কাশ্মীর থেকে সিমলার পথে
কাশ্মীর ভ্রমণ শেষ হয়ে গেলেও কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরলাগা কাজ করছিল সবার মধ্যে। কাশ্মীরের রূপের জাদুতে মুগ্ধ যেমন সবাই, তেমনি শীতে শুভ্র বরফের চাদরে মোড়া কাশ্মীরের রূপ নিকট ভবিষ্যতে কোন একদিন দেখার প্ল্যানিং। এসব করতে করতে আমাদের টেম্পু ট্র্যাভেলার এগিয়ে চলল হোটেল রয়েল বাট্টু থেকে শ্রীনগর এয়ারপোর্টের দিকে। সপ্তাহখানেকের একটা ট্যুরে সবাই একটা পরিবারের মত ছিলাম, এবার বিচ্ছদের পালা। সময় সল্পতা এবং ব্যক্তিগত জীবনে কর্মব্যস্ততা’র দরুন দলের অর্ধেকের বেশী সদস্য শ্রীনগর থেকে কলকাতার বিমান ধরবে। আমরা চারজনের দল চলে যাব দিল্লী, সেখান থেকে আগামী একসপ্তাহের আমাদের গন্তব্য সিমলা-মানালি-রোহটাং পাস।
কলকাতাগামী দলের ফ্লাইট দুপুর তিনটায়, আর আমাদের ফ্লাইট ছিল দুপুর দুইটায়। ফলে বিমানবন্দর পৌঁছে উভয় গ্রুপের সদস্যরা পরস্পর বিদায় জানিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। যথাসময়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে অপেক্ষার পালা, এবং বেলা দুইটা নাগাদ প্লেন আমাদের নিয়ে উড়াল দিল কাশ্মীরের আকাশে। মধ্য দুপুরে বিমান আকাশের বেশ কিছুটা উপরে উঠার পর জানালা দিয়ে বাহিরে দৃষ্টি দিতেই চোখ থমকে গেল। সারি সারি পাহাড় চুড়ো, ঠিক চুড়োর মাথাগুলো সফেদ বরফের চাদরে ঢেকে আছে, সূর্যের আলো সেখানে প্রতিফলিত হয়ে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। দুঃখ, ছবি তুলেছিলাম, মোবাইলে। সেই মোবাইল, যা পকেটমার হয়েছিল ঢাকা ফেরার পর। সাথে হারিয়ে গিয়েছে ভারত ভ্রমণের বেশীরভাগ ছবি এবং ভিডিও। বর্তমানে যা ছবি দেয়া হচ্ছে, বেশীরভাগই ভ্রমণ সাথীদের কল্যাণে। আদিগন্ত পাহাড় চুড়ো আর তার হীরক খণ্ড ন্যায় উজ্জলতর রূপ দেখে মুখ দিয়ে একটা শব্দই বের হয়ে এল, “ওয়াও”। কাশ্মীর ভ্রমণে কেউ যদি শ্রীনগর থেকে দিল্লী বা অন্য কোন রুটে বিমান যাত্রা করেন, তবে অবশ্যই দুপুরের ফ্লাইটে যাবেন, জানালার পাশের সিটে বসবেন, ক্যামেরা সাথে রাখবেন এবং... দেশে ফিরে আগেই ব্যাকআপ নিয়ে নিবেন। নইলে, আমার মত সব হারালে, থাকবে শুধু দুঃখ আর দুঃখ। :(
দিল্লী পৌঁছে লাগেজ ফেরত নিয়ে বিমান বন্দর থেকে বের হতে হতে বিকেল চারটা পার হয়ে গেল। আগে থেকেই আমাদের আগামী আট দিনের সাথী, ড্রাইভার কাম গাইড “মি. বিপিন কুমার রাজপুত” বিমানবন্দরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তার সুইফট ডিজেয়ার গাড়ীটি নিয়ে। বের হতেই আমার নামের প্ল্যাকার্ড নিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার গোলগাল মানুষটি, গায়ের রঙ ফর্সা। ডার্ক নেভি ব্লু প্যান্টের সাথে হালকা স্কাই ব্লু শার্ট, কোম্পানির ইউনিফর্ম পরিহিত। মাথায় একটা গোল হ্যাট, কপালে সিঁদুরের লম্বাটে ফোঁটা দেয়া। চেহারায় কেমন একটা বোকা বোকা ভাব। সব মিলিয়ে আমি তাকে দেখে একটু ভড়কে গেলাম, খোদাই জানে কেমন হবে এই লোক। চিন্তিত হওয়ার অন্যতম কারণ, একে নিয়ে আগামী আটদিন সব জায়গায় ঘুরতে হবে। তাই কাশ্মীরের ড্রাইভার কাম গাইড মি. সাহিলের মত যদি বন্ধুবৎসল আর হাস্যমুখ না হয়, তবে আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে যাবে। তার উপর আমাদের দল এখন মাত্র চারজনের কিনা!
