অসময়ে অনিন্দ্য সুন্দর কুফরি-ফাগু ভ্রমণ

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে টের পেলাম রাতের সেই প্রচণ্ড শীত এখন তেমন নেই। আমাদের পুরো ট্যুর শিডিউল এর ন্যায় এদিনও আমরা দ্রুত তৈরি হয়ে যে যার যার রুম থেকে রিসিপশনে এসে জড়ো হলাম। রিসিপশনে বছর বিশের একটা মেয়ে বসে ছিল, হাস্যমুখে স্বাগত জানাল। নাস্তা তৈরি ছিল, ডাইনিং এ বসতেই পরিবেশন করা হল। শীতের দিনে গরম গরম ফুলো ফুলো রুটি, সবজি, ডিম অমলেট, ব্রেড-বাটার-জেলি দিয়ে নাস্তা সেরে চা পান করছি, তখন বিপিন সাহেবের ফোন পেলাম। আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড বিপিন জানাল, আমরা যেন সেই পার্কিং এলাকায় এসে তাকে ফোন দেই। কাশ্মীরে থাকা কালেই এজেন্ট আমাদের বিপিনের মোবাইল নাম্বার মেইল করে দিয়েছিল। নাম্বার সবার মোবাইলে সেভ করে রেখেছিলাম, যে কোন প্রয়োজনে যেন যোগাযোগ করা যায়। নাস্তা শেষ করে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় রিসিপশনের মেয়ের কাছ থেকে কমপ্লেইন খাতা নিয়ে আগের রাতের ঘটনার জন্য আমার অভিযোগ লিখে দিলাম। হোটেল মালিকের খোঁজ করলাম, উনি অফিস টাইমে থাকেন হোটেলে, এই সাত সকালে নেই। কি আর করা, সকালের আলোয় সিমলা শহরে দেখতে দেখতে আমরা পার্কিং এলাকার দিকে এগিয়ে গেলাম। 


আমি, আমার ট্যুর প্ল্যান করার সময় বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে স্টাডি করে নেই। আশেপাশে টুরিস্ট ডেসটিনেশন কি কি আছে, ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি। কেননা, মধ্যবিত্তের তো বারবার একই জায়গায় ভ্রমণ হয় না, তাই না। এজেন্ট প্রথমে যে প্যাকেজ অফার করেছিল, তা ছিল চার রাত পাঁচ দিন এর। কিন্তু সেখানে সিমলা’র “কুফরি-ফাগু” আর “মানালিতে” মানিকারান দর্শন বাদ ছিল। ট্রিপ এডভাইজার সহ বেশ কিছু সাইটে রিভিউ পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই জায়গা দুটো বাদ দেয়া যাবে না। তাই, আজকে আমাদের গন্তব্য “কুফরি-ফাগু”। যদিও কুফরি-ফাগু ভ্রমণের সেরা সময়, নভেম্বর-ডিসেম্বর এর দিকে, যখন স্নোফল হয়, হাজারে হাজার পর্যটক এখানে আসে স্কিয়িং করতে। কি আর করা, যেহেতু অসময়ে এসে পড়েছি, বেড়াতে তো হবেই। আমরা পার্কিং এরিয়ার পৌঁছে মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করতেই বিপিন তার গাড়ী নিয়ে হাজির। দ্রুত গাড়ীতে উঠে পড়লাম, সেখানে গাড়ী দাঁড়াতেই দেয় না। পাহাড়ি সরু রাস্তা, অল্পতেই জ্যাম লেগে যায়, তাই কোন গাড়ী সেখানে দাঁড়াতে পারে না। আমরা উঠে বসতেই বিপিন গাড়ী স্টার্ট দিল কুফরি’র উদ্দেশ্যে। 

সিমলা উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। উত্তরে মান্ডি এবং কুল্লু জেলা, পূর্বে কিন্নুর, দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তরখান্ড এবং সোলান-সিমুর জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভারতের উত্তরীয় রাজ্য, হিমাচল প্রদেশে অবস্থিত সিমলা হল একটি খুবই জনপ্রিয় শৈল শহর। ঊনিশ শতকের পূর্ব থেকেই এটি শৈল শহর হিসাবে খ্যাত। সুস্থির পরিবেশ, তুষারাবৃত শৃঙ্গ ও ঐশ্বর্য্যশালী দৃশ্যের সঙ্গে মনোরম জলবায়ু সমন্বিত এই স্থান 1864 সালে ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব অপরিমোচনীয় ছাপ এই শৈল শহরটির উপর ছেড়ে গেছে এবং প্রচুর আকর্ষণের মধ্যে এই ইংরেজীয়ানা পর্যটকদের আকর্ষিত করে। ইংরেজ শাসনামলে সিমলাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়, সময়টা ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। ১৮৭১ সাল থেকে সিমলা পাঞ্জাবের রাজধানী ছিল,  পরে ১৯৭১ সালে হিমাচলের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত  হয়। মাত্র দুই লক্ষ লোকের আবাস এই সিমলায়, যা ভারতের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার প্রাদেশিক রাজধানীও বটে। রাজনৈতিক পটভূমিতে সিমলার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।। ১৮১৭ সালে সিমলা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এখানকার আবহাওয়া এবং প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা এখানে হিমালয় রেঞ্জের বনভূমির নিকটে শহরের পত্তন করে। সিমলা’র অনেকগুলো আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে আছেঃ “Simla Accord of 1914”, “the Simla Conference of 1945” এবং “Simla Agreement of 1972”। 

