অবশেষে পৌঁছলুম পাহেলগাও!!!

মুঘল রোড ধরে গাড়ী যত এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। অবিশ্বাস্য সব রাস্তা, সুউচ্চ সব পাহাড়ের গাঁ কেটে কেটে তৈরি, একদিকে সুবিশাল পাহাড় খাড়া উপরে উঠে গেছে, আরেক প্রান্তে অনেক অনেক নীচে পাথুরে নদী বয়ে চলেছে। সেই অপার্থিব দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন ঘোর লাগা মোহে আচ্ছন্ন সবাই, তখন হয়ত এক ভয়াল বাঁক ঘুরে আমাদের গাড়ী সবাইকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ভয়ে কলজে শুকিয়ে যায়, দোয়া দুরুদ পড়ে নেই মনে মনে। কিন্তু প্রকৃতির এই অবিশ্বাস্য রূপের জাদু হতে কতক্ষণ মনকে ভুলিয়ে রাখবেন গতকাল বেশ কিছু এলাকার নাম দিয়ে জম্মু থেকে কাশ্মীর যাওয়ার পথ বাতলে ছিলাম।
কাশ্মীর থেকে ফেরার আগের দিন আমাদের ড্রাইভার সাহিলের কাছ থেকে জম্মু-কাশ্মীর ফোর লেন হাইওয়ে ধরে যে রুট, সেটার এবং মুঘল রোড ধরে যে রুট সেটা, দুটোরই সংক্ষিপ্ত রুট ম্যাপ লিখে এনেছিলাম আমার পরবর্তী ভ্রমণ সাথীদের জন্য। রুট দুটি এমনঃ হাইওয়ে রুটঃ জম্মু (তাওয়াই) রেল ষ্টেশন > উদামপুর > পাতনিটপ > বাতুতথ > রামবান্ধ > বানিহালদধ > কাজিগুনদধ > আনানতনাগ > শ্রীনগর। আর অন্যটি হল মুঘল রোড দিয়েঃ জম্মু (তাওয়াই) রেল ষ্টেশন > আখনুর > রাজৌরি > সারদাহ (দরগা) > বাফলিয়ায > সিপিয়াহন > আনানতনাগ/শ্রীনগর > শ্রীনগর দুপুরের লাঞ্চ করার জন্য আমরা যাত্রা বিরতি করলাম একটা লোকালয়ে, বেশ বড় বাজার এলাকা, হাইওয়ে ওখান থেকে দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে। নামটা মনে পড়ছে না, তবে তা রাজৌরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। তখন দুপুর একটা হবে, আমাদের গাড়ী থামল রাস্তার পাশের বেশ কিছু লাগোয়া ধাবা’র নিকট। এই দুইদিনের ভেজ খাবারের এলাকা পেড়িয়ে আমরা এখন মুসলিম প্রধান এলাকায় চলে এসেছি, তাই ননভেজ আইটেম পাওয়া গেল। মুরগীর ঝোল, বাঁধাকপির একটা সবজি, ডাল সাথে টমেটো’র সালাদ। আমি ফ্রেশ হওয়ার জন্য খুঁজে পেতে মসজিদে চলে এলাম একা একা, ভোরবেলা সেই ‘মানিব্যাগ হারানো’ আর ‘হাওয়া গারাম’ এর টেনশনে নিজের শরীরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মসজিদ মুল রাস্তা হতে পেছনের দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া পথের মাঝামাঝি, রাস্তার ডান পাশে। বছর বিশেকের এক ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। ‘কোথা থেকে এসেছি?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘বাংলাদেশ’ বলতেই মুখে একটা স্মিত হাসি খেলে গেল। সারা কাশ্মীরের জনগণ কি পরিমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ফ্যান চিন্তা করতে পারবেন না। আর সাকিব আল হাসান, সেখানকার মহাতারকা। সাকিব নিজে কখনো গিয়েছেন কি না জানি না, কিন্তু উনি ওখানে গেলে বিশাল হুলুস্থুল পড়ে যাবে, যেমনটা আগে শাহরুখ খান এদেশে এলে হত। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, যা দেখে এসেছি, তাই বলছি। আর হ্যাঁ, বাংলাদেশকে তারা নিজের বন্ধু বলে মনে করে। ‘আরে ইয়ার, তুম মেরে ভাই হো’ এই কথা বলা হাস্যমুখ কত কাশ্মীরি ছেলে-যুবা এগিয়ে এসেছে কথা বলতে...
