ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলীং টু আরকিওলজিক্যাল সাইটস অফ ঢাকা (শেষ পর্ব)
আমার ঢাকা, প্রাণের ঢাকা, আমাদের ঢাকা। শতবর্ষী এই ঢাকার বুকে আজও টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শতবর্ষী অনেক পুরাকীর্তি যার বেশীরভাগই কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এর তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং নগরায়নের জোয়ারে এগুলোর খোঁজ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আর তাই বোকা মানুষের আয়োজন ছিল তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক, আজ যার শেষ পর্ব থাকছে। তিনটি পর্বে ঢাকা এবং ঢাকা শহরের আশেপাশের বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে এক ভার্চুয়াল ট্যুর করছি আমরা, যাতে করে আগত দিনে যে কেউ চাইলে এই পোস্ট হতে একসাথে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের খোঁজ পেয়ে যেতে পারে সহজেই।
বছর তিনেক আগে পোস্ট করেছিলাম প্রথম পর্ব (পুরাতন ঢাকার লালবাগ হতে শুরু), যেখানে আমরা ভার্চুয়ালি ট্রাভেল করেছিলামঃ [sb]প্রাচীন খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, লালবাগ কেল্লা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, হোসেনী দালান, ছোট কাটারা, বড় কাটরা, তারা মসজিদ, আর্মেনিয়ান চার্চ, আহসান মঞ্জিল[/sb]। এর মাস তিনেক পর দ্বিতীয় কিস্তিতে আমরা ফের ভার্চুয়াল ট্রাভেলিং এ বের হয়েছিলাম এবং ঘুরে দেখেছিলামঃ [sb]লালকুটি/ নর্থব্রুক হল, রূপলাল হাউজ, রোজ গার্ডেন, বিনত বিবির মসজিদ, জয় কালী মন্দির, জিনজিরা প্রাসাদ, নিমতলী প্যালেস ও দেউড়ি, মুসা খান মসজিদ, গুরুদুয়ারা নানকশাহী[/sb]। তো আসুন আজ শুরু করি এরপর থেকে, আহসান মঞ্জিল হতে বুড়িগঙ্গার জল-বাতাসে শেষ বিকেল কাটিয়ে গতদিন এই ভার্চুয়াল ট্র্যাভেলিং শেষ করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত গুরুদুয়ারা নানকশাহী’র প্রাঙ্গনে। শুরু করা যাক সেখান থেকেই।
আমরা শুরু করবো গুরুদুয়ারা নানকশাহী হতে অতি সন্নিকটের বর্ধমান হাউজ হতে।
বর্ধমান হাউজঃ ১৯১৯-১৯২৪ সাল পর্যন্ত বর্ধমানের মহারাজা এই বঙ্গপ্রদেশের গভর্নরের শাসন-পরিষদের সদস্য ছিলেন। সেই সময়ে উনার বসবাসের জন্য এই বাড়ীটি ব্যবহৃত হয়। এবং উনার সেই বসবাসকালীন সময়ে এই ভবনের নাম হয়ে যায় “বর্ধমান হাউজ”। চিনতে পারছেন কি? হ্যাঁ, আপনিও অনেকবার গিয়েছেন সেখানে। জ্বী হ্যাঁ, আজকের বাংলা একাডেমী যে ভবনে অবস্থিত, সেটাই বিখ্যাত বর্ধমান হাউজ। ধারণা করা হয়, স্বল্পস্থায়ী বঙ্গভঙ্গের সময়কালে ১৯০৫ হতে ১৯১১ সাল ব্যাপী পূর্ববঙ্গ এবং আসামের প্রাদেশিক রাজধানী থাকাকালীন সময়ে ১৯০৬ সালের দিকে সাবেক হাইকোর্ট ভবন, কার্জন হল ইত্যাদির নির্মানের সমসাময়িক কালে এই বর্ধমান হাউজও নির্মিত হয়েছিল। ইতিহাস মতে, এই ভবনটি সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং অতিথিদের রাত্রীযাপন এর জন্য গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য নির্মিত হয়েছিল। