নেই, সব বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের যাত্রার তখনো মাস দেড়েক বাকী! পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম আগত দুর্গাপুজার কারনে টিকেটের এমন দুষ্প্রাপ্যতা, এমনিতে মাস দেড়েক আগেও টিকেট পাওয়া যায়। যদিও জানতাম ভারতীয় রেলের টিকেট অগ্রিম কেটে রাখতে হয়, তাই বলে মাস দেড়েক আগেও পাওয়া যাবে না! দুদিন নানান হিসেব কষে দেখলাম, একমাত্র উপায় আকাশপথে ভ্রমণ, কিন্তু তাতে খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়ে যায়। আমরা যারা গ্রুপ ট্যুর দেই, তাদের বাজেটের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হয়, কেননা সবার জন্য এফর্ডেবল হয় এমন বাজেট থাকাটা জরুরী। কি করা যায়... কি করা যায়? অনেক ভাবনার পর বুদ্ধি একটা পাওয়া গেল, একদিন আগে, অর্থাৎ বুধবার রাতে রওনা দিলে বৃহস্পতিবারের রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকেট এভেইলেবল আছে তখনো। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ; সবাইকে ফোন দিলাম। আবার সমস্যা, যারা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে তাদের আরও একদিন তাও বুধবার ছুটি ম্যানেজ করা খুব কঠিন। আমি স্পষ্ট জানালাম, অন্যথায় ট্যুর ক্যান্সেল করতে হবে।
মজার ব্যাপার হল, যে দুজনের এই ঝামেলা তারা দুজনই আমার সাথে কাশ্মীর ট্যুর শেষে সিমলা-মানালি’র পথের সাথী। তখন পর্যন্ত তিনজনই ছিলাম এই এক্সটেন্ডেড ট্যুরের জন্য। আচ্ছা এই ব্যাপারে একটু বলে নেই। আমি যখন প্ল্যান করলাম দিল্লী হয়ে জম্মু-কাশ্মির রুটে ট্যুর হবে, তখন ভেবে দেখলাম কেন না সিমলা-মানালি ঢুঁ মেরে যাই? কারণ, আবার সিমলা-মানালি বেড়াতে এলে ঢাকা-দিল্লী আমাকে সফর করতেই হবে। তাই নানান সম্ভাব্যতা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ট্যুর হবে এমনঃ ঢাকা-কলকাতা-দিল্লী-জম্মু-কাশ্মীর-দিল্লি-সিমলা-মানালি-কলকাতা-ঢাকা।যাই হোক সকল সমস্যা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত সাতজনের দলের জন্য সকল টিকেট কাটা হল, যদিও কাশ্মীরে দশজনের দলের জন্য সকল কিছু বুকিং রাখা হল, গাড়ী রইল ১৩ সিটের টেম্পু ট্র্যাভেলার। ঢাকা-কলকাতা যাব বিআরটিসি ভলভো ট্রানজিট বাসে সরাসরি সল্টলেক; সেখান থেকে হাওড়া। হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে করে দিল্লী (থ্রি টায়ার এসি টিকেট পেয়েছিলাম; তাও দুই বগিতে ); দিল্লী থেকে শালিমার এক্সপ্রেসে জম্মু (এখানে একই বগীতে, টু টায়ার এসি); সেখানে অপেক্ষা করবে আমাদের টেম্পু ট্র্যাভেলার। ফেরার পথে বাই এয়ারে ফিরব, ডোমেস্টিক ট্রান্সপোর্ট ‘ইন্ডিগো এয়ার’, আর দিল্লী টু ঢাকা ‘এয়ার ইন্ডিয়া’। কারণ, ডোমেস্টিক এর জন্য ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় নাই, আর ছুটির স্বল্পতার দরুন ঢাকা ফেরা বাই এয়ারে। কি করা! সেই খরচ বেড়েই গেল প্রায় ৩০%। কিছুই যে করার নেই।
