রিকশা থেকে আরামবাগস্থ শ্যামলী বাস কাউণ্টারে নামতেই দেখি বন্ধু মনা’কে ঘিরে জটলা, কাউণ্টারের সামনের ফুটপাথে। সবার শেষ সদস্য হিসেবে আমি যোগ দিলাম সেখানে। মনা এসেছে আমাদের সিঅফ করতে, সাথে মিষ্টিমুখ করাতে। শুরুতেই কিছু নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়ে দোয়ার মাধ্যমে আমাদের নিরাপদ এবং সুন্দর ভ্রমণ যাত্রার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট সম্মিলিত প্রার্থনা করা হল, অতঃপর মনা'কে বিদায় দিয়ে আমাদের আটজনের সবাই গাড়ীতে উঠে বসলাম। কামাল ভাই আর উনার দুই ভ্রমণসঙ্গী, শামীম ভাই আর মনির ভাই; মিতা ও মিলিয়া আপু, মুক্তার ভাই আর উনার ক্রেজি বন্ধু আনিস (যে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে বাস, ট্রেনের টিকেট নিজ দায়িত্ব ম্যানেজ করে রওনা হয়েছে আমাদের সাথে) আর সাথে দলনেতা হিসেবে এই অভাজন বোকা মানুষ। ও হ্যাঁ, আমাদের অন্য দুই সাথী'র একজন হলেন জুবায়ের ভাই, যিনি চিকিৎসার জন্য আমাদের দুইদিন আগেই রওনা হয়েছেন কলকাতা। আর অপরজন হলেন ইয়াসমিন আপা, যিনি পরদিন কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। উনারা দুজনেই আমাদের সাথে সরাসরি কাশ্মীরে জয়েন করবেন ১০ তারিখে। আমাদের ট্র্যাভেল এজেন্টকে আমি ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার আগে উনাদের দুজনের কন্টাক্ট নাম্বার দিয়ে এসেছি; সাথে উনাদেরকে দিয়ে এসেছি এজেন্টের কন্টাক্ট পারসনের নাম্বার। শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে উনাদের পিক করে সরাসরি পাহেলগাঁও এ আমাদের বুকিংকৃত ‘হোটেল আবসার’ এ নিয়ে যাবে। অপরদিকে আমাদেরকে পিক করা হবে জম্মু রেলষ্টেশন থেকে, সেখান থেকে সরাসরি ‘হোটেল আবসার’ এবং তার পরদিন থেকে আমাদের আনুষ্ঠানিক সফর শুরু হবে।
রাত সাড়ে দশটার দিকে বাস ছাড়ল আরামবাগ থেকে, ঘণ্টাখানেক বাস চলার পর কানে হেডফোন গুজে দিলাম, কারন আনিসের সিট ছিল বাসের একেবার পেছনে আর আমাদের সাতজনের সামনের দিকে। ফলে সপ্তম ব্যক্তি হিসেবে আমি বেজোড় সিটখানি পেলাম, পাশের সহযাত্রী বছর ত্রিশের এক যুবক। এতে অবশ্য আমার লাভ হয়েছে, কেননা জার্নিতে আমি কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে পছন্দ করি, পাশের সিটের সহযাত্রী ভ্রমণসাথী’র কেউ হলে এই আনন্দটুকু ভেস্তে যায়, নানান কথাবার্তায় জড়িয়ে পড়তে হয়।
যাই হোক, রাত একটার মধ্যেই গাড়ি পৌঁছে গেল ফেরীঘাট। বাস কাউণ্টার থেকে আগেই বলেছিল, আমাদের বাস অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফেরী পার হয়ে যাবে। সরাসরি ট্রানজিট বাস যেগুলো কলকাতা যায়, সেগুলো এই সুবিধা ভোগ করে থাকে কিছু অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে। আর আমাদের তাড়া ছিল, কেননা পরদিন বিকেলবেলা দিল্লীর ট্রেন ধরতে হবে। এর আগে একফাঁকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সহ দুয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখার।
বাস ফেরীতে ওঠার পর বাস হতে নেমে ফেরীর উপরের তলায় চলে এলাম।
এই ট্যুরের সঙ্গী সাথীদের মধ্যে কামাল ভাই, মিতা রায় আর ইয়াসমিন আপা’র সাথে আগে একাধিক ট্যুর দেয়া হয়েছিল, ফলে অন্যদের সাথে সরাসরি এই প্রথম সাক্ষাৎ। ফেরীর বিরতিতে মুক্তার আর আনিসের সাথে বেশ ভালোভাবে পরিচিয় পর্ব সেরে নিলাম। বাসা হতে ডিনার না করে বের হয়েছি, বিকেলেও রন্তু’কে নিয়ে মেতে থাকায় পেটে দানাপানি পড়ে নাই। আনিস আর মুক্তারও ডিনার করে নাই, পরে মিতাও জয়েন করল। চারজনে ‘আইস-কুল ইলিশ ফ্রাই’ আর ততোধিক ঠাণ্ডা ‘ফ্রজেন হার্ড রাইস’ দিয়ে ডিনার করে পুরোই বেকুব হয়ে গেলাম। ও হ্যাঁ, সাথে ছিল ওয়ার্ল্ডস থিকেস্ট ডাল। প্রায় ফজরের পরপর আমরা বেনাপোল পৌঁছে গেলাম, তখনো ভাল করে আলো ফোটেনি। স্পেশাল সার্ভিসের কেরামতিতে বাস একেবারে সীমান্ত গেটের কাছে এনে ব্রেক করা হল। আমিতো মহা খুশী, মনে মনে হিসেব কষা শুরু করে দিলাম, নয়টা না দশটা? কখন কোলকাতা পৌঁছব? কিন্তু তখনো কি জানা ছিল, কপালে কি আছে?