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বর্ধমান হাউজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে পড়ে যায়। ফলে বেশ কিছু সময় এই ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং শিক্ষকদের আবাসস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯২৬ সালের দিকে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এই বর্ধমান হাউসে বসবাস করতেন। তখন তিনি সলিমউল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর ছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম দেশ বিভাগের আগে ঢাকায় এসে এই ভবনে ছিলেন, এমন তথ্য জানা যায়। দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী’র বাসভবন হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্টের সাথে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন বর্ধমান হাউস ত্যাগ করার পর এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে “বাংলা একাডেমী” যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর থেকে এটি বাংলা একাডেমী’র কার্যালয় হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ভিক্টোরিয়ান রীতিতে নির্মিত এই ভবন নির্মানের সময় ছিল একটি দ্বিতল ভবন। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে আগের নকশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এটিকে ত্রিতল ভবনে উন্নীত করা হয়।এবার এখান হতে আমরা যাব মীর জুমলা গেইট হয়ে মুসা খান মসজিদ এবং হাজী শাহবাজ এর মসজিদ এবং মাজার প্রাঙ্গনে।
মীর জুমলা গেইটঃ দোয়েল চত্বর হতে বাংলা একাডেমী হয়ে টিএসসি যাওয়ার পথে দুটি হলুদ রঙ্গা পিলার চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই। অনেকেরই মনে হয়েছে এটি কিসের তোরণ? হ্যাঁ, এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক মোঘল আমলের স্থাপনা, যার নাম মীর জুমলা গেইট যা ঢাকা গেট, রমনা গেট বা ময়মনসিংহ গেট নামেও পরিচিত। এই গেটের তিনটি অংশের একটি পড়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, রোড ডিভাইডারের উপর মাঝের অংশ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে তিন নেতার মাজারের পাশে। মতবিরোধ থাকলেও ধারণা করা হয়, মোঘল শাসক আওরঙ্গজেব এর আমলে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা রমনা অঞ্চলে এই গেটটি নির্মাণ করেন। ঢাকা নগরীকে উত্তর দিক হতে মগদের আক্রমণ থেকে প্রতিহিত করার লক্ষেই এটির নির্মাণ বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এবং ঢাকার ইতিহাসের সবচাইতে গ্রহণযোগ্য লেখক আহমদ হাসান দানী এই গেটের নির্মাণ এর ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এই গেটের ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে মতামত দেন, এই গেট মোঘল আমলে নির্মিত হয় নাই। আর এর নকশা এবং গড়ন ইউরোপীয় রীতির। তার মতানুসারে ১৮২০ হতে ১৮২৫ সালের দিকে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডয়’স মূল শহরের সংগে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি রাস্তা তৈরী করেন এবং সেই সঙ্গে তৈরী করেন এই গেইটও। তো ইতিহাস যাই হোক, বর্তমানে এই ঐতিহ্যবাহী ঢাকা গেটটি সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসাবশেষ নিয়ে পড়ে আছে। দেখে বুঝার উপায় নেই এটিই ঐতিহ্যবাহী ঢাকা গেট তথা মীর জুমলা গেইট।
