গুলমার্গ এর পানে, গণ্ডোলা'র টানে

কাশ্মীর,কাশ্মীর শ্রীনগর,কাশ্মীর ভ্রমণ,শ্রীনগর ভ্রমণ, গুলমার্গ,কাশ্মীর গুলমার্গ,মিশন গুলমার্গ,বরফে মোড়া গুলমার্গ,শ্রীনগর টু গুলমার্গ,ভারত,ভূস্বর্গ কাশ্মীর,দর্শন,ভূস্বর্গ কাশ্মীর ভ্রমণ,kolkata to kashmir tour,kashmir tourist places,kashmir tourist attractions,gulmarg,gulmarg kashmir,gulmarg skiing,gulmarg gondola,gulmarg cable car,gulmarg travel,gulmarg documentary,gulmarg trip,gulmarg tourism,kashmir gulmarg,gulmarg srinagar,
আরু ভ্যালী হতে শেষ বিকেলে পাহেলগাঁও শহরে পৌঁছে একটা ভালো মানের রেস্টুরেন্টের খোঁজ করতে ‘মিনা রেস্টুরেন্ট’ এ এই পড়ন্ত বিকেলেও লাঞ্চের আয়োজন বিদ্যমান পাওয়া গেল। ছিমছাম রেস্টুরেন্টে ঢুঁকে সবাই একে একে ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্টের টেলিভিশনে ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার খেলা দেখার ফাঁকে খাবারের অর্ডার করা হল; সাদা ভাত, মিক্সড সবজি, রোগান জোশ (কোপ্তা জাতীয় জনপ্রিয় কাশ্মীরি ডিশ) আর স্পেশাল কাশ্মীরি মাটন। খাবার তৈরি হওয়ার ফাঁকে রেস্টুরেন্ট লাগোয়া দোকানগুলোতে কেউ কেউ ঢুঁ মারল। খাবার দেয়ার পর সবাই সেই সুস্বাদু খাবারের স্বাদ চেখে নিলাম। কিন্তু, সমস্যা হল অনেকেই ভিন্ন স্বাদের এই মজাদার খাবারের সাথে নিজের জিহবা এবং রুচি’র সমন্বয় ঘটাতে পারলেন না ঠিক মত। আমি বাপু ব্যাটে বলে চমৎকার টাইমিং করে সমানে ছক্কা হাঁকিয়েছি।
পেট পুঁজো সমাপ্ত হল ছোট ছোট দলে সবাই এটা সেটা কেনাকাটা করে সময় পার করলাম। সেখান হতে প্রায় আধঘণ্টা পায়ে হেঁটে হোটেলে পৌঁছলুম আমরা। কামাল ভাইয়ের নেতৃত্বে মহিলাদেরকে আগেই পাঠিয়ে দিলাম হোটেলে। সন্ধ্যার পর আমরা পাহেলগাঁও এর নিয়ন আলোয় ঘোর লাগা রাজপথে হেঁটে বেড়ালাম। শীতের সন্ধ্যার হালকা কুয়াশা পরিবেশটাই অন্যরকম করে তুলল। হাঁটছি আর হাঁটছি, পথ আর ফুরায় না যেন। যখন ক্লান্তি আর ধৈর্যের শেষ সীমায় এলাম বলে, তখন আমরা আমাদের হোটেলের সংলগ্ন লোকালয়ে পৌঁছে গেলাম। চায়ের তেষ্টা ভালোই পেয়েছিল, পথের ধারের একটা রোড সাইড ক্যাফেতে বসে পড়লাম। কেউ চা, কেউ কফি, কেউবা লেমন টি; পুলাপানের চোখের ক্ষুধা তখনো মেটে নাই, পাকোড়া আর ভাঁজাপোড়া সাথে চলে এল। চা-কফি চলে এলে দেখি মনির সাহেব জায়গায় নেই। খোঁজ করতে খুঁজে পেলাম, ডাকাডাকিতে ফিরে এলেন ভাইজান। পাশের একটা গলি হতে বরযাত্রা বের হয়েছে, কাশ্মীরি লোকাল গান গেয়ে চলছিল তারা হেঁটে হেঁটে। সেটাই দেখে এসে ভাইজানের উক্তি, ‘কাশ্মীরি লারকি লোগ বহুত খুবসুরাত হ্যাঁয়’ ;) :P ।
যাই হোক, চা পান পর্ব শেষ করে হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে ফিরে রিসিপশনের পিসি’তে বসে পড়লাম ম্যানেজার’কে নিয়ে। ইয়াসমিন আপা আর আনিসের এয়ার টিকেট যোগাড়ের নিমিত্তে। ঘণ্টাখানেকের অন্তর্জাল ভ্রমণে কাটাবার ফাঁকে হোটেল ম্যানেজারের সাথে অনেক গল্প হল। পাহেলগাও আসার আগে এই ‘হোটেল আবসার’ নিয়ে বেশ কিছু নেগেটিভ রিভিউ পড়েছিলাম ‘ট্রিপ এডভাইজার’ এ। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে সে প্রতিটি রিভিউ লেখক সম্পর্কে বলল। একজন এসেছিল অফসিজনে, যখন হোটেল প্রায় বন্ধ ছিল, একজন মাত্র টেককেয়ার স্থাপনার দেখভাল করছিল সাথে একজন ক্লিনার। অন রিকোয়েস্টে তাকে রুম দেয়া হয়, কিন্তু রুমে চেকইন করার পর উনি যে সব রেগুলার সার্ভিস চাচ্ছিলেন, তা ঐ মোমেন্টে প্রদান করা সম্ভব ছিল না। আরেকজন ইকোনমি রুমে চেকইন করে লাক্সারি সার্ভিস আইটেম ডিমান্ড করে রিফিউজ হয়ে ক্ষিপ্ত! কথাগুলো মিথ্যে মনে হয় নাই, কারণ চমৎকার এই হোটেল সম্পর্কে ঐ নেগেটিভ রিভিউগুলো’র প্রায় কোনটাই বাস্তবিক খুঁজে পাই নাই। হ্যাঁ, ফার্নিচার একটু প্রাচীন এটা ঠিক। কথা প্রসঙ্গে তার চাকুরী, বেতন এগুলো নিয়েও কথা হল। দুনিয়ার সকল কর্মজীবীর ন্যায় সে ও নিজের চাকুরী নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, ভালো কিছু পেলেই চলে যাবে।
রাতের খাবার শেষে আর কিছু করার ছিল না। দশটার পর কিচেন বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিশেষ অনুরোধে আমাদের জন্য চা পরিবেশন করা হল। কাপ ভর্তি চা নিয়ে আড্ডা আরেকটু বর্ধিত হল। রুমে ফিরে সবাই ওয়াইফাই এর পাসওয়ার্ড নিতে ব্যস্ত হয়ে গেল, সাথে আমার মোবাইল। ও হ্যাঁ, বলা হয় নাই, কাশ্মীর পৌঁছে সাহিল আমাকে তার একটি সিম দিয়ে দেয় ভ্রমণকালীন সময়ের জন্য। সেই সিমে রিচার্জ করতে না করতেই ব্যালেন্স শেষ হয়ে যায়। ;) আমি কিন্তু পুরো ট্যুরে (১৬ দিনে) দুদিন মাত্র ঢাকায় ফোন করেছি। এক এক করে সবাই এক দুই মিনিটের জন্য দেশে কথা বলে যায় আমার কাছ থেকে সেট নিয়ে। সাথে কারো কারো বাসা থেকে দিনে কয়েকবার ফোনও আসে! আমরা বড় হব কবে?:Pতাপমাত্রা গতকালের চেয়ে আরও একটু কম ছিল, সাথে সারাদিনের ভ্রমণের ধকল। ফলে রাত্রিতে ঘুম ভালই হল সকলের। সকালে সাতটার মধ্যে সবাই ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিল, রাতেই সবাইকে ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল। সাহিল সাতটার দিকে গাড়ী নিয়ে হাজির হলে আমরা রওনা হলাম গুলমার্গের উদ্দেশ্যে। 