সহজ সরল কাশ্মীরিদের জন্য দুঃখ হয়, একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এদের প্রাপ্য ছিল। এরা না ভারতের সাথে সুখে আছে, না পাকিস্তানের সাথে মিশে স্বস্তি পেত। ধর্মের নামে এদের ব্যবহার করে কিছু কট্টরপন্থী, উগ্রবাদী। সাথে রয়েছে প্রকৃতির নির্মমতা, গেল এপ্রিলের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পরেছিল এই পাহাড়ি জনপদ। শীতে প্রায় চারমাস থাকে জনজীবন থমকে, এর সাথে রয়েছে গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে জম্মুর সাথে একই প্রদেশের অংশীদার হওয়া। সম্পূর্ণ বৈপিরত্যের দুটি জনগোষ্ঠী যারা একে অপরকে দুচোখে দেখতে পারে না, অথচ প্রতিবেশী একই প্রদেশের। এই কিছুদিন আগেই এক গরু খাওয়াকে কেন্দ্র করে কত ঘটনা ঘটে গেল, কত মারামারি খুনাখুনি। বেতাবভ্যালী’তে আমাদের এক গাইড সুন্দর বলেছিল, ‘খোদা কি কিতনা নিয়ামাত হামলোগ কি পাস হ্যাঁয়। জাফরান, আপেল, আখরোট, আঞ্জীর, পাশমিনা... উসকে সাথ ধারতি কা খুবসুরাত নাজারা... লেকিন এক তারাফ ঠাণ্ড অর বারিশ ক্যা ঢল আর দুসরী তারাফ ইয়ে পলিটিক্যাল ইস্যুস... কাভি হামলোগ কো শের উঠাকে জিনে নাহি দেতা’। জম্মু-কাশ্মিরের বিদ্বেষ প্রথম টের পাই এদিন লাঞ্চের সময়, স্থানীয় এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার সময়। আমরা কীভাবে বাংলাদেশ থেকে এসেছি সেটা জানতে চাইলে আমি বিস্তারিত বলতে বলতে যখনই বললাম ‘জম্মু হতে...’; আমার কথা শেষ হতে না দিয়ে বলল, ‘খবরদার এখানে জম্মুর নাম মুখে এনো না’। আরও বেশ কয়েকবার আমি বিভিন্নজনের মুখ থেকে এমন কথাই শুনেছি। আমার তখন ব্রিটিশ আর তৎকালীন এদেশীয় রাজনীতিবিদদের গালি দিতে মন চাচ্ছিল। তাদের কল্যাণে আজ সারা উপমহাদেশ জুড়ে এমন অসন্তোষ ডুকরে মরে। বাংলা, পাঞ্জাব, কাশ্মীর এমন আরও বহু জনপদ।
যাই হোক ভ্রমণের গল্পে ফেরত যাই। দুপুরের লাঞ্চ সেরে আমরা রওনা হলাম ফের ঐ মায়াবী পথসকল ধরে পাহেলগাও এর পথে। চারিধারের এই অপার্থিব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ফুডুগিরাপারেদের কি দৌড়ঝাঁপ। জ্বী হ্যাঁ, গাড়ীর মাঝেই দৌড়ঝাঁপ, তাও মূলত মিতা রয়ের। বেচারা এই ট্যুরে একটা ডিএসএলআর সাথে দুটো পুঁচকে ক্যামেরা নিয়ে এসেছে কি না। অন্যদিকে গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার কামাল ভাই আর মুক্তার ভাই নীরবেই কাজ সারছেন; মুক্তারকে দেয়া হয়েছে ড্রাইভারের পাশের সামনের আসনটি, সে মহাসুখে ছবি তুলছে, কখনো ক্যামেরায়, কখনো মোবাইলে, কখনো সেলফি স্টীক দিয়ে। কামাল ভাই চুপচাপ জানালার কাঁচ একটু সরিয়ে ক্যামেরার লেন্স বাইরে বের করে দিয়ে ছবি তুলে নিচ্ছেন। পাহাড়ের উপরে তাপমাত্রা ছিল খুব কম, আর চলন্ত গাড়ীতে ঠাণ্ডা বাতাস, জানালা খুললেই ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মত অবস্থা। যেহেতু আমাদের গাড়ী পাহাড়ি রাস্তা ধরে ঘুরে ঘুরে উঠছিল, কখনো নামছিল, ফলে জানালার এপাশে সব চমৎকার ভিউ তো অন্য পাশে খাড়া পাহাড়ের জমাট দেয়াল। এই নিয়ে চলছিল ফটোগ্রাফারদের দৌড়ঝাঁপ। আমি একসময় বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘গাড়ীতে মোট নয়টা উইন্ডো সাইড আসন আছে, আপনার সেগুলো হতে আসন পছন্দ করে আমাকে যে কোন একটা সিট দিলেই হয়’, খালি গাড়ী থেকে নামায়া দিয়েন না। তাহলে এই পাহাড়ের দেশ হতে বাংলাদেশ যেতে যেতে বুড়ো হয়ে যাব'। ইয়ে, এইটুকু মনে মনে বলছি।