মুসা খান মসজিদঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শহীদুল্লাহ হলের পশ্চিম পার্শ্বে এই মুসা খান মসজিদ এবং মুসা খানের মাজার তথা সমাধিস্থলটি রয়েছে। ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই বাংলায় মুসলমান শাসকদের যাত্রা শুরু। এরপর নানান সময়ে এই বঙ্গদেশ এর শাসন ক্ষমতা ছিল মুসলিম শাসকদের হাতে। সেই ধারাবাহিকতায় একসময় মোঘলদের হটিয়ে বাংলার শাসন চলে যায় বারো ভুঁইয়াদের হাতে। আর সেই বারো ভুঁইয়াদের একজন ভাটি অঞ্চলের অধিপতি ঈসা খানের পুত্র মুসা খান ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তো সেই মুসা খানের আমলে বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বেশ কিছু স্থাপনা নির্মিত হয় মুসা খানের আমলে, যার একটি হল এই “মুসা খান মসজিদ”। মূলত মুসা খানের আমলে রমনা এলাকার চারিপাশ ছিল “বাগ-ই-মুসা” নামে পরিচিত। তো সেই এলাকায় মুসা খান নানান স্থাপনা নির্মান করেছিলেন। কিন্তু ১৯০৪ সালে কার্জন হল নির্মানের সময় অন্যান্য স্থাপনাগুলো ভেঙ্গে ফেলা হলেও শুধুমাত্র মুসা খান মসজিদ এবং তার মাজার তথা সমাধিস্থলটি অক্ষত রাখা হয়েছিল। প্রথম তলায় ছোট ছোট কক্ষ বিশিষ্ট স্থাপনার উপর দ্বিতল মসজিদটি নির্মান করা হয়েছিল। দক্ষিণ দিক থেকে মসজিদের দোতলার মূল উপাসনা স্থলে যাওয়ার জন্য ১২ ধাপের একটি সিঁড়ি রয়েছে। উপরে উঠলে দেখা যাবে পুর্বদিকে রয়েছে খোলা জায়গা। মসজিদের পূর্বপাশের দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ পাশের দেয়ালে একটি করে দরজা রয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে মোট তিনটি মেহরাব রয়েছেঃ একটি প্রধান মেহরাব এবং দুটি ছোট মেহরাব। মসজিদের দেয়ালগুলো মোঘল স্থাপত্যরীতি অনুসারে নির্মিত। মসজিদে মোট গুম্বজ এবং মিনারের সংখ্যা ১৬টি। মসজিদের ছাঁদে মোট তিনটি গুম্বজ রয়েছে। মসজিদ নির্মাণে আগুনে পোড়ানো ইট ও চুনসুড়কির সাথে অল্প পরিমাণে পাথর ব্যবহৃত হয়েছিল। পূর্ব দিকে রয়েছে মুয়াজ্জিনের জন্য থাকার একটি ছোট কক্ষ। চক মসজিদ (১৬৭৬) ও ঢাকার অন্য আরও কয়েকটি মসজিদের মতো মুসা খান মসজিদটিও একটি উঁচু মেঝের উপর নির্মিত, যার নিম্নদেশে খিলানছাদ বিশিষ্ট কয়েক সারি কক্ষ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে বুকসেলফ সদৃশ অবকাঠামো রয়েছে, যা থেকে অনুমান করা হয় মসজিদটি নির্মাণের সময়ে “মাদ্রাসা মসজিদ” হিসেবেই নির্মিত হয়েছিল, যা মোঘল ঢাকার অনেক মসজিদেই এই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়ে। মসজিদটির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মুসা খানের সমাধিটি রয়েছে।
হাজী শাহবাজের মসজিদ এবং সমাধিঃ দোয়েল চত্বর এবং শিশু একাডেমী এর মাঝামাঝি, রমনা রেসকোর্স এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পুরাতন একটি স্থাপনা চোখে পড়ে থাকবে। তিন নেতার মাজার এর সন্নিকটে যে প্রাচীন মসজিদটি রয়েছে, সেটি হল প্রাচীন “হাজী শাহবাজ মসজিদ এবং সমাধি”। মোঘল স্থাপত্য এই মসজিদটি শাহজাদা আযম এর শাসনকালে ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। এই মসজিদ চত্বরেই হাজী শাহবাজ এর সমাধিটি রয়েছে। শাহজাদা মুহম্মদ আযম এর শাসনকালে হাজী শাহবাজ নামক একজন অভিজাত ধনী ব্যবসায়ী এই মসজিদটি নির্মান করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। হাজী শাহবাজ কাশ্মীর হতে এই বাংলায় এসে টঙ্গী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। মসজিদটির নির্মাণশৈলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উত্তর ভারতীয় মুঘল স্থাপত্যরীতি’র সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। ৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৬ ফুট প্রশস্ত এই মসজিদটির মিম্বর এবং চৌকাঠ পাথরের তৈরী। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের গুম্বজ তিনটি ছাড়া আর কোনো মূল স্থাপত্যশৈলী বর্তমানে আর অবশিষ্ট নেই। তবে, বর্তমানে ঢাকায় যতগুলো মুঘল স্থাপত্যের মসজিদ বিদ্যমান আছে, তার মধ্যে শাহবাজ মসজিদ সংরক্ষণের বিবেচনায় সবচেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে।
