হাতিয়ার (জার্নি টু আওয়ার সুইট সেভেন ডটার অব সী)
ইঞ্চিন নৌকা কিছুক্ষণ চলার পর গায়ের চামড়ায় জ্বলুনি অনুভব করলাম। চারিদিকে স্থলভূমির শেষ অস্তিত্ব একসময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে থাকলো। সন্দ্বীপ থেকে হাতিয়া যাওয়ার রুটটি খুব গভীর সমুদ্রে না হলেও একটা সময় আপনি থাকবেন সমুদ্রে, চারিধারে কোথাও কোন ভূখণ্ড চোখে পড়বে না। মধ্য দুপুরে সূর্যের প্রখর তাপে আমার চামড়ায় জ্বলুনি অনুভব করতে আমি একটু চোখ বুলালাম আমাদের নৌকায়, নাহ কোথাও কোন ছাউনি নেই। একপাশে একটা ঘরের মত জায়গা, যেখানে নৌকার মাঝিরা সবাই থাকাখাওয়া-রাত্রিযাপন করে। সেখানে গিয়ে দেখি নৌকার তিনজন স্টাফ ঘুমাচ্ছে। কি আর করা? আবার নৌকার ছাদে বসে বসে রোদে পুড়তে লাগলাম।
আগেরদিন বিকেল হতে আজ সকাল পর্যন্ত, সেই সন্দ্বীপ থেকে এই হাতিয়ার পথে, কয়েকঘণ্টার মধ্যেই নৌকার লোকগুলোকে কেমন আপন আপন মনে হচ্ছিল। নৌকা চলছে, চারিদকিকে নিস্তরঙ্গ জলরাশি, ভয়ানক শান্ত সাগরের জল। আর শান্ত বলেই রক্ষা, নইলে সাগেরের ঢেউয়ে ভয়ে মারা যেতাম। সাথে ঢাকা থেকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম, যা কিছুক্ষণ পর যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যাই হোক, নৌকার পিচ্চি একটা ছেলে প্লাস্টিকের কাপে করে আদা দেয়া রঙ চা নিয়ে এল। এই পরিবেশে এই সময়ে এই চা সত্যি আমাকে অভিভূত করল।
একসময় নৌকা থেমে গেল, চারিদিকে পানি, মাথার উপর সূর্য গনগন করছে। ঘটনা কি? খোঁজ করতে জানা গেল, নৌকার ইঞ্চিনে কি একটা সমস্যা হয়েছে। আমি কিছুটা ভয় পেলাম। একসময় নৌকার মেকানিক সাহেব আর প্রধান সারেঙের মধ্যে বাকবিতন্ডতা শুরু হয়ে গেল। মেকানিক সাহেব রাগ করে ইঞ্জিনের কাছ থেকে সরে এসে একটা বিড়ি ধরিয়ে আয়েশে ফুঁকতে লাগলেন। ঐদিকে সারেঙ সাহেব ঠিকই নিজের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ইঞ্জিন ঠিক করে ফেললেন। এই সময়ে আমি নৌকার দুলনি দেখে বুঝেছি, চলন্ত থাকায় মোটেও টের পাইনি সাগরের জলের এই মৃদু দুলুনি। আর এই দুলুনি থেকে বুঝে নিলাম সত্যিকারের ঢেউ থাকলে নৌকা কিভাবে দুলতো।
দুপুর দুইটার কাছাকাছি সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম হাতিয়ার আফাজিয়া ঘাট, তেমুহনি বাজার। এটা হাতিয়ার মূল ঘাট তজমুদ্দিন ঘাট এর উল্টো দিকের একটা ব্যস্ত ঘাট। এখানে আমরা একটা স্থানীয় খাবার রেস্টুরেন্টে ঢুঁকে লাঞ্চ সেরে নিলাম। তাজা সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি, সবজি, মুরগির মাংস দিয়ে ভরপুর খাওয়া দাওয়া শেষে একটা সিএনজি অটো রিকশা ৮০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করা হল, গন্তব্য নামার বাজার। এই নামার বাজার থেকে নৌকা পাড়ি দিয়ে অপর পাড়ের নিঝুম দ্বীপের ভূখণ্ড আমাদের আজকের গন্তব্য। মিনিট পনের সিএনজি অটোরিকশা চলার পর আবিস্কার করলাম আমাদের সাথে থাকা লাইফ জ্যাকেটগুলো খাবার হোটেলে ফেলে এসেছি। ভাগ্য ভাল, হাসিব কি মনে করে ঐ হোটেলের ক্যাশে বসে কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার মোবাইল নাম্বার নিয়েছল। দিলাম ফোন তাকে, সে জানাল লাইফ জ্যাকেট তার হোটেলেই আছে। আমাদের সেদিনের প্ল্যান ছিল বিকেলের মধ্যে নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে সন্ধ্যের আগে আগে জলপান করতে আসা হরিণের দলকে প্রত্যক্ষ করা। ফলে তাকে বললাম, লাইফ জ্যাকেটগুলো তার কাছে রাখতে, আমরা নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে সেগুলো তার কাছ থেকে নেয়ার ব্যবস্থা করব। সে সম্মত জানালে হাতিয়ার পিচ ঢালা পথ দিয়ে আমাদের সিএনজি অটোরিকশা ছুটতে লাগলো, আর এই চলন্ত যান হতে যতটুকু দেখা যায় দেখে নিলাম এই বিখ্যাত চরাঞ্চল তথা দ্বীপাঞ্চল’টিকে।