আমাদের দুঃখ, আমরা শীতের আগে আগে রওনা দিয়েছিলাম কাশ্মীর, ফলে গুলমার্গের বিখ্যাত বরফের সৌন্দর্য আর স্কিয়িং হতে বঞ্চিত হতে হয়েছে। এই ব্যাপারে একটা পত্রিকার রিপোর্ট তুলে দিলাম হুবুহু..."নতুন বছরের শুরুতে যখন তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কয়েক ধাপ নিচে, তখন কয়েক হাজার উত্সাহী পর্যটকের উষ্ণতায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ গুলমার্গ। অনেকদিন পর, সমুদ্রপৃষ্ঠের আট হাজার ফুট উঁচুতে বরফে ঢাকা এই রিসোর্টে এসে ভিড় জমাল হাজারো পর্যটক। হোটেল আর গেস্ট হাউসগুলো এখন কানায় কানায় ভরা। জম্মু-কাশ্মীরের বারামুলা জেলার ছোট্ট একটি হিল স্টেশন এই গুলমার্গ। কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে এবং আট হাজার ৮২৫ ফুট উপরে এই হিল স্টেশনে গেলে দ্বিধা সৃষ্টি হবেই, স্থানটি গুলমার্গ নাকি সুইজারল্যান্ডের কোনো বরফঢাকা অচেনা শহর। এর ইতিহাস সম্পর্কে ঘাঁটতে গিয়ে দেখা যায়, রাজা ইউসুফ শাহ চাক এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের পছন্দের অবকাশযাপনের স্থান ছিল এই গুলমার্গ। এই বরফপর্বতের আগের নাম ছিল ‘গৌরিমার্গ’। হিন্দু দেবতা শিবের স্ত্রীর নামে এই পর্বতের নাম রাখা হয়েছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে ওই নাম এক সময় হয়ে যায় গুলমার্গ এবং এখন সবাই একে ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ হিসেবেই চেনে। শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় সুইজারল্যান্ডে। ওখানেই আছে ‘গুলমার্গ গন্ডোলা’, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু কেবল কারের মধ্যে একটি এটি। যা তিন হাজার ৭৯৭ মিটার উঁচু পর্যন্ত উঠতে পারে। এই সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই গুলমার্গে এমন ভিড় দেখা যায়। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা কাশ্মীরের এই বরফঢাকা শহরে এসে একে সুইজহারল্যান্ড ভেবে ভুল করে। তারা এসে ভুলে যায় নগর জীবনের ব্যস্ততার কথা, স্কি করে আর তুষারশুভ্র পরিবেশ দেখে অনেকেই ভুলে যায় খরচ-খরচা আর নগর জীবনে ফিরে আসার কথা। কিন্তু বহুদিন ধরেই জম্মু-কাশ্মীরের অস্থিরতা এবং জঙ্গি উপদ্রবের কারণে পর্যটকরা এই ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ডে’র দিকে আসতে উত্সাহ পাচ্ছে না। কিন্তু এবারের চিত্রটি ছিল ব্যতিক্রম। এবারে গুলমার্গে পর্যটকদের ভিড় দেখে বিস্মিত খোদ জম্মু-কাশ্মীরের পর্যটন অধিদফতরের প্রতিমন্ত্রী নাসির আসলাম। তিনি বলেন, ‘গুলমার্গে এত ভিড় আমি আগে কখনও দেখিনি। আমি চাইব পর্যটকদের জোয়ার কখনও যেন শেষ না হয়।’ গুলমার্গে রয়েছে সুইজারল্যান্ডের মতোই স্লেজিং এবং স্কিইংয়ের ব্যবস্থা। গুলমার্গ উন্নয়ন পর্ষদের চিফ এক্সিকিউটিভ জানিয়েছেন, গুলমার্গের হোটেলগুলো এখন একশ’ শতাংশই ভরা। তবুও এখনও আসছে অনেক বিদেশি পর্যটক। অনেকে নিজেদের ব্যবস্থা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফিরে যাচ্ছে।" - ‘এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ গুলমার্গ"ঃ ০২ জানুয়ারী ২০১২, আমার দেশ (অনলাইন সংস্করন)'