এরপর চামেরী হাউজ হয়ে সূত্রাপুরের জমিদার বাড়ী এবং ভজহরি লজ দেখতে চলে যাই।
চামেরী হাউজঃ ১৯২০ সালের দিকে ইংরেজ প্রশাসকদের আবাসনের নিমিত্তে ঢাকার হাইকোর্ট ভবনের উল্টোদিকে ইউরোপীয় কুটিরের আদলে এই চামেরী হাউস নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে চামেলি হাউস নামফলক থাকলেও এটি নির্মানের সময় এর নামকরণ হয়েছিল চামেরী হাউস নামেই। ইতিহাস মতে, রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঢাকা পরিভ্রমণে এসে এই চামেরী হাউসেই অবস্থান করেছিলেন। এই চামেরি হাউস প্রথমদিকে ইংরেজ ব্যাচেলর প্রশাসকদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে, রমনা এলাকা এবং এর আশেপাশের সকল অবকাঠামো বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর প্রথম দিকে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেশ বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। ১৯৫৭ সালে রোকেয়া হল নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ছাত্রী হোস্টেল হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকে। পরবর্তীতে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ হতে সরকারের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং বিভিন্ন সরকারী অধিদপ্তরের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি ‘সিরডাপ’ এর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সূত্রাপুর জমিদার বাড়ীঃ সূত্রাপুরস্থ এই জমিদার বাড়ীটি ব্রিটিশ আমলের জমিদার রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্র কুমার দাস নির্মান করেছিলেন। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং জমিদার এর পাশাপাশি ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। দেশভাগের সময় জমিদার এর উত্তরসূরিরা এই বসতভিটা ত্যাগ করে ভারত চলে গেলে বাড়িটি পরিত্যক্ত শত্রুসম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বর্তমানে ভবনটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দুটি আলাদ তিনতলা বিশিষ্ট দালানের সমন্বয়ে এই জমিদার বাড়ীর ভবনটি রয়েছে। দক্ষিণের মূল দালানে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু প্রবেশমুখ আছে যার ছাদ তিনটি করিন্থিয়ান স্তম্ভ দ্বারা স্থাপিত। এর দুইপাশের অংশে বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজ দেখা যায়। কয়েকটি লতাপাতামণ্ডিত অর্ধবৃত্তাকার কাঠামো এবং এর নিচে গোলাকার নকশা দেখা যায়। পুরো দালানে বিভিন্ন আয়তনের প্রায় ৩৫ টি কক্ষ বিদ্যমান। সামনের ছোট বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করলে প্রায় ৫০ বর্গফুটের একটি উন্মুক্ত আঙিনায় পৌঁছানো যায় যার তিনদিক দালানে বেষ্টিত এবং মুক্ত পূর্বপ্রান্তটি ধোলাইখালে গিয়ে শেষ হয়েছে। দালানটির পিছনদিকও করিন্থিয়ান স্তম্ভ, তিনটি গোলাকার নকশা পরিবৃত অর্ধবৃত্তাকার কাঠামো ও অন্যান্য ফুলপাতার কারুকাজ দ্বারা শোভিত।
