গুলমার্গ পৌঁছে হোটেলে চেকইন করে সবাইকে রুম বুঝিয়ে দেয়ার পর রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নিলাম গণ্ডোলা’র টিকেটের। চাইলে আগে থেকে ‘গুলমার্গ গণ্ডোলা’র ওয়েবসাইট হতে টিকেট কেটে রাখা যায়। যেহেতু তখনো স্কিয়িং এর সিজন শুরু হয় নাই, তাই ওখানে পৌঁছেই টিকেট করার প্ল্যান ছিল। কিন্তু ম্যানেজার বলল, রিপেয়ার এন্ড মেইনটেনেন্স এর জন্য সেদিন গণ্ডোলা বন্ধ, কিন্তু আরেকজন বলল ফেইজ ১ খোলা আছে। টেনশনে পড়ে গেলাম, ট্যুর মেম্বারের সবাই বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া দেখতে আগ্রহী। প্ল্যান ছিল ফেইজ ২ ধরে ‘আফারওয়াত পিক’ এ যাওয়া, সেখানে তখন বরফ ছিল। আমাদের হোটেল থেকে গণ্ডোলা ষ্টেশনের দূরত্ব হাঁটা পথে বড়জোর মিনিট দশেকের পথ। সবাই মিলে রওনা হলাম সেখানে, গিয়ে দেখি দুটো ফেইজই বন্ধ! প্রথমে জানলাম আগামীকাল খোলা থাকবে, কিন্তু পরে জানা যায় আরও তিন-চার দিন বন্ধ থাকবে। সবার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। কি আর করা...
জম্মু-কাশ্মীর প্রাদেশিক সরকারের পর্যটন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১৯৮৭ সালে কাজ শুরু হয় ‘গুলমার্গ গণ্ডোলা’র নির্মাণ কাজ, যা পৃথিবীর উচ্চতম ‘গণ্ডোলা’ তথা কেবল কার। যার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ফ্রেঞ্চ কোম্পানি M/S Pomagalski বরাবর। এখানে তিনটি ফেইজ রয়েছে, ফেইজ ০১ ও ফেইজ ০২ এবং চেয়ার লিফট এর ফেইজ ৩। ফেইজ ০১ যায় গুলমার্গ থেকে কংডোরি পর্যন্ত, ফেইজ ০২ যায় কংডোরি থেকে আফারওয়াত পিক পর্যন্ত। আর ফেইজ ০৩ তথা চেয়ার লিফট যায় কংডোরি থেকে মেরি সোল্ডার পর্যন্ত। বর্তমান টিকেট মুল্য ফেইজ ০১ এর ৬০০ রুপী ফেইজ ০২ এর জন্য্য ৮০০ রুপী আর চেয়ার লিফট ৩০০ রুপী; ৩ বছরের কম বয়েসি বাচ্চার জন্য ফ্রি। আফারওয়াত পিক থেকেই মূলত স্কিয়িং করা হয়। আরও বিস্তারিত তথ্য পাবেন এখানেঃ
গুলমার্গ গণ্ডোলা
শেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘পনি রাইড’ অর্থাৎ ঘোড়ায় চড়ে গুলমার্গ ঘুরে দেখার। আগে থেকেই কাশ্মীরের এই পনি রাইড এর লোকদের কুকীর্তি সম্পর্কে অনেক জেনে গেছি। ফলে দরদাম করতে সুবিধা হল। দুই ঘণ্টার রাইডে ০৬টা স্পট ঘুরে দেখাবার জন্য ১৮০০ রুপী জনপ্রতি চাইল, দরদাম করে ৬০০ রুপী’তে দফারফা হল। একে একে দলের আটজন ঘোড়ায় চড়ে বসল, ইয়াসমিন আপা আগেই বলেছিলেন উনি পনি রাইড চড়বেন না। আর বোকা মানুষের স্লিম বডি নিয়ে ঘোড়ায় উঠতে গিয়ে পায়ের মাসলে টান লাগলে ঐ আটজনের দলই রওনা হল গুলমার্গ কিছুটা ঘুরে দেখার।
