গুলমার্গে যেদিন এলাম সেদিন ছিল বন্ধ, যথারীতি পরেরদিনও তা অব্যাহত ছিল। আমাদের ড্রাইভার সাহিল চাইছিল খুব ভোরে রওনা হয়ে যেতে গুলমার্গ থেকে কাশ্মীরের দিকে। প্রথমে প্ল্যানিং ছিল নয়টা নাগাদ যদি গণ্ডোলা খুলে, তবে সেখানে ঢুঁ মেরে যাওয়ার। কিন্তু আগেরদিন বিকেলেই কনফার্ম হয়েছিলাম এদিনও পৃথিবীখ্যাত “গুলমার্গ গণ্ডোলা” বন্ধ থাকবে, তাই সাহিলের পরামর্শ মতে সকাল সকাল হোটেল থেকে চেক আউট করে রওনা হয়ে গেলাম শ্রীনগরের দিকে।
গুলমার্গ থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটারের মত, সময় লাগে ঘণ্টা দুয়েকের মত। কিন্তু পথিমধ্যে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম একটা আপেল বাগানে। সেখানে সবাই ফটোসেশনের সাথে খেলাম তাজা আপেল, ফ্রিতে! বাগান মালিক এবং তার কর্মচারীরা গাছ হতে আপেল পেড়ে কাঠের বক্সে প্যাকিং করছিল বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ডেলিভারি দিতে।
এই বাগানেই ছিল একটা ড্রাই-ফ্রুট’র দোকান, সেখান হতে সবাই কমবেশি কেনাকাটা করলাম। আমি ভিন্ন ভিন্ন পদের মিশ্রনে চার কেজির মত শুকনো ফল কিনে নিলাম, সাথে এক কৌটো বিখ্যাত কাশ্মীরি পানীয় ‘কাহওয়া’ এর ড্রাই ক্রাশড ইনগ্রেডিয়েণ্ট। ড্রাই ফ্রুটের মধ্যে ছিল আপেলের আমসত্ত্ব, আঞ্জির, আখরোট, আলমন্ড, ব্ল্যাকবেরি, কিশমিশ ইত্যাদি।
সেখানে ঘণ্টাখানেকের বেশী সময় কাঁটিয়ে আমরা ফের যাত্রা অব্যাহত রাখলাম শ্রীনগরের পানে। শ্রীনগর শহরের কাছে পৌঁছেতে দেখা মেলল চমৎকার সব নকশাদার আর ঢালু ছাঁদবিশিষ্ট বাড়িঘর। শহরে ঢোকার মুখে পড়লাম ট্র্যাফিক জ্যামে। এদিন আমাদের প্ল্যানিং এ ছিল লাঞ্চ করব অতি বিখ্যাত “মুঘল দরবার” রেস্টুরেন্টে বিখ্যাত ডিশ ‘ওয়াজওয়ান’ দিয়ে। সাহিল গাড়ী নিয়ে পার্ক করল রেস্টুরেন্টের উল্টোদিকের রাস্তার পার্কিং এরিয়ায়। যাওয়ার আগেই রেস্টুরেন্টের ওয়েবসাইট থেকে জেনেছিলাম, একই ভবনের নীচতলায় যে মুঘল দরবার নামক রেস্টুরেন্ট রয়েছে তা আসল মুঘল দরবার নয়, আসলটা দ্বিতীয়তলায় অবস্থিত। মজার ব্যাপার না! ওখানে গিয়ে মালিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বলল মামলা চলছে!