শঙ্খনিধি হাউজঃ বিশ শতকের শুরুর দিকে তিন ভাই ব্যবসায়িক উন্নতির ফলে বণিক উপাধি বর্জন করে ‘শঙ্খনিধি’ (শঙ্খের বাহক) উপাধি গ্রহণ করেন। এই তিন ভাই ছিলেন লালমোহন সাহা বণিক, ভজহরি সাহা বণিক এবং গৌর নিতাই সাহা বণিক। ১৯২০-১৯২৬ সাল নাগাদ তারা ঢাকার বেশ কিছু ভূসম্পত্তির মালিক হন এবং পুরাতন ঢাকার টিপু সুলতান রোড হতে ওয়ারী’র র্যা ঙ্কিন স্ট্রিট পর্যন্ত বেশকিছু ভবন নির্মাণ করেন তারা। এগুলোর মধ্যে এই ‘শঙ্খনিধি হাউজ’ লালমোহন সাহা কর্তৃক ১৯২১ সালে নির্মিত হয়েছিল। এই দক্ষিণমুখী ভবনটি ভূপৃষ্ঠ হতে ৫ ফুট উঁচুতে স্থাপিত। ভবনটি কেন্দ্রীয় অক্ষের সাপেক্ষে প্রতিসম, দুইদিকের প্রান্তে দুটি অষ্টকোণী অংশ বিদ্যমান। অষ্টকোণী অংশদ্বয় দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চূড়ায় অষ্টকোণী গম্বুজ দ্বারা আবৃত। এর বারান্দায় প্রবেশের জন্য ২০ ফুট প্রশস্ত সোপান রয়েছে। বারান্দার সম্মুখে ৪ টি সুশোভিত সরু করিন্থিয়ান স্তম্ভ আছে, যাদের মাঝখানে তিনটি বহুখাজযুক্ত অর্ধবৃত্তাকার তোরণ বিদ্যমান। অষ্টকোণী অংশদ্বয়ের জানালাগুলো সুসজ্জিত তোরণ এবং দুইপাশে সরু লম্বা করিন্থিয়ান স্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত। এই ভবনটিতে একটি কেন্দ্রীয় নাচঘরসহ বিভিন্ন আয়তনের মোট পাঁচটি ঘর রয়েছে। এগুলোর আয়তন ২০ফুট * ২৫ ফুট এর কাছাকাছি। মূল নাচঘরের কারুকাজশোভিত কাঠের আচ্ছাদনটি প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এই বণিক বংশের সদস্যরা ভারতে চলে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই বাড়িটি ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিকারে চলে আসে। নানান হাত ঘুরে ১৯৮০ সালে ভবনটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেও নানান অবহেলায় এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে শঙ্খনিধি হাউস অরক্ষিত অবস্থায় দখলদারদের কবলে পড়ে নিজের জৌলুস হারিয়ে কোনোমতে টিকে আছে। দখলদারদের কেউ কেউ গ্যারেজ ও দোকানপাট বসিয়েছে, কেউ বা সপরিবারে বসবাস করছে।
ভজহরি লজঃ সেই বণিক ভাইদের একজন ভজহরি বণিক ১৯২৫ সালে নিজে বসবাসের জন্য এই ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে এই ভবনটি আর নেই। ভবনটির স্থানে পরবর্তীকালে গ্রাজুয়েট হাইস্কুল ও সলিমুল্লাহ কলেজ নির্মিত হয়। দ্বিতল এই ভবনটির দক্ষিণমুখী দরজার সামনে ৫০ ফুট দীর্ঘ বারান্দা রয়েছে। ভবনটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি প্রধান দরজা রয়েছে। এই তিনটি প্রধান দরজার উপরস্থিত তলায় রয়েছে তিনটি জানালা, কেন্দ্রীয় জানালাটিতে রয়েছে বহকোণী উপরিভাগ আর দুপাশের জানালাগুলোয় অর্ধ-গম্বুজ। কেন্দ্রীয় অংশের উপরের প্যারাপেটে রয়েছে ত্রিকোণাকার সুশোভন প্লাস্টার। প্রত্যেক তলায় ৫০ ফুট বাই ২০ ফুট মাপের তিনটি করে বড় হলঘর আছে যেগুলোর প্রত্যেকটির সাথে ৬ ফুট প্রশস্ত বারান্দা বিদ্যমান। উপরের তলায় যাওয়ার জন্য দক্ষিণপূর্ব কোণে একটি কাঠের সিঁড়ি আছে, এছাড়া পিছনদিকেও আছে একটি। হলঘরের তক্তাগুলো উজ্জ্বল টালি দ্বারা শোভিত। ভবনের সম্মুখভাগে একটি সুদৃশ্য ফোয়ারা ছিল, যদিও পরে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এবার দুপুরের খাবার খেতে চলে আসি বাংলা বাজারে ১নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত “বিউটি বোর্ডিং” এ; দুপুরের খাবার এর জন্য। ভর্তা-ভাজি-মাছ-মাংস দিয়ে খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে নিতে পারেন ঐতিহাসিক এই বোর্ডিং এর ইতিহাস এবং এখানে পদধূলি ফেলেছিলেন যে সকল বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ তাদের তালিকা।
