সন্দ্বীপ (শেষাংশ)
সন্দ্বীপের পশ্চিম পাড় হতে এই কালাপানিয়া পর্যন্ত পুরো পথটুকু’র সৌন্দর্যে আমি সত্যিই বিমোহিত হয়ে ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল খুব বেশী কিছু না, একটু সহজ পর্যটক বান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থা, দুতিনটি মৌলিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা আর একটু প্রচার; তাহলেই কি বিশাল পরিমান টুরিস্টের সমাগম হতে পারে আমাদের এই দ্বীপ অঞ্চলে, এই দ্বীপসংলগ্ন সৈকতে। গত দুই সপ্তাহ ভারতের দক্ষিণের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে এলাম, কন্যাকুমারী-কোভালাম-গোয়া এই জায়গাগুলোর সৈকত এর আয়তন আমাদেরগুলোর কাছে নগণ্য, অথচ পরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে কি পরিমান দেশী-বিদেশী পর্যটক সেখানে ভিড় করছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সেই গল্প খুব শীঘ্রই আপনাদের সাথে শেয়ার করবো আশা রাখি।
তো কালাপানিয়া পৌঁছে যখন কাঙ্ক্ষিত নৌকাটি পাওয়া গেল, তখন ঝামেলা পাকাতে এগিয়ে এল ঘাটের ইজারাদারের লোক, আগের পর্বে বলেছি সেই কথা। শাহরিয়ারকে ওদের সাথে কথা বলতে দিয়ে আমি চারিপাশটা দেখতে লাগলাম কোথায় তাবু ফেলা যায়। পাড়ের কোল ঘেঁষে উঁচু একটা ঢিবি মত সমতল জায়গা পছন্দ হল, ফুট বিশেকের মত সমতল, সবুজ ঘাসে ঢাকা, পেছনে দুটো গাছ বাঁকা হয়ে ঝুঁকে আছে সম্মুখ পানে... একেবারে ছবির মত লোকেশন। এর মধ্যে শাহরিয়ার নিজ পরিচয় দিতেই ঝামেলা শেষ হল। আমাদের নিয়ে ঐ মালবাহী নৌকাটি আগামীকাল সকালবেলা হাতিয়া যাবে, হাতিয়া থেকে আমাদের গন্তব্য নিঝুম দ্বীপ।
সন্দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বকোণে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম উপকূল ও সন্দ্বীপের মাঝখানে সন্দ্বীপ চ্যানেল অবস্থিত। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের দূরত্ব প্রায় দশ মাইল। নোয়াখালীর মূল ভূখন্ড সন্দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। সন্দ্বীপের প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে হাতিয়া দ্বীপের অবস্থান। সন্দ্বীপের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন মতামত শোনা যায়। কারও কারও মতে ১২ আওলিয়ারা চট্টগ্রাম যাত্রার সময় এই দ্বীপটি জনমানুষহীন অবস্থায় আবিস্কার করেন এবং নামকরণ করেন শুন্যদ্বীপ যা পরবর্তীতে ‘‘সন্দ্বীপে’’ রুপ নেয়। ইতিহাসবেত্তা বেভারিজের মতে চন্দ্র দেবতা সোমএর নামানুসারে এই এলাকার নাম সোম দ্বীপ হয়েছিল যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপে রুপ নেয়। কেউ কেউ দ্বীপের উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ আখ্যা প্রদান করেন। উক্ত স্বর্ণদ্বীপহতে সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দ্বীপের নামকরণের আরেকটি মত হচ্ছে পাশ্চাত্য ইউরোপীয় জাতিগণ বাংলাদেশে আগমনের সময় দুর থেকে দেখে এই দ্বীপকে বালির স্তুপ বা তাদের ভাষায় স্যান্ড-হীপ (Sand-Heap) নামে অভিহিত করেন এবং তা থেকে বর্তমান নামের উৎপত্তি হয়।
ইউরোপীয়দের লেখা ইতিহাসে জানা যায় যে সন্দ্বীপে প্রায় তিন হাজার বছরের অধিককাল ধরে লোক বসতি বিদ্যমান। এমনকি এককালে এর সাথে সংযুক্ত থাকা নোয়াখালীতে মানুষের বসতি স্থাপনের পূর্বেই সন্দ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। সন্দ্বীপের লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা ও বস্ত্র শিল্প পৃথিবী খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণকারীরা এই অঞ্চলে এসে তাদের জাহাজ নোঙ্গর করতেন এবং সহজ বানিজ্য ব্যবস্থা এবং পরিবহন সুবিধাদি থাকায় এই অঞ্চলে ব্যবসা এবং বসতি স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। ১৭৭৬ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি বছর সন্দ্বীপ উৎপাদিত প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হত। জে. র্যা নেল এর তৈরী করা ১৭৭৮ সালের মানচিত্রে সন্দ্বীপ এর দেখা মেলে।
সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মানের জন্য পৃথীবী খ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানী করা হত। তুরস্কের সুলতান এই এলাকার জাহাজের প্রতি আকৃষ্ট হন এখান থেকে বেশ কিছু জাহাজ কিনে নেন। ভারতবর্ষের মধ্যে সন্দ্বীপ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী বন্দর। লবণ ও জাহাজ ব্যবসা, শস্য সম্পদ ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগীজরা সন্দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেন। এছাড়া ভ্রমণ ও ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে ফরাসী ও ওলন্দাজ পরিব্রাজকরা প্রায়ই সন্দ্বীপে আগমন করতেন। ১৬১৫ সালে পর্তুগীজদের সাথে আরকানরাজের যুদ্ধে ২০০জন সৈন্য সহ পর্তুগীজ সেনাপতি ইমানুয়েল মার্তুস নিহত হয় এবং পর্তুগীজরা সন্দ্বীপ ত্যাগ করলে ১৬১৬ সালে মগরাজ সন্দ্বীপ দখল করে। এরপর সন্দ্বীপে আরকান ও মগদের প্রাধান্য থাকলেও তাদের পরাধীনতাকে অস্বীকার করে একে প্রায় অর্ধ শতাব্দী শাসন করেন করেন দেলোয়ার খাঁ। ১৬৬৬ সালে তার রাজত্বের পতন ঘটে এবং মোঘল সরকারের অধীনে জমিদারদারী প্রথার সূচনা ঘটে যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়। রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, পর্যটক এসেছেন এখানে। ১৩৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক পর্যটক ইবনে বতুতা সন্দ্বীপে আসেন। ১৫৬৫ সালে ভিনীশ পর্যটক সীজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপে আসেন এবং এর বহু প্রাচীন নিদর্শনের বর্ননা লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৮শে জানুয়ারী মুজফ্ফর আহ্মেদর সাথে সন্দ্বীপে আসেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সন্দ্বীপ ভ্রমনের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মধুমালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা রচনা করেন।
নৌকার সারেং এবং অন্যান্য স্টাফদের সাথে আমাদের ভালই খাতির জমে গেল। রাতের খাবার কালাপানিয়া বাজারে খাব শুনে উনারা উনাদের সাথে নৌকায় খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, নৌকায় সকল ব্যবস্থা আছে। আন্তরিকতা দেখে আমরা আর দ্বিমত করলাম না। এই ধরণের নৌকায় সারেং, ইঞ্জিনের মেকানিক থেকে শুরু করে রান্না করার লোকও থাকে। এতো ছোট একটা নৌকার স্টাফ ছয়-সাত’জন! যাই হোক, আমার তাবু ফেলার জায়গা দেখে নৌকার প্রধান নিষেধ করলেন, বললেন রাতে প্রচুর শীত লাগবে, তার সাথে নিরাপত্তার ব্যাপার তো রয়েছেই। এর চাইতে তাদের সাথে তাদের নৌকার কুঠরিতে থাকার জন্য বললেন। পরে সবদিক বিবেচনা করে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম নৌকার খোলের ভেতর তাবু টাঙ্গিয়ে থাকব আমরা তিনজন। সাথে একটি চারজনের উপযোগী এবং একটি দুই জনের উপযোগী তাবু ছিল, চারজনের উপযোগী তাঁবুটি খুব সহজেই পিচ করা গেল নৌকার মাল পরিবহনের খোলে। একটু সমস্যা হল পাটাতন সমান না হওয়ায়। ফলে একটা শীতের চাদর দিয়ে ব্যালেন্স করে সমান করা হল মেঝে।
