পাথুরে নদী আর উপত্যকার শহর "পাহেলগাঁও"

টানা সত্তর ঘণ্টার যাত্রা শেষে স্বাভাবিকভাবেই দেহ ছিল ক্লান্ত, তার সাথে পরপর তিন রাত চলমান যানে রাত্রিযাপন এবং নিদ্রা। তিনদিন পর বিছানা-বালিশ তার সাথে ত্রিশের উপরের তাপমাত্রায় অভ্যস্ত শরীর হুট কর দশ-বারো ডিগ্রি সেলসিয়াসের পাহাড়ি শীতল আবহাওয়া। গায়ের উপর মোটা কম্বল চাপিয়ে দিয়ে হারালাম ঘুমের জগতে। হোটেল বয়ের আগাম পরামর্শে রুম হিটার চালু করে দেয়া হল, রাতে নাকি তাপমাত্রা আরও কমবে! যাই হোক, এই সকল অনুঘটকের কল্যাণে জটিল একখান ঘুম দিয়ে ভোরবেলা যখন চোখ খুললাম, রুমের জানালা গলে চোখ চলে গেল সোনারঙা পাহাড়ের চুড়ায়। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তা ছিল পাহেলগাও-চণ্ডীগড় হাইওয়ের পাশে অবস্থিত বিখ্যাত পাহেলগাঁও ক্লাবের পাশে পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে। রুমের জানালা দিয়ে সকালের সেই স্বর্ণালী পাহাড় চূড়া দেখে গত তিনদিনের সকল ক্লান্তি, ঝুট-ঝামেলা, যন্ত্রণা ভুলে গেলাম। সিমপ্লি ওয়াও...
শারীরিক ক্লান্তিকে বিবেচনায় রেখে এদিন সবাইকে সকাল আটটা অবধি ঘুমিয়ে চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ দেয়া ছিল। সাড়ে আটটা নাগাদ নাস্তা করে নয়টায় বের হয়ে যাব পাহেলগাও ভ্রমণে। কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই দেখি সবাই তৈরি হয়ে হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের লিভিং লঞ্জে অথবা লাগোয়া ছোট্ট বাগানে রোদে চেয়ার পেতে বসে আছে। কয়েকজন মিলে হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি আর ফটোসেশন হয়ে গেল। সাড়ে আটটা নাগাদ নাস্তা শেষ হলে আমি রিসিপশনে গিয়ে ট্রান্সপোর্টের জন্য কল করতে বললাম। এখানে বলে রাখি, কাশ্মীরে ভ্রমণের সময় আপনাকে প্রতি এলাকায় স্থানীয় গাড়ী ভাড়া করতে হবে। আমাদের পুরো ট্যুরের জন্য সাহিল এবং তার টেম্পু ভাড়া করা থাকলেও সে আমাদের শ্রীনগরের বাইরে শুধু হোটেল পর্যন্ত ড্রপ করতে পেরেছে এবং সেখান হতে পিক করে পরিবর্তী গন্তব্যে নিয়ে গেছে। এটাই সেখানকার নিয়ম। যাই হোক, সেদিনের ট্যুরের জন্য অন্য একটা গাড়ী ভাড়া করা হল সারাদিনের জন্য, গন্তব্যঃ চান্দানওয়ারি, বেতাব ভ্যালী, আরু ভ্যালী; সেখান থেকে ফের হোটেল ড্রপ।
নয়টা নাগাদ আমরা রওনা হলাম চান্দানওয়ারি অভিমুখে। সর্পিল পাহাড়ি পথ ধরে একপাশে লিডডার নদীর পাথুরে খরস্রোতে তোলা মাদকতাময় মৃদু সুরধ্বনি, অন্যপাশে পাহাড়ের বুক জুড়ে সারি সারি পাইন গাছের ঝাড়, সাথে আরও কত নাম না জানা গাছ-গাছালির সমারোহ। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের শুরুর দিক পর্যন্ত যে পাহাড়গুলো বরফে আবৃত হয়ে শ্বেতশুভ্র রূপ নেয়, আজ তা চিরহরিৎ। আধঘণ্টার মত নানান চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো, হৃদয়ের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা এনে দেয়া প্রকৃতির ষোড়শী তরুণীর রূপ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম প্রথম গন্তব্য চান্দানওয়ারি।