আমি হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নেয়ার মনঃস্থির করলাম, ইয়াসমিন আপা বের হলেন পায়ে হেঁটে চারিপাশ ঘুরে দেখতে। মন খারাপ হল খিলানমার্গ, আলপাথের লেক এবং ফিরোজপুর নাল্লা না দেখতে পাওয়ার জন্য। আসলে কাশ্মীর বেড়াতে এলে পাহেলগাও চারদিন, গুলমার্গ তিনদিন আর শ্রীনগর তিনদিন। এরসাথে সোনমার্গ আর ইয়ুসমার্গ এর জন্য আরও দুতিনদিন। মোট ১২ দিন কাশ্মীরে অবস্থান করলে সবচেয়ে ভাল হয়। এর জন্য যেটা জরুরী, সেটা হল সময় আর অর্থের অতিরিক্ত যোগান। নইলে কাশ্মীর ঘুরে আসার পর বলতে হবে, আরে এটা তো দেখা হয় নাই! বিমানে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে শ্রীনগর আপ-ডাউন করলে মোট ১৫ দিনের একটা সেই লেভেলের ট্যুর হবে, ভালোমানের (ডিলাক্স বাট নট লাক্সারি) হোটেলে থাকাখাওয়া সাথে সার্বক্ষণিক গাড়ী... খরচ একটু বেশী হলেও রিজেনবল, ৬০-৮০ হাজার বাংলাদেশী টাকা। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, ২০,০০০ টাকায়ও কাশ্মীর ভ্রমণ সম্ভব, সেটা সিরিজের শেষে পোস্ট আকারে আলোচনা করা হবে।
আসুন গুলমার্গ এর কিছু দ্রষ্টব্য স্থান সম্পর্কে জেনে নেই। গুলমার্গ শহরটি, ভারতের সুদূর উত্তর প্রান্তের রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত। এটি এক অতুলনীয় সুন্দর শহর, যা শীতের সময় তার স্কিইং ঢালের জন্য বিখ্যাত এবং গ্রীষ্মকালে সুন্দর তৃণভূমি ফুলে প্রাঞ্জল বলে মনে হয়।
বাবা রেশির পবিত্র আধার (সমাধি)
বাবা রেশি জিয়ারাত নামেও পরিচিত, এই পবিত্র আধারটি বাবা রেশির সমাধিস্থল, ইনি একজন শ্রদ্ধেয় মুসলিম সন্ত ছিলেন। বাবা রেশি, কাশ্মীরের রাজা জৈন-উল-আবেদিন-এর সভাসদ ছিলেন। সমাধিটি প্রায় 500 বছরের পুরনো। গুলমার্গ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, জায়গাটি বেশ শান্তিপূর্ণ এবং সুন্দর এবং আপনি যদি বিনোদন চান তাহলে এই স্থানটি হল নিখুঁত।
সেন্ট মেরী চার্চ
বহু বছর আগে এই মনোরম ক্ষুদ্র রোমান ক্যাথলিক গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল এবং এটি তার ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের জন্য পর্যটকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। গির্জাটি একটি ছোট গ্রামাঞ্চলের খ্রীষ্টান প্রার্থনা সভার মত দেখায়। এটি ধূসর বর্ণের পাথরের সঙ্গে নির্মিত এবং একটি সবুজ টালিকৃত ছাদ দিয়ে আবৃত। এটি খুবই সুন্দর এবং যে সমস্ত ভ্রমণার্থী ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিকতার একটি সম্মিলিত ছাপ অন্বেষণ করতে চান তাদের জন্য অবশ্য দ্রষ্টব্য।
গল্ফ কোর্স
গুলমার্গ গল্ফ ক্লাবের
গল্ফ কোর্স হল বিশ্বের বৃহত্তম সবুজ গল্ফ ক্ষেত্র এবং স্যার নেভিল চেম্বারলেইন কে.সি.বি দ্বারা ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভে প্রতিষ্ঠিত ক্লাবহাউস ভবনটি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গল্ফ ক্ষেত্রটি পেশাদার ও অপেশাদারদের জন্য উন্মুক্ত। গল্ফ ক্লাবটিতে ভাড়াও উপলব্ধ রয়েছে। সুতরাং পর্যটকরা যদি চান তবে একবার খেলার আনন্দও উপভোগ করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন গল্ফ ক্ষেত্রটি কেবলমাত্র গ্রীষ্মকালে সবুজাভ হয়ে ওঠে; শীতকালে এটি তুষারাবৃত থাকে।