‘হাটিয়া'- ‘হাতি'- ‘হাইতান'- ‘হা-ইতিহ' ইত্যাদি বিভিন্ন নামে নামকরণের প্রবাদ থাকলেও কালক্রমে এটি বর্তমানের ‘হাতিয়া' নামে নামান্তরিত হয়ে সারাবিশ্বে সুপরিচিতি লাভ করেছে। প্রমত্তা মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির প্রচণ্ড দাপটের মুখে হাতিয়ায় প্রকৃতির ভাঙা-গড়ার কারণে এক থেকে দেড়শ’ বছরের পুরনো কোনো নিদর্শন অবশিষ্ট নেই। দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি অনেক গবেষক হাতিয়ার ওপর গবেষণা করেছেন। তাদের মধ্যে সুরেশ চন্দ্র দত্ত কিছু যুক্তি দিয়ে হাতিয়ার বয়স অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণবঙ্গের ভূ-ভাগ সৃষ্টির রহস্য নিয়ে তার গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রতি ১৩৬ থেকে ১৪০ বছর সময়ের মধ্যে এক মাইল স্থলভাগ সৃষ্টি হয় হাতিয়ায়। তার এ তথ্য আমলে নিয়ে হাতিয়ার বর্তমান আয়তনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হাতিয়ার বয়স সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার বছর বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়ার চৌহদ্দি নিরূপণ করলে দেখা যায়, হাতিয়ার উত্তরে সুধারাম, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে সন্দ্বীপ এবং পশ্চিমে মনপুরা ও তজুদ্দিন উপজেলা। এক সময় সন্দ্বীপের সঙ্গে হাতিয়ার দূরত্ব ছিল খুবই কম। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দূরত্ব এখন ৬০ মাইল ছাড়িয়েছে। ক্রমাগত ভাঙনই এ দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। হাতিয়ার ভাঙা-গড়ার খেলা চতুর্মুখী দোলায় দোদুল্যমান। উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে ভাঙছে। আবার দক্ষিণে গড়ছে, পাশাপাশি আবার মূল ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে আশপাশে ছোট-বড় নানান ধরনের চর জেগে উঠছে। ওয়েব স্টার নামের একটি সংস্থার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৮৯০ সাল থেকে হাতিয়ার আদি ভূখণ্ডের উত্তর ভাগের ভাঙন শুরু হয়। বিরাট আয়তনের জমি নদী ও সাগরের ভাঙনে বিলুপ্ত হলেও একই সময় দ্বীপের উত্তর দিকে হাতিয়ার আয়তন ভাঙনের প্রায় ২ থেকে ৫ গুণ হারে বাড়তে শুরু করে। সেই সময় এ অঞ্চলের জেগে ওঠা চরের যে হিসাব পাওয়া যায় তা হলো : ফেনী নদীর মুখে ৫টি, হাতিয়া দ্বীপের সম্প্রসারণ ১৮টি, হাতিয়া চ্যানেলে ৫টি, মেঘনার বুকে ৩টি ও ডাকাতিয়া নদীর মুখে ৩৫টি চর সৃষ্টির প্রক্রিয়া হাতিয়ার মোট আয়তনকে পরিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। ১২০ বছরের ব্যবধানে হিসাব-নিকাশে ঢের পরিবর্তন এসেছে। অনেক চর মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিছু কিছু আবার ভাঙনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। ক্রমাগত ভাঙনের কারণে সঠিক আয়তন নির্ধারণ করা কঠিন হলেও উপজেলা পরিষদের হিসাব মতে হাতিয়ার বর্তমান আয়তন ২১শ’ বর্গকিলোমিটার বলে উল্লেখ আছে। হাতিয়া সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে পড়তে পারেন ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা তিলোত্তমা হাতিয়া ও ইতিহাস’ শিরোনামের গ্রন্থটি।
শেষ বিকেল নাগাদ আমরা পৌঁছলাম নামার বাজার ঘাটে। সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল ইঞ্জিন নৌকাটি মিনিট খানেক আগে ছেড়ে গিয়েছে। কি আর করা, ঘাটের সংলগ্ন দোকানে আমাদের ব্যাগপ্যাক রেখে ফ্রেশ হলাম, চা-নাস্তা সেরে নিলাম। চোখের সামনে সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে যখন আমরা নৌকা করে অপর পারে পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যে শেষে আকাশ জুড়ে আঁধারের চাদর বিস্তৃত হয়েছে।
আগের পর্ব | পরের পর্ব |
মন্তব্যসমূহ