কাজীর শিমলা - ময়মনসিংহ ভ্রমণ গাইড

কাজীর শিমলা

বাংলার জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, কাজী নজরুল ইসলাম। এই বাংলায় তিনি বহুবার এসেছেন, শেষ জীবন এখানে পার করে দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে। কিন্তু এই বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ১৯১৪ সালে পা রাখেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং তা আর কোথাও নয়, বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল ইউনিয়নের কাজীর শিমলা গ্রামে। ১৮৯৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের চুরুলিয়ায়; যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম বর্ধমান জেলায় অবস্থিত। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়ে দারিদ্রতার মুখোমুখি দাঁড়ান এবং মাত্র দশ বছর বয়সে পরিবারের হাল ধরার জন্য জীবিকা অর্জনে পথে নামেন। এই সময়টায় উনি কখনো মক্তবে নীচের দিককার ক্লাসে শিক্ষকতা, কখনো কবরের সেবক আবার কখনো মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। কিন্তু এসবে মন টিকে নাই কিশোর নজরুলের; তিনি যোগ দেন লেটো দলে যা ছিল তৎকালীন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল। পরবর্তীতে তিনি একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে।

আর এই আসানসোলের রুটির দোকানে কাজ করার সময়ই কাজী নজরুল ইসলাম নজরে আসেন সেখানে কর্মতর দারোগা রফিজউল্লাহ'র; হয় উনার সাথে তার পরিচয় হয়। রুটির দোকানের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিশোর নজরুল একাকী লিখতেন দারুন সব কবিতা আর ছড়া। আর উচ্চরুচির দারোগা রফিজউল্লাহ কিশোর নজরুলের সেসব কবিতা ও ছড়া রচনা দেখে তার প্রতিভার পরিচয় পান। নিজের সাথে তিনি কাজী নজরুলকে নিয়ে আসেন নিজের গ্রাম ত্রিশালের কাজীর শিমলায়। এখানে এনে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। যদিও প্রথমে উনাকে ভর্তি করতে চেয়েছিলেন ময়মনসিংহের সিটি স্কুলে; কিন্তু কোথাও জায়গীর না পাওয়ায় সেখানে পড়া হয় নাই কাজী নজরুল এর। কিন্তু সমস্যা রয়েই গিয়েছিল; কেননা দরিরামপুর স্কুল কাজীর শিমলা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই পথ সারাবছর পাড়ি দিয়ে স্কুল করা খুব কষ্টের ছিলো বিধায় দারোগা রফিজউল্লাহ ত্রিশালের নামাপাড়ায় তার এক আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহ'র বাসায় কিশোর নজরুলের জায়গীর এর ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু ধার্মিক হামিদুল্লাহ'র বাসায়ও নজরুল এর ঠিকানা বেশীদিন স্থায়ী হয় নাই; সেখান থেকে তিনি বিচুতিয়া গ্রামের বেপারী বাড়িতে জায়গীর থাকেন। 

সেই বেপাড়ী বাড়িতেই তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। প্রথম তলায় অডিটোরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস রুম এবং তৃতীয় তলায় লাইব্রেরি রয়েছে। এছাড়াও কবি যে ঘরে ঘুমাতেন; সেই ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই একটি পুকুর খনন করা হয়েছে। কেননা, নজরুল যে ঘরটিতে থাকতেন তার পাশেই পূর্বদিকে ছিল একটি পুকুর। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত সেই দরিরামপুর স্কুল এখন নজরুল একাডেমী'তে রুপান্তরিত হয়েছে।সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রফিজউল্লাহ দারোগা বাড়ির আঙিনায় নির্মাণ করা হয়েছে নজরুল পাঠাগার ও স্মৃতি ভবন; যেখানে সংরক্ষণ করা আছে নজরুলের নানান স্মৃতি। 

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে বটতলা নামাপাড়া এলাকায় রয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। এখানে সংরক্ষিত আছে কবির ব্যবহৃত বিভিন্ন দুর্লভ উপকরণ, স্বরচিত গান, কবিতা ও গল্পসহ বেশ কিছু বই এবং কিছু আলোকচিত্র। কবি'র জীবন নিয়ে রচিত নানান বই এবং নজরুল সাহিত্য নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পাঠাগার। 

কি কি দেখবেনঃ 

(১) কাজীর শিমলার দারোগা বাড়ী

(২) দরিরামপুর নজরুল একাডেমী

(৩) নামাপাড়ার নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র

(৪) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, নামাপাড়া

(৫) বটতলা (স্কুল পালিয়ে ত্রিশাল নামাপারা শুকনি বিলের পাড়ে একটি বট গাছের নিচে কবি নজরুল আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন যা বর্তমানে দুই বাংলার নজরুলপ্রেমীদের নিকট "নজরুল বট বৃক্ষ" হিসেবে সমাদৃত।

যাতায়াতঃ দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে প্রথমে চলে আসুন ময়মনসিংহ। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সারাদিনে অসংখ্য বাস রয়েছে ময়মনসিংহগামী; চাইলে রেলপথেও ময়মনসিংহ চলে আসতে পারেন। বাস হতে ত্রিশাল নেমে পড়ুন। ত্রিশাল বাজারের পাশেই রয়েছে নজরুল একাডেমী। সেখান হতে ঘুরে রিকশা করে চলে আসুন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। এখান হতে বিচুতিয়া বেপারি বাড়ীর নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র আর বটতলা একেবারেই কাছে। সেখান হতে ভ্রমণ শেষে চলে কাজির শিমলা'র দারোগাবাড়ি নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র রিকশাযোগে। 

খাবারঃ স্থানীয় যে কোন খাবার হোটেলেই সেরে নিতে পারবেন সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাবার। সবচাইতে ভাল অপশন বটতলায় দুপুরের খাবার খেয়ে নিলে। 

থাকাঃ এই ভ্রমণ সারাদিনে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এরপরেও কেউ যদি রাত থাকতে চান তাহলে ত্রিশাল এবং কাজীর শিমলার সন্নিকটে মেডিক্যাল রোডে আবাসিক হোটেল আছে সেখানে থাকতে পারেন। অথবা দরিরামপুর নজরুল মঞ্চ'র নিকটে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়নে নির্মিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক রেস্ট হাউজ এ থাকতে পারেন। 

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