পাহেলগাও শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চান্দানওয়ারি; হিন্দুদের অন্যতম তীর্থযাত্রা, ‘অমরনাথ যাত্রা’ এখান থেকে শুরু হয়। চান্দানওয়ারি হল অনেকটা বেসক্যাম্প মত স্থান। গাড়ীতে করে এখানে এসে এখান থেকে যাত্রা শুরু হয়। সাধারণত জুন-জুলাইয়ের দিকে এই যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২,৯২৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এই ভ্যালি’র মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পাথুরে নদী ‘লিডডার’। এই নদীর পাড়ে পরে থাকা বড় বড় পাথরে বসে বরফ শীতল পানিতে পা ভিজাতে খুব করে মন চাইবে আপনার। গাড়ী পার্ক করার স্থান হতে অমরনাথ যাত্রা প্রবেশপথ এর আগেই পড়বে অস্থায়ী কিছু দোকান, যেখানে মিলবে বিখ্যাত কাশ্মীরী শাল, স্থানীয় গহনা সহ নানান সুভেন্যুর আইটেম। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখহি, কাশ্মীরী শাল দুইশত টাকা থেকে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত মুল্যের হয়ে থাকে। কম মূল্যের মোটা কাপড়ের শাল নিম্নবিত্তের লোকেরা ব্যবহার করে থাকে, উচ্চ বিত্তের লোকদের পছন্দ পশমিনা, মধ্যবিত্তের জন্য আছে সেমি-পশমিনা। একটা ভালো মানের সেমি-পশমিনা শালের মুল্য পাঁচ থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে হবে। তাই কাশ্মীর ভ্রমণে শাল কেনার আগে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। গিফট হিসেবে আটশত থেকে হাজার টাকায় মানসম্মত শাল পাবেন; তবে পশমিনা তো নয়ই, তা কিন্তু সেমি পশমিনাও নয়।
যাই হোক সেখানে ঘণ্টা খানেক সময় কাটালাম, পাথুরে নদী আর ঝিরিপথের রূপ দেখে। সেখানে ট্র্যাডিশনাল কাশ্মীরী ড্রেস ভাড়ায় পাওয়া যায়, আমাদের দলের রমণীত্রয় উহা অঙ্গে জড়াইয়া ফটোসেশন করিতে ভুলেন নাই। সেখান হতে কেউ কেউ শাল, কেউ আবার কাশ্মীরী গহনা, কেউবা উভয়ই সুভেন্যুর হিসেবে কেনাকাটা করল।
এবার চান্দানওয়ারি হতে রওনা হলাম বেতাবভ্যালীর দিকে। বেতাব ভ্যালী জম্মু-কাশ্মীরের আনানতাং জেলার অন্তর্গত একটি চিরসবুজ তৃণভূমি যা পেহেলগাঁও (Pahalgam) হতে ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। তৃণভূমির প্রান্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরফে ঢাকা সুউচ্চ পাহাড় আর তার নীচের ঘন গাছে ছেয়ে থাকা গাঢ় সবুজ আপনাকে সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে টেনে নেবে তার মায়ার ভুবনে। এই ভ্যালীটি যে দুটি হিমালয় রেঞ্জের অন্তর্গত তার একটি হল পীর পাঞ্জাল (Pir Panjal) এবং অন্যটি ঝানসকার (Zanskar)। কাশ্মীরের অন্যান্য বেশ কিছু এলাকার মত এই এলাকাও ১৫ শতকের দিকে মোঘলরা শাসন করে। সেই মোঘল আমল থেকে অদ্যাবধি যুগে যুগে হাজারো পর্যটকের মন কেড়েছে পাহেলগাঁও আর তার এই বেতাব ভ্যালির সবুজ গালিচা আর কাঁকচক্ষুর ন্যায় টলটলে পরিস্কার হিমশীতল জলের প্রবাহ নিয়ে বয়ে চলা লিডডার (Lidder) নদী। বেতাবভালী পিকনিক স্পট এবং ক্যাম্পিং এর জন্য সুপ্রসিদ্ধ সারা দুনিয়া জোড়া পর্যটকের নিকট।
কাশ্মীরের সাথে যেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সেই ষাটের দশক হতে বহু জনপ্রিয় এবং সফল ছবির চিত্রায়ন হয়েছে কাশ্মীরের নানান অংশে। এই তালিকায় সেই পুরানো আমলের Aarzoo, Kashmir Ki Kali, Jab Jab Phool Khile, Kabhie Kabhie, Silsila, Satte Pe Satta, Roti, Bobby থেকে শুরু করে হালের Rockstar, Jab Tak Hai Jaan, Yeh Jawani Hai deewani, Haider প্রভৃতি সিনেমা রয়েছে। মূলত কাশ্মীরের চমৎকার প্রকৃতি এবং এর মোহময়ী রূপের কারণে এখানে যুগে যুগে ছুটে এসেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা। আর এমনই একটি চলচ্চিত্র ছিল “বেতাব”, ১৯৮৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ছিল তৎকালীন সময়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বৃহত্তর পরিসরে নির্মিত সিনেমা। সানি দেওল আর অমৃতা সিং অভিনীত এই সিনেমার শুটিং হয়েছিল কাশ্মীরের পাহেলগাম এর এই ভ্যালী’তে। সেই স্মৃতি চিরস্থায়ী করতে এই ভ্যালীর নামকরণ করা হয়েছে বেতাব ভ্যালী। এখানে বেশ কিছু আনন্দঘন সময় কাটালাম। সম্মুখে তিনদিকে পাহাড় আর পেছনে তৃণভূমি ঘেরা এই ছবির বেঞ্চে একাকী বসে ছিলাম বেশকিছুটা সময়, কানে হেডফোনে বাজছিল জাগজিৎ সিং এর প্রিয় কিছু গজল। বেতাব ভ্যালী থেকে বের হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল, এখান হতে কিছু হালকা খাবার খেয়ে নিয়ে রওনা হলাম আরুভ্যালী। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল আজ লেট লাঞ্চ হোক তব...।