গাড়ী বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে দিল্লীর রাজপথে নামতে ড্রাইভার’কে বললাম আমাদের লাঞ্চ করতে হবে কোথাও। ও ব্যাটা গম্ভীর মুখে বলল, ‘আভি নাহি, থোরা বাদ’! আমি কিছু না বলে সম্মুখের বিকেল বেলার ব্যস্ত দিল্লী’র রাজপথ দেখতে লাগলাম। উত্তাপের কারণে ড্রাইভার এসি চালু করে দিল, সাথে হিন্দি এফ এম রেডিও। কি একটা হাস্যরসাত্মক টক’শো হচ্ছিল, ড্রাইভার হালকা চালের সেইসব উদ্ভট কৌতুক শুনে মুচকি মুচকি হাসছে আর গাড়ী চালাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তাকে বললাম, তোমার গাড়ীতে গান শুনবো, মোবাইল থেকে, জ্যাক কোথায়। ও মা! সে বলে জ্যাক নাই, গান শোনা যাবে না। বলেই গম্ভীরভাবে গাড়ী চালাতে লাগল। আমার তখন মেজাজ গরম হয়ে গেল, ভাবছি গাড়ী কোন এক জায়গায় থামলেই এজেন্ট’কে ফোন দিব, বলব, ড্রাইভার চেঞ্জ করতে। ততক্ষণে বেশ ভালোই ক্ষুধা পেয়েছে, তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, এখন থামানো যাবে কি না? এবার সে একটু বাক্য ব্যয় করতে যেন রাজী হল। তার কথায় বুঝলাম, সে চাচ্ছে দ্রুত দিল্লীর ব্যস্ত সড়ক পাড়ি দিয়ে হাইওয়ে ধরতে। তখন কোন একটা পাঞ্জাবী ধাবায় থামাবে আমাদের খাওয়ার জন্য। কি আর করা, গাড়ী এগিয়ে চলল, আর আমরা অপেক্ষায়।
সন্ধ্যের পরপর গাড়ী একটি বড়সড় পাঞ্জাবী ধাবায় থামানো হল। আমরা নেমে নিজ নিজ পছন্দ মত খাবারের অর্ডার করলাম। ড্রাইভারকে অফার করলে জানাল, সে ব্রত পালন করছে, পানীয় আর ফলা’র ছাড়া কিছু খায় না। সে এককাপ চা নিল। খাওয়া শেষে আবার যাত্রা শুরু হল, কিছুক্ষণ গাড়ী চলার পর সে প্লেয়ারে হিন্দি গান চালিয়ে দিল। ব্যাকভিউ মিররে দেখি, মুচকি মুচকি হাসছে। ফানি ক্যারেকটার! তারও কিছুক্ষণ পর সে ৩.৫ এমএম একটা জ্যাক আমার দিকে এগিয়ে দিল, মোবাইল থেকে গান শোনার জন্য। আসলে বিপিন ছিল আমার দেখা সবচেয়ে মজার ড্রাইভার, তার কল্যাণে পরের কয়েকটা দিন কেটেছে দারুণ।
একসময় দিনের আলো মুছে গিয়ে চারিধারে বিদ্যুৎ এর বাতির ঝলকানি দেখা যেতে লাগল। আমাদের গাড়ী দিল্লী হতে সোনিপাত, পানিপাত, কারনাল, কুরুশক্ষেত্র, আম্বালা, পাঞ্চকুলা হয়ে চলল কলকা পাশে রেখে সিমলা’র দিকে। একসময় দেখতে দেখতে রাত বাড়তে লাগল, গাড়ীর এসি অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। প্রায়ই ঝিমুনি ধরছিল, কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে গাড়ীর মধ্যেই। রাত দশটা নাগাদ বেশ শীত লাগছিল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল, আমরা সিমলা’র কাছাকাছি আছি। রাত এগারোটা নাগাদ একটা পাঞ্চাবী রেস্টুরেন্ট গাড়ী থামাল। জনমানবহীন এলাকায় দুই ভাই মিলে রেস্টুরেন্টটি চালায়। ভেজ রেস্টুরেন্টে ভেজিটেবল বিরিয়ানি অর্ডার করলাম, কিন্তু সার্ভ করার পর মন হল দুপ্লেট অর্ডার করলেই চারজনের জন্য যথেষ্ট ছিল।
তো খাওয়া শেষে শুরু হল ফের পথচলা। রাতের আঁধারে পাহাড়ি রাস্তা, হেডলাইটের আলোয় সেই আঁধার ভেদ করে সত্তর কিলোমিটার স্পীডে আমাদের গাড়ী ছুটে চলল, বাকের পর বাক, সর্পিল পথ। পথ যেমন মসৃণ ছিল, তেমনি সুদক্ষ ছিল ড্রাইভার বিপিনের গাড়ী চালনা। আটদিনের ট্যুরে একবারের জন্য কোন ভুল করতে দেখি নাই তাকে, এমন কি হার্ড ব্রেক করতে। কিন্তু গাড়ী চলেছে তুমুল গতিতে। আমি একেবারে সামনের সিটে বসে উপভোগ করছিলাম এই যাত্রা, আরে পেছনে বসা আমার সাথী'ত্রয়ের অবস্থা...বুঝে নেন। কিছুক্ষণ আগে খাওয়া ভেজ বিরিয়ানিটি প্রচুর তৈলাক্ত ছিল; খাবার পর গাড়ী চলা শুরু করলে মাঝপথেই আমার দুই ভ্রমণ সাথী'র তা আর হজম হচ্ছিলো না; ফলে যা হবার তাই হয়েছিল।