মাঝিদের হাঁকডাকে আমরা তাবু থেকে বের হয়ে তাদের কুঠরিতে চলে এলাম, রাতের খাবার রেডি। মেন্যু দেখে অবাক হলাম, নদীর মাছের ঝোল, ডিমের তরকারি, মুরগির মাংস, ঘন ডাল, সালাদ, মোটা চালের ভাত... আহ, এই সন্দ্বীপের কালাপানিয়া ঘাটে রাতের বেলা আমাদের জন্য এ যেন রাজভোজ! তৃপ্তি নিয়ে খেলাম পেটপুরে। খাওয়া শেষে একটু ঘুরে এলাম রাতের বাজার থেকে, মোবাইল আর ক্যামেরার ব্যাটারি রিচার্জ করার প্রয়োজনও ছিল। রাত দশটার দিকে বাজারের দোকানপাট বন্ধ হলে আমরা আমাদের ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। নৌকার কাছ দিয়ে অনেক দূর হেঁটে চলে গেলাম, অন্ধকারে পথ চিনতে না পেরে। ফের বিপরীতে চলে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। সারাদিনের ধকলের পর এবার তাবুতে ঢুঁকে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাবার পালা।
প্রথমে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি, আমি মারা যাচ্ছি, ভয়াবহ শীতলতা আমাকে গ্রাস করছে। কিন্তু একসময় আবিস্কার করলাম না, বাস্তবেই আমি প্রচণ্ড শীতে কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় অবশ হয়ে গেছে। আসলে, রাতে ঘুমাবার সময় তেমন একটা শীত ছিল না বলে, আমি পাটাতন সমান করতে কিছু শীতবস্ত্র বিছানার নীচে দিয়েছি। আমার গায়ে ছিল পাতলা একটা ছোট চাদর, যা সাধারণত ছেলেরা শীতে গায়ে দেয়। মাথা ঢাকলে পা খোলা থাকে টাইপ। কিন্তু ভোর রাত থেকে প্রচণ্ড কুয়াশা ঝরেছে, সাথে তাপমাত্রা হুট করে অনেক কমে গেছে (আগের দিন বাস থেকে নেমে টের পেয়েছিলাম)। আমি অনেক কষ্টে হাসিবকে ঘুম থেকে জাগালাম, হাসিব মাঝখানে ছিল। অপর পাশে শাহরিয়ারের বিছানার নীচে কম্বল টাইপ একটা চাদর দেয়া ছিল, সেটা বের করে আমার গায়ে দেয়ার জন্য। শাহরিয়ারের ঘুম নষ্ট করে চাদরটা বের করে গায়ে দেয়ার মিনিট দশেক পরে আমি স্বাভাবিক হলাম। সত্যি, শীত যে মানুষকে এভাবে কাবু করে ফেলতে পারে, বিপদে না পড়লে কেউ বুঝবে না। হাসিব আর শাহরিয়ার তো পরের দিন অনেকবার এই ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা করছিল। কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি শীত কাকে বলে।
আকাশ হতে অন্ধকার একটু কমে এলে আমি তাবু হতে বের হয়ে নৌকার পাটাতন বেয়ে উপরে উঠে উলাম এবং ঘাটের সাথে সংযুক্ত সিঁড়ি দিয়ে পাড়ে চলে এলাম। এই ভোরবেলাতেই ঘাটে বেশ কিছু মানুষের সমাগম। কিছু জেলে নৌকা মাছ ধরে ফিরেছে, তাদের ঘিরে ছোট জটলা। আমি গিয়ে আমার সেই তাবু টাঙ্গানোর জায়গায় বসলাম। রাত শেষের এই ভোর হওয়ার সময়টা দারুণ, প্রাণ ভরে উপভোগ করছিলাম, যদিও কিছুটা শীত করছিল। আস্তে আস্তে ঘাটটি জমজমাট হয়ে উঠলো। ঘাটে বাঁধা আরও দুটো নৌকায় আশেপাশের এলাকায় যাত্রী পরিবহণ হয়। সেই উদ্দেশ্যে যাত্রীরা জড় হতে লাগলো ঘাটে। আমি আমাদের নৌকায় ফিরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নৌকার ছাঁদে বসে রইলাম। হাসিব আর শাহরিয়ার বাজার হতে ঘুরে এল, সাথে সকালের নাস্তা নিয়ে। আমাদের নৌকা সহ ঐ দুটো নৌকাও জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। জোয়ারের পানি এলে পরেই নৌকা চলা শুরু করবে। নাস্তা করে কতক্ষণ বসেছিলাম মনে নেই, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি দক্ষিণ দিক হতে সাদা ফেনিল রাশি তুলে একটা ঢেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম, জোয়ারের প্রথম ঢেউ, ধীরে ধীরে একরাশ জল নিয়ে এগিয়ে আসছে চরাচর ভাসিয়ে দিতে। তারপর এরকম আরও অজস্র জলধারা এসে একসময় ভাটায় শুকনো এলাকাটা জলে পূর্ণ করে দিল। নয়টার পরে আমাদের নৌকা ছেড়ে দিল হাতিয়ার উদ্দেশ্যে। নৌকার এগিয়ে চলার সাথে সাথে পেছনে ফেলে এলাম কালাপানিয়া-সন্দ্বীপ, সাথে নিয়ে এলাম একরাশ সুখস্মৃতি।
আগের পর্ব | পরের পর্ব |
মন্তব্যসমূহ