গুলমার্গ গন্ডোলা
গন্ডোলায় চড়া এই শহরে পরিদর্শনাকারী পর্যটকদের জন্য এক আবশ্যক। এটি গুলমার্গ কোঙ্গডোরি ও অপহারওয়াত-এর নিদারুণ সৌন্দর্য্য উপলব্ধ করায়। এটি দুটি পর্যায়ে বিভক্ত রয়েছেঃ
প্রথমটি গুলমার্গ থেকে কোঙ্গডোরি যায় এবং দ্বিতীয়টি কোঙ্গডোরি থেকে অপহারওয়াত পর্যন্ত যায়। এখানে একটি চেয়ার লিফটও রয়েছে যেটি পর্যটকদের কোঙ্গডোরি থেকে মেরীর সোল্ডার পর্যন্ত নিয়ে যায়।
স্কিইং
অনেকে মনে করেন স্কিইং-এর জন্য গুলমার্গ হল ভারতের সেরা গন্তব্যস্থল। এমনকি সি.এন.এন, তার এশিয়ার সর্বোচ্চ পাঁচটি স্কি রিসর্টের তালিকায় গুলমার্গকে চতুর্থ স্থানে স্থাপন করেছে। গুলমার্গে স্কিইং সম্পর্কে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিষয় হল যে, ঢালগুলি খুব একটা কঠিন নয়, যার ফলে অনভিজ্ঞদের জন্য এটি খুবই সহজসাধ্য। এগুলি ছাড়াও, এখানে আপনার প্রয়োজনীয় স্কি সরঞ্জাম ভাড়া করার জন্য প্রচুর স্কি দোকান রয়েছে। এখানে অনেক স্কি প্রশিক্ষকও রয়েছেন যারা আপনাকে সাহায্য করতে পেরে খুশী হবে।
খিলানমার্গ
উপত্যকাটি শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং তার তৃণভূমির জন্য প্রসিদ্ধ যেগুলি বসন্তকালে ফুল দ্বারা আবৃত থাকে ও শীতকালে দারুণ স্কি-র জন্য প্রস্তাব নিবেদন করে। এই অঞ্চলের ঘিরে থাকা শৃঙ্গগুলির এক মহান দৃশ্য এখান থেকে দেখা যায়। পরিষ্কার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, এখান থেকে নাঙ্গা পর্বতও দেখতে পাওয়া সম্ভব।
আলপাথের লেক
এই সুন্দর হ্রদটি অপহারওয়াত শৃঙ্গের পাদদেশে অবস্থিত। হ্রদটি সাধারণত জুন মাস পর্যন্ত, এমনকি তার পরেও বরফে জমে থাকে; এই লেকের মধ্যে বরফ খুঁজে পাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। লেকের দিকে হাঁটা বেশ শ্রমসাধ্য ব্যাপার; তবে, যারা রোমাঞ্চ অনুভব করতে চান, সেইসমস্ত ব্যাক্তিদের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয়। এই লেকটিতে পৌঁছানোর আরেকটি সহজ উপায় হল একটি ছোট টাট্টু ভাড়া করা।
ফিরোজপুর নালা
উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া এটি একটি পার্বত্য প্রবাহ এবং অবশেষে এটি বাহান নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে এটি একটি খুবই জনপ্রিয় পিকনিক স্থল এবং গ্রীষ্মের সময়ে এটি শহরতলির এক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার প্রস্তাব দেয়। লম্বা পাইন বৃক্ষ, সুন্দর তৃণভূমি সমূহ এবং তুষারাবৃত পর্বত আপনার অভিজ্ঞতাকে আরোও সমৃদ্ধ করে তুলবে। এগলি ছাড়াও, ট্রাউট মাছ ধরাও এখানে একটি জনপ্রিয় কার্যকলাপ।