একসময় পাহাড়ের গায়ে হাজারো তারার মেলা’র মত বাতি চোখে এল। সিমলা শহরটা হল পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা একটা শহর। মনে হয় এতোটুকু জায়গা বাদ দেয় নাই, পুরো পাহাড় জুড়ে সারিসারি বাড়িঘর, তাই বলে সবুজেরও কমতি কিন্তু ছিল না, যা পরের দিন দিনের আলোয় দেখেছি। এমন অপরূপ শোভা গাড়ী থেকে কতক্ষণ আর ভাল লাগে? বিপিন’কে বলতেই বলল, অপেক্ষা কর, সামনে একটা ভাল ভিউ পয়েন্ট মত জায়গা আছে, সেখানে থামাব। মিনিট দশেক পরেই গাড়ী সাবধানে সুবিধামত জায়গায় পার্ক করা হল। নেমে এলাম গাড়ী হতে, বাহিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া। জ্যাকেট গাড়ীতে ছিল, নিয়ে গায়ে চাপিয়ে দিলাম। এবার মন ভরে মধ্য রাতের সিমলা’র অপরূপ রূপ দেখতে লাগলাম।
রাত তখন সাড়ে বারোটা'র বেশী। ড্রাইভার তাড়া দিতে ফের গাড়ীতে উঠে বসলাম, ভাল ক্যামেরা না থাকায় তেমন ছবি নেয়া গেল না। প্রায় রাত দেড়টার দিকে আমরা পৌঁছলাম সিমলা মলের নীচে পার্কিং এরিয়ায়। এরপর আর গাড়ী যাবে না, হোটেল সেখান থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উপরে। হোটেলের নাম্বারে ফোন দিলাম, ধরল হোটেলের একজন সার্ভিস বয়। আমাদের পরিচয় দিয়ে তাকে বলতেই, সে যা বলল, শুনলে যে কারো মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তার প্রথম বাক্যই ছিল, ‘নীচে আকার তুম লোগ কো লে আনে কে লিয়ে শা'ও রূপিয়া লাগে গা’!
রাত এগারোটার দিকেও আমার এজেন্ট এবং হোটেলের মালিকের সাথে কথা হয়েছে, তারা বলল, যত রাতই হোক, তোমাদের রিসিভ করার জন্য লোক থাকবে। রাত দেড়টা, ঠাণ্ডায় সবাই কাঁপছি, এই অবস্থায় ব্যাটা আমাদের আগে রিসিভ না করে তার একশত টাকার ধান্দায় ব্যস্ত। শেষে ড্রাইভারকে ফোন দিলাম, সে তাকে নীচে আসতে বলল, আমি বললাম ওকে বল টাকা দেয়া হবে। অবশেষে গর্দভটা নীচে এল, বয়স বিশের হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে, দেখেই মন চাইল একটা চড় লাগাই। যাই হোক, সে এসে ড্রাইভারকে বলল গাড়ী আরও উপরে নিতে। ড্রাইভার রাজি হল না, ছেলেটা যতই আশ্বস্ত করছিল, সে রাজি হল না। কেননা, বড় করে সাইনবোর্ড লাগানো আছে, ঐ সীমা ক্রস করলে হাজার তিনেক রুপী জরিমানা থেকে শুরু করে লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। পরে দেখেছি, লোকাল মানুষজন পর্যন্ত এই সীমার নীচে গাড়ী রেখে পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরে।
যাই হোক, সেই হোটেল বয় কিভাবে, কোথা থেকে সেই চেক পোস্টের একজন পুলিশকে নিয়ে এল। সে সব শুনে পারমিশন দিল গাড়ী উপরে নেয়ার। গাড়ী মোটামুটি হোটেলের কাছাকাছি একটা জায়গা নেয়া হল, আমরা বিপিন সাহেবের কাছ থেকে পরের দিনের শিডিউল জেনে নিয়ে বিদায় দিয়ে চলে এলাম হোটেলে। আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ডাইনিং রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে, তাই পেমেন্ট করা থাকা সত্ত্বেও সেদিন কোন ডিনার হল না এই হোটেলে। হোটেলের খাবারগুলো ভালোই ছিল, পরের দিন টের পেয়েছিলাম। এবার যে যে যার যার রুমে গিয়ে ঘুমাবার পালা, পরের দিনের গন্তব্য কুফরি-ফাগু।
পরদিন সকালে দেখা শিমলা শহরের দুটি ভিউ
মন্তব্যসমূহ