আমি সীমান্তে অফিসিয়াল কাজে যেন সময় নষ্ট না হয় এই বিবেচনায় সবাইকে ঢাকা থেকেই ট্র্যাভেল ট্যাক্স পরিশোধ করে আসতে বলি। কিন্তু গাড়ীর বাকী যাত্রীরা? বাকী সবাই তো আর আমাদের মত ভালা পুলা না। সবার ট্র্যাভেল ট্যাক্স এর ঝামেলা শেষ হলে শুরু হল এই প্রান্তের ইমিগ্রেশন। একসময় তাও শেষ হল, কিন্তু গাড়ী ছাড়ছে না। ঘটনা কি খোঁজ নিতে জানা গেল নীল পাসপোর্টধারী সবার পাসপোর্ট আঁটকে রাখা হয়েছে, আমাদের মিতা রায়’ও সেই দলে আছেন। সরকারী চাকুরীজীবী সবাই জিও (গভমেণ্ট অর্ডার) নিয়ে সীমান্তে এসে ভিসা পান। সেই জিও’তে বেনাপোল বর্ডার কেন উল্লেখ নাই, এই অজুহাতে ১,০০০ টাকা করে উৎকোচ গ্রহণের পর সবার পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হল। তার আগেই সুপারভাইজার সাহেব সকল যাত্রীর কাছ থেকে স্পীডমানি হিসেবে একশত টাকা করে ফি’স নিয়ে গেছেন। সেই স্পীডমানির কল্যানেই কি না, কে জানে, একের পর এক বাস সীমান্ত থেকে ছেড়ে গেল, পায়ে হেঁটে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ সীমান্ত পার হয়ে গেল; আর আমরা গাড়ীতে বসে রইলাম। সাড়ে আটটার পরে ভারতীয়
দুপুর একটার কাছাকাছি সময়ে সল্টলেক পৌঁছে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিলাম, তারপর বাস কর্তৃপক্ষের ব্যাবস্থাপনায় অন্য একটা বাসে মারকুইস স্ট্রীট। (এটাও এসি বাস ছিল, আমাদের বাস কোম্পানিগুলোর মুড়ির টিন মার্কা যাত্রী পরিবহনের জঘন্য ব্যাসগুলোর বিপরীতে ভালোই ছিল। প্রতি ট্যুরে সায়েদাবাদে নেমে কোম্পানির বাসের জন্য ঘণ্টার উপরে বসে থাকার পর, লক্কর ঝক্কর বাসে করে যাত্রীদের গাবতলী পর্যন্ত ট্রানজিট সার্ভিস দেয়া হয়। জীবনে একবারই এই সার্ভিস গ্রহণ করেছিলাম, তারপর কানে ধরেছি। মাফ চাই, দোয়াও চাই)। অনেকখানি পথ, কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা হল কলকাতা শহরটাকে। সেই টিনএজের ক্রান্তিকাল থেকে সুনীল, সমরেশ, নিমাই বাবুদের কলমে ভর করে দেখা কলকাতা শহর। মনে মনে এতদিন যে ছবি এঁকেছিলাম তা মিলল না বাস্তবের কলকাতা দেখে। যদিও পুরো দেখাটাই ছিল গাড়ীতে করে, সল্টলেক হত দমদম হয়ে মারকুইস স্ট্রীট, সেখান থেকে হাওড়া। তবে যতটুকু দেখেছি হতাশ হয়েছি, ইচ্ছে আছে আগামীতে সময়-সুযোগ হলে সপ্তাহখানেকের জন্য শুধু কলকাতা ঘুরে দেখার।
বাস চলতে শুরু করতে না করতেই বাইরে শুরু হল বৃষ্টি। দুপুর দুটো নাগাদ পৌঁছে গেলাম মারকুইস স্ট্রীট, হাতে মোটেও সময় নাই। কলকাতা পরেরবার দেখা যাবে, ‘বাড়ীর পাশে আরশি নগর, সেথা পড়শি বসত করে’ বলেই তাকে পরে একসময় দেখে যাওয়ার ভাবনা। আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল, ‘কস্তূরী’তে লাঞ্চ করব, বৃষ্টি মাথায় করে ঢুঁকে পড়লাম কস্তূরী রেস্টুরেন্টে। একগাদা ভর্তা-ভাঁজি অর্ডার করা হল, সাথে কেউ কেউ মাছমাংস। ওদের রান্নাগুলো খুব সুস্বাদু ছিল, পরে যতবার যাই না কেন, এখানে একবেলা করে হলেও খাবার খাব। যাই হোক, খাওয়া পর্ব শেষ হতে হতে দেখি ঘড়ির কাঁটা তিনের দিকে হেলে পড়েছে। দুটো ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হলাম হাওড়ার দিকে।
হাওড়া পৌঁছে কি আর করা, ট্রেনের জন্য ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা। তারপর যথাসময়ে ট্রেনে ওঠার পর শুরু হল রাজধানী এক্সপ্রেসের বিখ্যাত আতিথিয়তা। ট্রেনের মৃদু দুলুনিতে ভোজনবিলাসের সাথে প্রাণোচ্ছল আড্ডা চলল বহুক্ষণ। সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত গড়াতেই সবাই যার যার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আমি জানালার দিককার উপরের বাঙ্কে শুয়ে হেডফোন কানে গুঁজে দিলাম, জানি সারারাত ঘুম আসবে না, গান শুনেই কাঁটাতে হবে। (চলবে)