ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে একদিন - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২০)
গেল জুন মাসে হুট করেই ঝটিকা সফর করেছিলাম দিনাজপুর-রংপুর, উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত লিচুর বাজার ঘুরে দেখা; সাথে ‘রথ দেখা, কলা বেচা’র মত দু’তিনটি জমিদার বাড়ী ঘুরে দেখা। দুদিনের সেই ট্যুরের দ্বিতীয়দিন সকালবেলা দিনাজপুর রাজবাড়ী ভ্রমণ শেষে আমি আর আমার ভ্রমণ সঙ্গী, আমার অনুজ, ছোট ভাই; দুজন মিলে চলে গেলাম ঘঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী। দিনাজপুর রাজবাড়ী থেকে একশত টাকার মত ভাড়া আর আধঘন্টার মত সময় লাগলো ব্যাটারিচালিত রিকশা করে ঘুঘুডাঙ্গা পৌঁছতে।
আমাদের রিকশাচালক প্রবীণ লোক, এক্কেবারে জমিদার বাড়ীর উঠোনে নিয়ে থামালেন রিকশা। রিকশা থেকে নেমে যে কয়েকটি পুরানো ধাঁচের স্থাপনা দেখা গেল, তাতে এটাকে জমিদার বাড়ী বলে মেনে নিতে মন চায় না। প্রধান ফটকের চিহ্ন এখনো রয়েছে, সেটি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখি বেশ ভেতরের দিকে একটা চাপকলে বয়স পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক স্নান করছেন। আমাদের দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি চাই? তাকে বললাম জমিদার বাড়ী দেখতে এসেছি। উনি ভেতরের দিকে ঘুরে দেখতে বললেন। ভেতরে ঢুকে সেইরকম কোন স্থাপন দেখা গেল না। একতলা দুটি ভবন টিকে আছে এখনো আর একটি ভগ্ন ঘরের দেখা পেলাম।
জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে দুঃখ হয়, কিভাবে অবহেলায় এসব নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।
এরই মধ্যে ঐ ভদ্রলোক তার স্নান শেষ করে আমাদের কাছে এলেন। উনি এই জমিদার বাড়ীর চতুর্থ/পঞ্চম বংশধর। অনেক কথা বললেন ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার বাড়ী নিয়ে। তৎকালীন দিনাজপুর অঞ্চলে অনেকগুলো জমিদার ছিলেন, তারমধ্যে ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার ছিলেন মুসলমান এবং বেশ প্রভাবশালী। পেছনের দিকে আজো রয়েছে জমিদারদের কবরস্থান। তার আগে একটি বন্ধ ঘর দেখলাম, এটি ছিল অতিথিশালা, এখন তালাবদ্ধ। বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে উনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, আমার ফোন নাম্বার নিলেন ভদ্রলোক, জমিদার বাড়ী নিয়ে লেখালেখি করি শুনে বললেন উনার সংগ্রহে দিনাজপুরের জমিদারদের নিয়ে লেখা একটি বই আছে, ফটোকপি করে পাঠিয়ে দিবেন।
উইকিপিডিয়া ঘাটতে দেখি বেশ তথ্য রয়েছে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী সম্পর্কে। নিজে আর নতুন করে না লিখে সেখান থেকে তুলে দিলামঃ ‘ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের আদি পুরুষ নবীর মোহাম্মদ এর পুত্র ফুল মোহাম্মদ চৌধুরী নির্মিত একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে ৩০টি থানা নিয়ে গঠিত অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার মুসলমান জমিদারদের মধ্যে ছিল ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার।