বেতাব ভ্যালী হতে পাহেলগাও শহরের বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত আরু ভ্যালী পৌঁছতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। সেখানে পৌঁছে দেখা গেল ভ্যালী ঘুর দেখতে বেশ সময় লাগবে, সবচেয়ে ভালো হয় ঘোড়ায় সওয়ার হলে। প্রায় ১৩ কিলোমিটারের একটা ট্রেক আছে, এই ট্রেক ধরে পায়ে হেঁটে সারাদিনের একটা ট্যুর দিলে মাথা নষ্ট প্রাকৃতিক রূপের দেখা মিলবে। যার একঝলক কামাল ভাই, মিতা রয় আর শামিম ভাই দেখে এসেছেন; আমরা বাকীরা ভ্যালীর আশেপাশের প্রবেশমুখে ঘুরে বেড়ালাম। কাশ্মীরের সেরা চেইন আবাসিক হোটেল ‘গ্র্যান্ড মুমতাজ’ (চার তারকা) এর পাহেলগাও এর স্থাপনাটি এই আরু ভ্যালী’তেই অবস্থিত। সেই হোটেলের সামনের সবুজ মনে বসে কাটালাম পড়ন্ত দুপুর আর বিকেলের শুরুর সময়টা।
আরু ভ্যালী জম্মু-কাশ্মীরের আনানতাং জেলার অন্তর্গত জনপ্রিয় একটি টুরিস্ট স্পট। পাহালগাম শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত যা লিডডার নদী (Lidder River) থেকে ১১ কিলোমিটার উজানে। লেক আর পাহাড়ে ঘেরা সুবিস্তৃত তৃণভূমির জন্য এই জায়গা খুবই বিখ্যাত। উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালে বলিউডে আলোড়ন তোলা এবং অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি "হাইওয়ে"র শুটিং হয়েছিল এই আরু ভ্যালীতে। কলহই হিমবাহ (Kolhoi Glacier) এবং তাসার লেকে ট্রেকিং এর জন্য এটা বেসক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, কলহই হিমবাহ (Kolhoi Glacier) কাশ্মীরের সবচেয়ে বড় হিমবাহ। এই এখানকার শান্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ এবং চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর কয়েক লাখ পর্যটক এই আরু ভ্যালী ভ্রমণ করে থাকেন। এখানে প্রায় বিশটির মত এলপাইন লেক, পাহাড় চূড়া, তৃণভূমি রয়েছে। শীতে তুষারপাতের সময় এখানে স্কিয়িং করতে হিড়িক পড়ে যায় পর্যটকদের মাঝে। নদী তীরে অবকাশ যাপন, যাদের শারীরিক সক্ষমতা আছে তাদের জন্য ট্রেকিং, হাইকিং। বাকীদের মন খারাপ করার কিছু নেই, তাদের জন্য রয়েছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা। এছাড়া এখানেই অবস্থিত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০-৫৪২৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত প্রায় ৫১১ কিমি বিস্তৃত অভেরা-আরু সংরক্ষিত বনাঞ্চল (The Overa-Aru Biosphere Reserve) যেখানে বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় এবং দুর্লভ প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়।
আরু ভ্যালী হতে আমরা ছুটলাম ফের হোটেলের দিকে। শেষ বিকেলে এক কাশ্মীরী রেস্টুরেন্টে কাশ্মীরী খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিয়ে পায়ে হেঁটে পাহেলগাও শহর দেখতে দেখতে হোটেলের দিকে রওনা হলাম, সেই ‘হোটেল আবসার’। এই হোটেলটা ২০১৪ সালের "বেষ্ট বাজেট হোটেল ইন পাহেলগাও" অ্যাওয়ার্ড উইনার ছিল।

আসুন দেখে নেই আরুভ্যালী'র কিছু মন ভালো করা ছবি; যেগুলো তুলেছিলাম আমাদের এই ট্যুরের সবাই মিলে। 

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