২০১১ এর পরিসংখ্যান মতে সিমলা মোট ১৯টি পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে গঠিত, অঞ্চলগুলো হলঃ Baghal, Baghat, Balsan,Bashahr, Bhajji, Bija, Darkoti, Dhami, Jubbal, Keonthal, Kumharsain,Kunihar, Kuthar, Mahlog, Mangal, Nalagarh (Hindur), Sangri and Tharoch। সিমলার বেশীরভাগ অঞ্চল ঘন বনভূমি ছিল এবং একমাত্র জাখো মন্দির এবং তদসংলগ্ন কয়েকটি ঘরবাড়ি ছিল উনিশ শতকের শুরুর দিকে। ১৮০৬ সালে নেপালের ভিসমেন থাপা আজকের সিমলার দখল নেন। পরে ১৮১৪-১৮১৬ সালের দুই দফায় যুদ্ধের পর এর দখল চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ১৮১৯ সালে লেঃ রোজ এখানে একটি কাঠের কটেজ নির্মাণ করেন। তিন বছর পর প্রথম পাকা দালান গড়ে ওঠে ১৮২২ সালে। ১৮২৫-১৮৩০ সালের দিকে বিভিন্ন ব্রিটিশ প্রশাসক এবং কর্মচারীরা ছুটি কাটাতে সিমলা আসেন এবং এর আবহাওয়া-প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট করেন যার প্রেক্ষিতে ১৮৩০ সালে এখানে বসত গড়ার উদ্যোগ নেয় ব্রিটিশ রাজ। ১৮৩২ সালে গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেণ্টিক এবং তৎকালীন মহারাজা রণজিৎ সিং এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সভা হয় এই প্রেক্ষিতে। ১৮৪৪ সালে সিমলার বিখ্যাত চার্চটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা  হয়। সিমলা পূর্বে দুটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল, ছোট সিমলা এবং মূল সিমলা। ১৮৫০ সালে দুই সিমলার মাঝে সেতু নির্মিত হয়ে সংযোগ স্থাপিত হয়্য।  ১৮৮১ সালের তথ্য মতে সিমলায় প্রায় দুই হাজার বসত বাড়ী ছিল। ১৯০৫ সালে বিখ্যাত অকল্যান্ড টানেল এবং তার পরের বছর কলকা-সিমলা'র টয়ট্রেন খ্যাত রেল লাইন নির্মিত হয়; যা ২০০৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব হেরিটেজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভৌগলিক দিক দিয়ে সিমলার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফিট এবং দৈর্ঘে পূর্ব-পশ্চিমে নয় কিলোমিটার বিস্তৃত। সিমলার সবচেয়ে উঁচু স্থান জাখু হিল যেখানে জাখু মন্দির অবস্থিত, উচ্চতা আট হাজার ফিটের একটু বেশী। 

কুফরি হিমাচল প্রদেশের সিমলা জেলার একটি ছোট্ট হিল ষ্টেশন। সিমলা শহর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ২২ এর দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই শহরটি। ‘কুফরি’ শব্দটি স্থানীয় শব্দ ‘কুফ্র’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘লেক’। এখানে রয়েছে ‘হিমালায়ান ওয়াইল্ড লাইফ জু’। মজার ব্যাপার ১৮১৯ সালের আগে এই এলাকা মানুষের অজানা ছিল, মাত্র দুইশত বছর আগেও!!! একদল ইংরেজ পর্যটক বনের ভেতর দিয়ে ট্র্যাভেল করতে গিয়ে আবিস্কার করেন এই অপার সৌন্দর্যের জায়গাটি। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে হিমাচল ট্যুরিজম এর উদ্যোগে এখানে উইন্টার স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয় যেখানে দেশ বিদেশ হতে হাজারো পর্যটক ভিড় করে। [sb]ফাগু[/sb] কুফরি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে প্রায় ২৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ফাগু শীতে স্কিয়িং আর উইন্টার স্পোর্টস এর জন্য দেশ-বিদেশ এর পর্যটকদের কাছে এবং গ্রীষ্মে স্থানীয়দের জন্য পিকনিক স্পট হিসেবে খুব জনপ্রিয়। এখানকার চুড়ো থেকে ‘গিরি উপত্যকা’র অসাম ভিউ দেখতে পাওয়া যায়।

