শ্রীনগর পরিভ্রমণ - নাগিন এবং ডাল লেক

কাশ্মীর,ডাল লেক,কাশ্মীর ডাল লেক শিকারা রাইড,অপরুপ ভূস্বর্গ ডাল লেক,শ্রীনগর,কাশ্মীর ভ্রমণ,ডাল,লেক,ডাল,লেক ভ্রমণ,নাগিন লেক শ্রীনগর,নাগিন লেক কাশ্মীর,নাগিন লেক,dal lake srinagar,dal lake,dal lake in kashmir,dal lake houseboat,dal lake kashmir,dal lake kashmir houseboat, nagin lake srinagar,nagin lake,nagin lake in kashmir,nagin lake houseboat,nagin lake kashmir,nagin lake kashmir houseboat,
হাউজবোটে চেকইন করে আধঘণ্টা সময় দিলাম সবাইকে তৈরি হয়ে নিতে, বিকেলবেলা নির্ধারিত ছিল ‘শিকারা রাইড’। আমাদের প্যাকেজে প্রথমে এক ঘণ্টা শিকারা রাইড কমপ্লিমেণ্টারি ছিল, আমার অনুরোধে সুমায়রা জারগার তা বাড়িয়ে দু’ঘণ্টা করে দিয়েছিলেন। সমস্যা হল দুটো শিকারা, মানুষ দশজন। এম্নিতে একটা শিকারায় সব মিলে ছয়জন বসতে পারে, কিন্তু আয়েশ করে ঘোরার জন্য তা অতিরিক্ত। তাই আমরা তিনশত টাকা ঘণ্টা চুক্তিতে একটা অতিরিক্ত শিকারা ভাড়া করে নিলাম। এখানে ধরা খেয়েছিলাম, শিকারাওয়ালাদের পরামর্শে আরও অতিরিক্ত এক ঘণ্টার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলাম ওদের সাথে, একটি অতিরিক্ত শিকারা, সাথে দুই ঘণ্টার সাথে অতিরিক্ত একঘণ্টা, মোট তিন ঘণ্টা, এজন্য বাড়তি পেমেন্ট করতে হল তিন হাজার রুপী! পরে এই ঘটনা শুনে সুমায়রা খুব রাগ করেছিল, বলেছিল, ‘আপকো ফোন কারনা চাহিয়ে থা না মুঝে!’

যাই হোক, বাড়তি সময়ে শিকারাওয়ালা আমাদের নিয়ে গেল পুরাতন এলাকায়, ঘিঞ্জি সরু খাল, নোংরা পানি, দু’ধারে বাড়িঘর, দোকানপাট, শাল কারখানা, মধুর খামার। 
আমাদের শিকারা গিয়ে থামল একটা মধুর খামারে। নানান ফুলের বাগানের লাগোয়া গেটের সিঁড়িতে আমাদের শিকারা ভিড়লে সবাই নেমে গেলাম। 
এবার একটু ডাল লেক সম্পর্কে জেনে নেই। ধারনা করা হয় শ্রীনগর শহরটি খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর সময়কালে সম্রাট অশোকের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। আর এই শহরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘ডাল লেক’ এবং ‘নাগিন লেক’। ঝিলাম নদী এসে মিসেছে এই লেকদ্বয়ে; নাগিন লেক মূলত ডাল লেকের একটি অংশ। 26 বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রসারিত, হ্রদ বা লেকটি চারটি ভাগে বিভক্ত রয়েছেঃ সুন্দরী ডাল-গাগরিবাল, লাকুতি ডাল, বড়াডাল—এই তিনের সমন্বয়ে ডাল লেক সাথে নাগিন লেক। পুরো লেকটির দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটারের বেশী আর প্রস্থ তিন কিলোমিটারের বেশী। লেকের সর্বাধিক গভীরতা ছয় মিটার বা বিশ ফিট। এই লেকে দুটি দ্বীপও আছে। সোনা লান্ক আর রূপা লান্ক।শীতকালে লেক এলাকার তাপমাত্রা মাইনাস এগারো ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে যায়। লেকের পানি তখন জমে বরফে পরিণত হয়।
ডাল লেক তার হাউসবোট, “শিকারা”-র জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পূ্র্ণবিকশিত পদ্মফুল ও নির্মলতার জন্য সুখ্যাত।কায়াকিং থেকে সাঁতার এবং ক্যানোয়িং থেকে হাউসবোটে থাকার অভিজ্ঞতা সহ ডাল লেক গ্রীষ্মকালে প্রচুর চিত্তবিনোদনের সুযোগ প্রদান করে।বিভিন্ন দিক দিয়ে ডাল লেকের প্রকৃতি এবং জীবন বৈচিত্র্য অসাধারণ। লেককে ঘিরে কাশ্মীরের হাজারো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ বিখ্যাত হাউসবোটের মালিক, কেউ ডাল লেকের বিশেষ নৌকা শিকারাতে পর্যটকদের নিয়ে পরিভ্রমন করে,আবার কেউবা ডাল লেক বাজারে সবজি বিক্রয় করে। 
হাউসবোট

কাশ্মীরের ডাল লেকের একটি প্রধান আকর্ষণ হলো হাউসবোট। পানির উপর ভাসমান বাড়ি। ডাল লেকে সাতশোর বেশী হাউসবোট আছে। এর ভিতরে অত্যাধুনিক হোটেলের মত নানান ব্যবস্থা করা। শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম সবই আছে। সবকিছুই সুসজ্জিত। সুন্দর কার্পেট বিছানো,পর্দা টানানো। আরো আছে বারান্দা, যেখানে বসে অনায়াসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। হাউসবোটের ভিতরে কাঠের জাফরি কাটা দেয়াল অনিন্দ্য সুন্দর। মোট কথা এই হাউসবোটে পাওয়া যাবে সবধরনের ব্যবস্থা যা একজন পর্যটকের একান্ত প্রয়োজন। 