পূর্নভবা নদীর বামতীরে ঘুঘুডাঙ্গা নামে প্রাচীন গ্রামটির অবস্থান দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ৬মাইল দক্ষিনে কোতয়ালী থানার আউলিয়াপুর ইউনিয়নে। ঘুঘুডাঙ্গা থেকে মাত্র ১২মাইল দক্ষিণে পূর্নভবা নদীর পূর্বতীরে অবস্থান ছিল গুপ্ত পাল শাসনামলে কোটিবর্ষ বিষয়ের শাসন কেন্দ্র কোটিবর্ষ নগরী; যা পরবর্তীতে বানগড় বা দেবকোট নামেও পরিচিত ছিল। ১২০৪-০৫ বাংলা সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজী বাংলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল অধিকারের পর প্রথমে লখনৌতি নামক স্থানে তার রাজধানী স্থাপন করলেও পরবর্তীকালে তিনি এই দেবকোটে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। দেবকোট থেকে তিনি ব্যর্থ তিব্বত অভিযানে গিয়ে ফিরে আসেন এবং এ দেবকোটেই তিনি নিহত হন। এ স্থানেই মুসলিম আমলে দমদমা দূর্গও নির্মিত্ত হয়েছিল। তবে এ সবই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এ ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর নিকট এখন রয়েছে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানা সদর।
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের আদি পুরুষ ছিলেন নবীর মোহাম্মদ। তিনি জলপাইগুড়ি থেকে নদীপথে ব্যবসা উপলক্ষে ঘুঘুডাঙ্গার কিছু দূরে পাথর ঘাটায় আসেন এবং বাসাবাড়ী নির্মান করে ৫০০টি ধানভাঙ্গা ঢেঁকি স্থাপন করে নদীপথে কলকাতার চিৎপুরেও ধান চাউলের ব্যবসা কেন্দ্র স্থাপন করেন। তার পুত্র ফুল মোহাম্মদ চৌধুরী ক্রমান্বয়ে বহু জমিদারী ক্রয় করেন এবং পাথর ঘাটা হতে ঘুঘুডাঙ্গার জমিদার বাড়ি নির্মান করেন। ফুল মোহাম্মদের তিন পুত্র ছিল ওলি মোহাম্মদ চৌধুরী, মোজহর মোহাম্মদ চৌধুরী ও হাজী জমির উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। হাজী জমির উদ্দিনের ৫ পুত্রের নাম মহিউদ্দীন আহাম্মদ চৌধুরী, সিরাজ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী, এমাজউদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, হাজী আমিনউদ্দীন আহমদ চৌধুরী এবং হাজী রহিমউদ্দীন আহমদ চৌধুরী।
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী এলাকা ছিল ১১টি থানার মধ্যে। এগুলো হচ্ছেঃ দিনাজপুর সদর উপজেলা, গঙ্গারামপুর, কুশুমুন্ডি, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ইটাহার, পীরগঞ্জ উপজেলা - ঠাকুরগাঁও, ঠাকুরগাঁও জেলা, বিরল উপজেলা, বোচাগঞ্জ উপজেলা, মালদা (রাইও-মুছিয়া)। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর বার্ষিক ইজারা ছিল প্রায় ১ লক্ষ টাকা। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী এলাকায় ছিল ৪১ টি তহশিল অফিস এবং প্রায় ৮০জন বরকন্দাজ, পেয়াদা। দিনাজপুর শহরের বড় ময়দানের পূর্ব পার্শ্বে ঈদগাহ বস্তী মহল্লায় ২টি প্রাচীন কুটিবাড়ী সহ এক বিরাট এলাকা এ জমিদার পরিবারের সম্পত্তি ছিল।
১৯৪৭সালে দেশ বিভাগের পর ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারীর বেশীর ভাগ এলাকা ভারতের অর্ন্তভূক্ত হয়। দেশ বিভাগের পর পরই দিনাজপুর জেলা প্রশাসন জরুরি শাসন কার্য পরিচালনার নিমিত্তে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারী হতে কিছু টাকা কর্জ হিসাবে গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে অবশ্য এ টাকা পরিশোধ করা হয়। পঞ্চাশের দশকে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের ফলে এ পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতার ক্রমাবনতি ঘটে।
তত্কালীন দিনাজপুরের ১১টি থানায় এই জমিদারের জমিদারি ছিল। তার জমিদারি থেকে বার্ষিক ১ লাখ টাকা খাজনা দিতে হতো ব্রিটিশ সরকারকে। ১৮টি কাচারি ও ৪১টি তহসিল অফিসের মাধ্যমে পরিচালিত হতো জমিদারি। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেন নবীর মোহাম্মদের একমাত্র পুত্র ফুল মোহাম্মদ। পর্যায়ক্রমে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারি স্থায়ী ছিল ৮০ বছরের মতো। জানা গেছে, ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়িটি ছিল এক তলা-দোতলা মিলে একটি অনুপম পাকা ভবন। এখন অবশ্য ভগ্নদশায় রয়েছে বিরাট প্রবেশদ্বার। তখন ফুল-লতাপাতায় সজ্জিত ছিল এর দ্বার। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। আর অন্যান্য জমিদার পরিবারের মতো ছিল পাইক-পেয়াদা-সিপাই, বাবুর্চি, খানসামা, খামারু ইত্যাদি। ছিল একজন ম্যানেজার। ছিল মেহমানখানা ও একটি সুদৃশ্য মসজিদ। সপ্তাহ বা মাসে বসত মেহমানখানা চত্বরে গ্রামপ্রধানদের আসর। এ আসরে আলোচনা হতো শান্তি-শৃঙ্খলা, সামাজিক, চাষাবাদ ও আর্থিক নানা বিষয়। মেহমানখানার পেছনদিকে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের দুটি কবরস্থানও রয়েছে।