বিকেল নাগাদ শেষ হল সেই পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছুটে চলা, একটা গ্রামে যাত্রা বিরতি হল। দলের সবাই হালকা-ভারী যা হওয়ার দরকার হয়ে নিলেন। সাহিলের কাছ থেকে জানা গেল আরও ঘণ্টা চারেক লাগবে! তাই বেশকিছু ড্রাইফুড, চকলেট আর পানি নিয়ে রওনা হলাম পাহেলগাও’র দিকে। যে জায়গা হতে শ্রীনগর আর পাহেলগাও যাওয়ার রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে, সেখানে পৌঁছানোর পর পড়লাম জ্যামে। সাহিল নানান পথ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের রাত নয়টার কাছাকাছি নিয়ে পৌঁছল স্বপ্নের শহর পাহেলগাও। সরাসরি হোটেল ‘আবসার’ এর কম্পাউন্ডে গাড়ী হতে নামতেই হোটেলের ম্যানেজার এগিয়ে এল, পরিচয় দিতেই বলল, আমাদের দুজন গেস্ট ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছেন। বুঝলাম জুবায়ের ভাই আর ইয়াসমিন আপা, উনাদের তো বিকেলের আগেই পৌঁছানোর কথাই ছিল। আমি সবাইকে রুম বুঝিয়ে দিতে না দিতেই রুম সার্ভিস হতে প্রত্যেক রুমে কল চলে এল, ডিনারের জন্য ডাকছে, পুরো ট্যুর হোটেলের রেস্টুরেন্টেই আমাদের বুফে ব্রেকফাস্ট আর ডিনার বুকিং দেয়া ছিল। জুবায়ের ভাই আর ইয়াসমিন আপা স্টার্টার শেষ করে আমাদের জন্য বসে আছেন। তাই সবাই কোনমত তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলাম। খাওয়া পর্বের শেষে বোনাস ছিল ইয়াসমিন আপার কলকাতা হতে আনা বেশ কয়েকপদের মিষ্টি। এর মাঝে চলল গল্প এই কয়দিনের। আপনাদের সাথে একটা শেয়ার করি। রওশন আপা শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নেমে এজেন্টের কাউকে দেখতে পেলেন না, ইতিউতি খুঁজে কোথাও উনার নেমপ্লেটযুক্ত প্ল্যাকার্ড খুঁজে পেলেন না। এদিকে আমার এজেন্টের ‘হলিডে কনসালটেন্ট’ সুমায়রা জারগার আমায় ফোন দিয়ে দুপুরের পরপর বলেছে, ‘স্যার আপ কি ওয়াইফ হোটেল মে পৌঁছ গায়ি’। আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘নো ম্যাম, শি ইজ নট মাই ওয়াইফ, মেরা বাড়ি বাহেন হ্যাঁয়’। তো একই ভুল ছিল এয়ারপোর্টেও, বেশ কিছু সময় পর ইয়াসমিন আপা একটি প্ল্যাকার্ড দেখতে পান আমার মিসেস টাইটেল যুক্ত। উনিও হাসতে হাসতে শেষ...
ও হ্যাঁ, সুমায়রা জারগার সম্পর্কে এখন একটু বলি। সেলস পারসন হিসেবে তাকে শতভাগ মার্কস দিতে হবে। টানা দুই মাস বেচারাকে প্রচুর যন্ত্রণা দিয়েছি, এমন কি ঈদের (কুরবানি ঈদ) ছুটিতেও তাকে বিরক্ত করেছি। সে না থাকলে এই ট্যুর হয়ত হতই না। কম করে হলেও দশ বারো বার ট্যুর প্ল্যান এন্ড প্যাকেজ বদলেছি, একেবারে কাশ্মীর পৌঁছেও নাম্বার অফ পারসন চেঞ্জ করেছি। প্রাইস নিয়ে সারাদিন মেইলে বারগেইনিং করেছি, এতটুকু বিরক্ত হয় নাই। ফোনে তার কথা শুনে ভালো লেগেছে, আর সামনা সামনি দেখে পুরাই ফিদা! সেই গল্প যথাসময়ে বলা হবে। তো আর কি? ০৭ অক্টোবর রাতে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে অবশেষে ১০ অক্টোবর রাতে পৌঁছলাম স্বপ্নের কাশ্মীরে। টানা তিনদিন ট্রান্সপোর্টে রাত্রি যাপনের সাথে টানা ভ্রমণে সবাই ক্লান্ত ছিলাম, রাতের তাপমাত্রাও ঠাণ্ডা ছিল, ১২ ডিগ্রী। কম্বলের পুরু আস্তরণে মুড়ে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে সময় লাগে নাই। সাথে স্বপ্নে ছিল আগামীকালের দ্রষ্টব্য স্পটগুলোর রুপের হাতছানি... চান্দানওয়ারি, বেতাবভ্যালী, আরু ভ্যালী... (চলবে)
নীচের ছবি দুটোতে আমাদের টেম্পো-ট্রাভেলার এবং ড্রাইভার সাহিল

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