শিকারা
ডাল লেকের পানিতে ভেসে বেড়ানো বিশেষ ধরনের নৌকাগুলোকে বলা হয় শিকারা। হাজার হাজার শিকারা প্রতিনিয়ত লেকে চলাচল করছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। কখনও পর্যটকদের নিয়ে প্রদক্ষিন করতে, কখনও বা ব্যক্তিগত কাজে শিকারা ব্যবহৃত হয়। গায়ে, গায়ে দোকানদারদের শিকারা এসে আংটি, চুড়ি, হার, পাথর থেকে শাল, আখরোট, বাদাম, ভুট্টা, ফলমূল মায় ধূম, পানীয় বিক্রি করতে চাইবে। এক সময় জল ছেড়ে ডাঙায় উঠতেই হয়।
সন্ধ্যার পরে আঁধার নেমে এলে আমরা ফিরে এলাম আমাদের হাউজবোটে। ফ্রেশ হয়ে সবাই ডাইনিং রুমে জড়ো হলাম, শ্রীনগর শহরের বিখ্যাত ‘মুঘল দরবার’ রেস্টুরেন্ট হতে কিনে আনা কুলচা, নানখাতাই, ফ্রুট কেক, কোকোনাট কুকিজ সাথে কাশ্মীরি আপেল দিয়ে সারলাম বিকেলের নাস্তা, সন্ধ্যের অনেক পরে। খাওয়া শেষে গরম গরম চা পান করালেন হাউজবোট মালিক। হাউজবোটের পেছন অংশে উনার তেতলা পাকা দালান, সেখানেই সপরিবারে থাকেন। হাউজবোটগুলো মূলত লেকের পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো থাকে, ব্যক্তিগত জমির ভেতরে মাটি কেটে এই বোটের স্থান সঙ্কুলান করা হয়, সম্মুখভাগটা থাকে পানিতে। সারি সারি হাউজবোট সব বাতি জ্বালিয়ে যখন রাতের বেলা দাঁড়িয়ে থাকে, তখন দূর থেকে দেখতে অতীব চমৎকার লাগে। 
রাতের খাবার নিয়ে পড়লাম যন্ত্রণায়, বেশীরভাগ ভ্রমণসঙ্গী বাংলা খাবার খেতে চায়, কি যন্ত্রণা! জনপ্রতি প্রায় তিনশত রুপীর উপরে পে করেছে এজেন্ট, বোট মালিককে, এই ডিনারের জন্য। শেষে বললাম সবাইকে, যদি বোট কর্তৃপক্ষ আপনাদের বাংলা খাবার দিতে পারে, তবে নিজ খরচে সবাই খেয়ে নেন। একজনের আবদারের কথা না বলে পারছি না, উনার বক্তব্য এমন, ‘দেখেন ভাই, আমার এতো ভাল ভাল খাবারের দরকার নাই। আমাকে চারটা ভাত, আলুভর্তা, ডিমভাজা আর মসুরের ডাল দিলেই হবে’। আহা! মামার বাড়ীর আবদার! শেষ পর্যন্ত সেই আগে থেকে অর্ডার করা খাবারই খেতে হয়েছে। এদের যন্ত্রণায় পরেরদিন দুপুরের খাবার এক কলকাতাইয়া বাংলা রেস্টুরেন্ট করতে হয়েছিল; আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম আরও কিছু কাশ্মীরি ডিশের স্বাদ নেয়া থেকে। 
যাই হোক রাতের খাবার শেষে ড্রইয়ং রুমে বসল আড্ডার আসর। এক ফাঁকে এক ভাসমান ফেরিওয়ালা তার ভাসমান নৌকা নিয়ে হাউজবোটে চলে আসল, টুকটাক কেনাকাঁটা করে নিলাম সবাই। হাতের তৈরি লেদার-কাপড়ের ব্যাগ, গহনার বাক্স সহ আরও কিছু গিফট আইটেম। কেনাকাটার পর্ব শেষ হলে, মুক্তার হোসেনের হোস্টিংয়ে শুরু হল ট্যুর নিয়ে সবার অভিব্যাক্তি প্রদান। সবার সন্তুষ্টি শুনে এবং দেখতে পেয়ে দলনেতা হিসেবে মনটা ভাল হয়ে গেল। টানা দুইমাসের পরিশ্রমের ফসল ছিল এই ট্যুর। পুরো এই সাক্ষাতকার পর্বের ভিডিওটি সঙ্গত কারনেই শেয়ার করলাম না। শুধু রওশন আপার উক্তিটি বলি, ‘ট্যুরের আয়োজন, থাকাখাওয়া থেকে শুরু করে ট্রান্সপোর্ট, স্পট ভিজিট সব দেখে, আমি ফিদা...’ 
একসময় আড্ডা সাঙ্গ হলে সবাই যার যার রুমে চলে গেলাম ঘুমের খোঁজে। আমি আর মুক্তার ছিলাম দ্বিতীয় হাউজবোটে, মধ্যরাত পর্যন্ত হাউজবোটের সম্মুখের ব্যালকনিতে আড্ডা দিলাম। মধ্যরাতে দূর পাহাড়ে হঠাৎ বেশ কয়েকবার গুলির শব্দ শুনলাম, চিন্তায় পড়ে গেলাম আবার কোন ঝামেলা এসে উপস্থিত হল! 

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