এরপরে অপেক্ষার পালা, আর আমি খুঁজে চলেছি আরেকজন টিম মেম্বার সিমলা-মানালি’র পথের জন্য। ৪/৫ তারিখের কথা, আমি আর ছোট ভাই গেছি বসুন্ধরা মার্কেটে, মোবাইল কিনতে। চোর বাবাজি সেই যে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়ে গেছে, তারপর আর সেট কেনা হয় নাই। তো সেখানে একটা কল আসল, ‘হ্যালো, ভাইজান আমি ভিসা পেয়েছি, এইমাত্র! আপনাদের সাথে কাশ্মীর যাব, সিমলা-মানালি’ও...’। আমি মনে মনে বললাম, ‘পাইলাম, ইহাকে পাইলাম’; আর ফোনে বললাম, 'আপনার বাসার ঠিকানা দেন, আমি আপনার বাসায় এসে কথা বলি'। সেদিনই ছুটলাম উনার বাসায়; উনাকে বললাম, 'যাওয়া আসার টিকেট নিজ দায়িত্বে করে নিতে পারলে বাকীসব এরেঞ্জ করা যাবে', আসলে এরেঞ্জ তো করাই ছিল।
যাই হোক, পরদিন আরেকজনের কল, ‘ভাই, আমি আপনাদের সাথে কাশ্মীর যেতে চাচ্ছি’। হাসুম না কান্দুম, তাকেও সেই একই শর্তে দলে টেনে নিলাম, দল ভারী হল, নয়জনের। এরপর, যাত্রা শুরু করার আগের রাতে কাশ্মীর ট্যুরের অন্যতম ভ্রমণসাথী মুক্তার ভাই মেসেজ করলেন, উনার এক ফ্রেন্ড আমাদের সাথে কাশ্মীর জয়েন করতে চাচ্ছেন, নেয়া যায় কি? এখন বলেন কি করব? হাসি, কান্না বাদ... যাই হোক সেই একই শর্তে দশম সদস্য যুক্ত হল দলে। ঠিক এসবের মাঝে কামাল ভাই ফোন দিলেন, উনার দুই সাথীর একজন পারিবারিক ঝামেলার কারনে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। সেই মুহূর্তের অনুভূতি বুইঝা লন ভাই সকল। আমি বললাম, 'কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু টিকেট যা কেটেছি ম্যাক্সিমাম নন চেঞ্জেবল, নন রিফান্ডেবল; যদি কিছু ফেরত পাই তবে তা উনাকে ফেরত দেয়া যাবে; নইলে উনার পুরো টাকা জলে'। কামাল ভাই বললেন মজার কথা, ‘সে না হয় গেল, কিন্তু বাড়তি কোন জরিমানা দিতে হবে কি না তা বলেন?’। জ্ঞানী মানুষের জ্ঞানী কথা। আমি উনাকে নিশ্চিত করলাম এমন কোন সম্ভাবনা নেই। যাই হোক সকল প্রতিবন্ধকতা পিছু ফেলে শেষ পর্যন্ত সেই ভাইটিও আমাদের সাথী হয়েছিলেন।
এই প্রি এরেঞ্জমেণ্টে আরও দুটো ঝামেলা ছিল; একটা হল ঢাকা থেকে ভারতে যে কোন টিকেট কাটলে প্রায় ২০% বেশি পেমেন্ট করতে হয়। যখন ভারতীয় এক রুপী বাংলাদেশের ১.১৯ টাকা এক্সচেঞ্জ রেট ছিল, আমাদের পেমেন্ট করতে হয়েছে ১.৪০ রেটে। ট্রেনের টিকেট, প্লেনের টিকেট সকল ক্ষেত্রেই, এমন কি এডভান্স টাকা পাঠাতেও। আরেকটা ঝামেলা ছিল, আমাদের ট্যুর অপারেটর'কে অগ্রিম পেমেন্ট করতে গিয়ে বিড়ম্বনা। আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্ট ভাল মানের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছিল, সে ব্যাঙ্কিং থ্রু’তে টাকা এডভান্স করতে বলে, ছয়টা ব্যাঙ্ক একাউণ্ট দিল, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঙ্কের, যে কোন একটায় জমা দিতে বলল। প্রতিটি ছিল কোম্পানি’র নিজ নামে একাউণ্ট। কিন্তু ঢাকা থেকে বৈধ উপায়ে ভারতে কোন টাকা জমা দেয়ার সোর্স খুঁজে পাওয়া যায় নাই। নানান যন্ত্রণার পর বৈধ উপায়েই ভারত থেকে টাকা জমা দেয়া হয়, অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে।
এরপর আর কি? লাগেজ গোছালাম যাত্রার দিন দুপুরের পর। লাগেজ গোছানো শেষে মনে হল ‘রন্তু’র কালো আকাশ’ সিরিজের শেষ পর্ব পোস্ট করে যাই। বসে গেলাম লিখতে, লেখা শেষ করে পোস্ট করতে করতে রাত আটটা পেরিয়ে গেল। দ্রুত তৈরি হয়ে রিকশা নিয়ে যখন বাস কাউণ্টারের দিকে রওনা হলাম, তখন ফোনের পর ফোন। ট্যুর লিডার ছাড়া সবাই হাজির, রিপোর্টিং টাইম ওভার হয়ে গেছে... (চলবে)।