এই জমিদার বাড়িতে দুর্লভ অনেক সামগ্রী ছিল। একটি সোনার চেয়ার ছিল, যা বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া ১০১ ভরি ওজনের সোনা দিয়ে তৈরি কৃত্রিম কই মাছ, রুপার বাটযুক্ত ছাতা, পাখা, রুপা নির্মিত লাঠি, তামার ডেকচিসহ দুর্লভ সামগ্রী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। হানাদাররা এ বাড়ির ওপর বোমা বর্ষণ করে অনেক কিছুই ধ্বংস করে দেয়। তাই এটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি হিসেবে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাত্রিতে গণহত্যা শুরুর কয়েকদিন পর দিনাজপুরের বাঙ্গালী, আর্মি, ইপিআর, পুলিশ সহ মুক্তি বাহিনীল প্রায় ১৫০০সদস্য, ২২পি যানবাহন ও প্রচুর অস্ত্রসহ ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামে ক্যাম্পে স্থাপন করে। এছাড়া দিনাজপুর শহরের সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বহু কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ পাক আর্মির অত্যাচারের ভয়ে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার পরিবারের সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতায় এ বিপুল সংখ্যক মুক্তিবাহিনী, কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের কয়েকদিন যাবত আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। পাক সৈন্যগন ঘুঘুডাঙ্গা অভিমুখে অগ্রসর হলে জমিদার পরিবারের সদস্যসহ সাধারণ মানুসগণ ঘুঘুডাঙ্গা পরিত্যাগ করে ভারতীয় এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। হানাদার পাকা সৈন্যরা মুক্তি ফৌজকে আশ্রয় ও সাহায্য সহযোগিতা দানের কারনে ঐতিহাসিক ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ীতে বোম সেলের আঘাতে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করে। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর জমিদার পরিবারের সদস্যরা দেশে ফেরত আসেন। জমিদার বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হওয়ায় তারা ক্রমে দিনাজপুর শহরের ঈদগাহবস্থী মহল্লায় তাঁদের নিজস্ব জায়গায় বাড়ীঘর নির্মাণ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেও ঘুঘুডাঙ্গা এষ্টেটে দুর্লভ সামগ্রীর মধ্যে ছিল একটি সোনার চেয়ার দেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে, ১০১ ভরি ওজনের সোনার একটি কৃত্তিম কইমাছ,রূপার বাটযুক্ত একটি সুদর্শন ছাতা, রূপার বাট নির্মিত একটি বিরাট হাত পাখা ৪টি রৌপ্য নির্মিত্ত আসা (লাঠি) ইত্যাদি। এ ছাড়া বড় বড় ভোজ সভার রান্নার নিমিত্তে ১৩/১৪টি বিরাট তামার ডেকটি, বিরাট সামিয়ানা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ছিল, যা এককালে দিনাজপুর শহরেরর গন্যমান্য ব্যক্তিগণ বিবাহ বা অন্যান্য ভোজসভার রান্নাবান্নার জন্য ঘুঘুডাঙ্গা থেকে নিয়ে আসতেন। কারন স্বাধীনতার পূর্বে দিনাজপুর শহরে কোন ডেকরেটরের দোকান ছিল না। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক বাহিনী ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ি ধ্বংসের সময় এ সব দূর্লভ সামগ্রী লুট হয়।
মন্তব্যসমূহ