খাওয়াদাওয়া’র পাট চুকে গেলে আমরা এখান হতে সোজা রওনা হব মোহাম্মদপুরের দিকে। সেখানে দেখবো সাতগুম্বজ মসজিদ এবং সেখান হতে ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ দেখে সমাপ্ত হবে আমাদের এই ঢাকার প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ভ্রমণের তিনদিনের ভ্রমণ পরিক্রমা।
সাত গম্বুজ মসজিদঃ মোহাম্মদপুরের কাটাসুর থেকে শিয়া মসজিদ হয়ে বাঁশবাড়ী যাওয়ার রাস্তায় প্রাচীন এই সাত গম্বুজ মসজিদটি অবস্থিত। ধারণা করা হয়, ১৬৮০ সালে মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান এর পুত্র উমিদ খান এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মানশৈলী সমসাময়িক অন্যান্য মসজিদ এবং স্থাপনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রতিয়মান হয়। সাতগুম্বজ বিশিষ্ট এই মসজিদের নামায পড়ার মূল চত্বর এর ছাদের উপর তিনটি গুম্বজ এবং চার কোণায় অবশিষ্ট চারটি গুম্বজ রয়েছে। ২৬.৮২ মি × ২৫.৬০ মি পরিমাপের বহিরাঙ্গন বিশিষ্ট এই মসজিদের ভেতরকার আয়তন ১৪.৩৩ মি × ৪.৮৮ মি। সামান্য উঁচু পাকা একটি ভিতের উপর পশ্চিম অংশ জুড়ে মসজিদটি স্থাপিত এবং এই ভিত্তিটি নিচু একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। পাশের অলঙ্কৃত ছোট মিনারসহ এই খিলানপথটি মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ বরাবর অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে প্রবেশপথটির সাথে সংযুক্ত হয়েছে সিঁড়ি। এই মসজিদের নামায কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে মোট পাঁচট খিলানপথ; যার তিনটি পূর্ব দেওয়ালে এবং বাকী দুটি উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে অবস্থিত।
ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহঃ ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ মাঠটি ১৬৪০ খিস্টাব্দে নির্মিত একটি মুঘল স্থাপনা যার স্থপতি হিসেবে ইতিহাস হতে মীর আবুল কাশেম এর নাম জানা যায়। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা এর শাসন আমলে মীর আবুল কাশেম ছিলেন অত্র এলাকার দেওয়ান। তৎকালীন র মূল ঢাকা শহর হতে কিছুটা দূরে পান্ডু নদীর একটি শাখা জাফরাবাদ এর সাতগুম্বজ মসজিদ এর কাছে বুড়িগঙ্গার সাথে মিলিত হত। মোঘল শাসকেরা ঈদের সময় দলবল সহ এই শাহী ঈদগাহে আসতেন ঈদের নামায আদায়ের জন্য। মুনশী রহমান আলী তায়েশ তার তাহরিখে ঢাকা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, পরবর্তীতে এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতে আসতেন ঢাকা ও এর আশপাশের সাধারণ মুসলমানরাও। সেখানে মেলারও আয়োজন হতো। ১৯৮১ সাল হতে এই স্থাপনাটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। সমতল হতে চার ফুট উঁচু করে প্রায় ১৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং প্রায় ১৩৭ ফুট প্রস্থ বিশেষ্ট এই ঈদগাহটি নির্মাণ করা হয়েছিল বন্যা, জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য। এই ঈদগাহ এর চার কোণে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। পশ্চিম প্রাচীরঘেঁষে রয়েছে প্রধান মিহরাব যার দুপাশে আরো দু’টি ছোট আকারের মিহরাব রয়েছে। প্রায় চারশত বছর পুরাতন এই ঈদগাহে এখনও প্রতি বছর দুই ঈদে “ঈদের জামাত” অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
মন্তব্যসমূহ