লাব্বি কাবাব
|
ওয়াজাচিকেন
|
রিশতা
|
তাবাকমাজ
|
রেস্টুরেন্টের দোতলায় উঠে দেখা মিলল রেস্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মাদ ইব্রাহীম মুগলো’র সাথে। উনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো, ফাঁকে ছবিও তুলে নিলাম। নীচের ছবিতে ভ্রমণ সঙ্গী মুক্তার হোসেন এর সাথে ইব্রাহীম মুগলো সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টে ঢুঁকে অর্ডার করা হল পৃথিবীখ্যাত কাশ্মীরি ডিশ ‘ওয়াজওয়ান’ এর। এটা মূলত একটা কমপ্লিট মিল প্যাকেজ, রাইস-ফ্রাই-কারি সব কাশ্মীরি আইটেম। রাইস, লাব্বি কাবাব (শিককাবাব বিশেষ), তাবাকমাজ (খাসীর চাপ এর ফ্রাই), ওয়াযা চিকেন (বিশেষ চিকেন ফ্রাই), রিশতা (কোপ্তা বিশেষের কারি), গোশ্ততাব (এটা হল কোপ্তা জাতীয় কোরমা কারি), রোগান জোশ প্রভৃতি আইটেম নিয়ে এই ওয়াজওয়ান ডিশ তৈরি হয়। পরিমানে এতো বেশী থাকে যে দুজনের একটা ডিশ দিয়ে চার-পাঁচ’জনের অনায়াসে লাঞ্চ হয়ে যায়।
গোস্তাব
|
সবকিছু মিলে একত্রে
|
ওয়াজওয়ান
|
ফালুদা
|
আমরা দশজনে দুটা ফুল ডিশ এর সাথে এক্সট্রা রাইস নিয়েছিলাম, ভরপেট খাওয়া হয়েছিল। জনপ্রতি ওয়াজ্বান ডিশ হাজার থেকে পনেরশ রুপী চার্জ হয়। আমাদের সিস্টেমে খেলে জনপ্রতি পাঁচশ রুপীতে হয়ে যাবে। খাওয়া শেষে ফ্রুট ফালুদা খেলাম সবাই।এই ভদ্রলোক (হোটেলের পরিচারক) চমৎকারভাবে দুইটা ফুল ওয়াজওয়ান আমাদের মাঝে সময় নিয়ে পরিবেশন করেছিলেন, যা একটি দেখার মত বিষয় ছিলঃ
সাধারণত কাশ্মীরি এই ওয়াজওয়ান পরিবারের সবাই মিলে এক থালিতে একসাথে খাওয়া হয়। রেস্টুরেন্টে সেই ব্যবস্থাও করা ছিল। ইয়াসমিন আপা একটি পরিবারের সেই রকম ভোজন ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন উনাদের অনুমতি নিয়ে।
আর বের হওয়ার আগে আমি মোঘল রেস্টুরেন্টের বেকারি কর্নার হতে বিকেলের নাস্তা হিসেবে কুলচা, কাকচা, নানখাতাই, কাশ্মীরি ফ্রুট কেক, কোকোনাট বিস্কিট কিনে নিয়ে রওনা হলাম নাগিন লেকের উদ্দেশ্যে।
নাগিন লেকে পৌঁছে বিশেষ কাশ্মীরি নৌকা ‘শিকারা’ করে সংক্ষিপ্ত নৌভ্রমণ করে গিয়ে পৌঁছলাম আমাদের একরাত্রের নিবাস, ২০১৪ সালের ‘বেষ্ট হাউজ বোট’ এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত হাউজবোট ‘ওয়াঙ্গনু হাউজবোট’এ। উল্লেখ্য যে, শ্রীনগর ভ্রমণে এসে এই হাউজ বোটে রাত্রি যাপন করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনোমোহন সিং। আসুন দেখি সেই হাউজবোটের ভেতর-বাহিরের কিছু ছবিঃ
মুক্তার ভাউ উনার সেলফি স্টিক হাতে হাউজবোটের ড্রয়িংরুমে যেখানে বসেছিল সন্ধ্যার পর এক জম্পেশ আড্ডা। সাথে হাউজবোটের চারিপাশ হতে নেয়া কিছু ছবিঃ
যাই হোক, আমাদের সামনে রইল সৌন্দর্যের রানী নাগিন লেক, সাথে দুটো হাউজবোটের পুরোটা আর আমরা দশজন ভ্রমণ সাথী; আর হ্যাঁ সারাটা বিকেল, সন্ধ্যা লগণ আর একটা মায়াবী রাত।