 

কুফরিতে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে আট হাজার ফিট উপরে অবস্থিত দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম সেরা একটি এমিউজমেণ্ট পার্ক। আমাদের শিডিউলে এটা লেখা ছিল না, যাত্রা পথের পাশে পড়ে বলে বিপিন সাহেব উদারতা দেখিয়ে আমাদের নিয়ে এলেন। চমৎকার এই পার্কের বাহিরে আমরা চা পান করলাম, ভেতরে ঢুকলাম না, কারণ পার্কে বেড়ানোর কোন প্ল্যান ছিল না। আর পার্ক বেড়ানোর তেমন ইচ্ছেও কারো ছিল না। তবে না বেড়িয়ে খুব মিস করেছি।   


Adventure Resorts New Kufri হল হিমাচল প্রদেশের প্রথম এমিউজমেণ্ট পার্ক যা বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এবং এশিয়ার প্রসিদ্ধ একটি। সম্মুখের মাদকতাময় পাহাড়ের সৌন্দর্য আর তার সাথে হাইকিং, স্কিয়িং এবং আরও সব এডভেঞ্চার রাইড নিয়ে এই পার্কটি সাজানো হয়েছে। রাইডগুলোর মধ্যে অন্যতম “স্কাই সুইংগার”; ৩২ মিটার উঁচু এই স্কাই জাম্পিং রাইড ভারতে প্রথম যা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ৯০০০ ফুট উচ্চতার এডভেঞ্চার রাইড। এছাড়া রয়েছে বাঞ্জি ট্রেম্পলাইন (৪০ ফিট), জীপ লাইন (২০০ মিটার), ফ্রিশবি রাইড, সুইং ইট, গো কার্টিং, বাঞ্জি ইজেকশন ফর কিড, ক্যাঙ্গারু জাম্প, ওয়েভ ট্রেন, স্ম্যাশ কার, হরর হাউস। এছাড়া এডভেঞ্চার স্পোর্টস এর মধ্যে রয়েছেঃ ভ্যালী ক্রসিং, রোপ ব্যালান্সিং ব্রিজ, ব্যাম্বু ব্রিজ, ইউ রোপ ব্রিজ, বার্মা ব্রিজ এবং কমান্ডোজ নেট ক্লাইম্বিং। রয়েছে ফ্যামিলী রাইড, ফাইভ ডি মুভি, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট সহ নানান সুবিধা। 

 

 

 

 

কুফরি-ফাগু মূলত সিমলার মূল টুরিস্ট ডেসটিনেশন, অতি অবশ্যই শীতকালে। যদিও আমরা গিয়েছিলাম শীতের একটু আগে, বরফ তখনো পড়ে নাই। স্কিয়িং এর জন্য হাজারো পর্যটক কিন্তু কুফরি ভ্রমণে আসেন প্রতি বছর। কুফরি হয়ে আমরা ফাগু এলাম, এটা কুফরি’র একটি পর্যটন কেন্দ্র। ডিসেম্বর থেকে কুফরি’তে বরফ পড়া শুরু হয়। কিন্তু এই নন-সিজনেও দেখলাম পর্যটকের ভিড়। দেখা মিলল বাঙালী পর্যটকের, এমন কি বাংলাদেশী এক পৌঢ় দম্পতির সাথে সাক্ষাত হল। সেখানে গিয়ে আপনাকে ঘোড়ায় রাইড করতে হবে, আসলে  না করলেও আপনি আধঘণ্টার কম সময়ে পায়ে হেঁটেই চলে যেতে পারবেন টপ ভিউ পয়েন্টে। সেখানে সময়টা খারাপ কাটবে না, দূরে 'মাহেসু পিক' দেখা যায়। এডভেঞ্চার প্রিয় ট্রেকার’রা কুফরি থেকে ট্রেকিং করে মাহেসু শিখরে আরোহণ করে থাকে। বেশ কিছুটা চমৎকার সময় সেখানে কাঁটিয়ে আমরা ফিরতি পথ ধরলাম দুপুরের প্রায় শেষ সময়ে। এবার পথে কোন রেস্টুরেন্ট লাঞ্চ করে সরাসরি চলে যাব সিমলা ম্যালে। ঘোড়ায় চড়ে ফের নীচে নেমে এসে গাড়ীতে করে রওনা হলাম সিমলা’র পথে। 

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