পথে একটা মশলার দোকানে যাত্রা বিরতি হল, সেখানের লাগোয়া এক ফুটপাথের দোকানি হতে পান করলাম বিখ্যাত ‘খাহওয়া’ নামক জাফরান আর বাদাম মিশ্রিত দারুণ এক পানীয়। অনেকেই সেখান হতে জাফরান, মধু, বাদাম, কিশমিশ, এলাচি সহ নানান রকম মশলা কেনাকাটা করে নিল। দোকানটি খুব প্রসিদ্ধ ছিল, কারণ আমাদের থাকাকালীন সময়েই নানান দেশীয় পর্যটকদের আনাগোনা দেখলাম সেখানে, সাথে সেই বিখ্যাত ‘খাহওয়া’ পান করা। সাময়িক বিরতির পর আমরা ফের চলা শুরু করলাম গুলমার্গের দিকে।

সেদিন ছিল গুলমার্গে হরতাল তথা বন্ধ, কিন্তু কোন ঝামেলা ছাড়াই আমরা গুলমার্গ পৌঁছেছি। পথে দুপুর হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চ সেরে নিলাম রেস্টুরেন্ট ‘ডাউনহিল’ এ। এখানে আমি পছন্দ করলাম কাশ্মীরি বিরিয়ানি, অন্যরা চিকেন আইটেম, কেউ কেউ চাউমিন আর স্যুপ। খাওয়া-দাওয়া শেষে রওনা হলাম গুলমার্গ, যেখানে রয়েছে পৃথিবীর উচ্চতম গণ্ডোলা রাইড। কিন্তু তখনও কি জানতাম দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়ছে না.... :(( 

আসুন আজ আর দুঃখের গল্প না শুনিয়ে আমাদের ভ্রমণসাথীদের তোলা কিছু ছবি দেখিঃ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