হ্যালো কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত!!! অবশেষে চলে এলাম
শুরুর আগের গল্প
মাঝে মাঝে এমন কিছু অপূর্ণতা থাকে যা চাইলেই পূরণ হয়ে যায়, তারপরও কেন যেন সেই অপূর্ণতাগুলো পূর্ণতা পায় না। কলেজ পেরুনোর পর মনে সাধ জাগলো গারো পাহাড় বেড়াতে যাব; সেই লক্ষ্যে সদলবলে আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে ময়মনসিংহ’র হালুয়াঘাট পর্যন্ত গিয়েও দলের বিরোধীতায় যাওয়া হয় নাই; যা আজও অপূর্ণ থেকে গেল। একইভাবে কক্সবাজার প্রথম বেড়াতে যাওয়ার পর সাধ জাগলো কুয়াকাটাও বেড়িয়ে আসবো; কিন্তু তখনকার জার্নি খুব ঝামেলার হওয়ায় তা আর বাস্তবে রূপ পায় নাই। কিন্তু এই ছোট্ট ভ্রমণ জীবনে শতাধিক ট্যুর দিয়েছি দেশের ভেতর; কিন্তু দুই যুগ পুরাতন সেই ইচ্ছেগুলো কখনো পূর্ণতা পায় নাই অজানা এক কারনে। তো গত দুই বছর করোনার কারনে ঘোরাঘুরি বন্ধ থাকার পর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় সুন্দরবন ভ্রমণ দিয়ে দীর্ঘ ত্রিশ মাসের বিরতি ভঙ্গ হলে পরে বাল্যবন্ধু মনা’কে বললাম কোন এক বৃহস্পতিবার সময় সুযোগ করে একদিনের জন্য কুয়াকাটা ঘুরে আসা যায় কি না। পরিকল্পনা এক রাতে রওনা দিয়ে পরেরদিন সারাদিন কুয়াকাটা বেড়িয়ে রাতের গাড়ীতে ব্যাক করা। কয়েকদিন পর এক মঙ্গলবার মনা ফোন দিল তার পেশাগত কাজে তাকে পিরোজপুর যেতে হবে; তাই দুদিন আগে রওনা দিলে আমরা কুয়াকাটা ঘুরে আসতে পারি। সেই কথা মোতাবেক ঠিক তার একদিন পর; বৃহস্পতিবার রাতে ব্যাগ গুছিয়ে মনা’র সাথে রওনা দিলাম ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে; উদ্দেশ্য বরিশালের লঞ্চে করে বরিশাল যাওয়া এবং সেখান হতে বাসে করে কুয়াকাটা। এরমধ্যে মনা জানালো তার এক কলিগও যুক্ত হচ্ছে আমাদের সাথে; কুয়াকাটা ভ্রমণ শেষে তারা চলে যাবে পিরোজপুর আর আমি ফিরে আসবো ঢাকা।
যাত্রা হল শুরু
প্ল্যান ছিল আমরা সন্ধ্যার পরপর ছয়টা নাগাদ রওনা হয়ে যাবো সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। আগে থেকে কোন কেবিন বুক না করায় খোঁজাখুঁজি করেও কোন ক্যাবিন ম্যানেজ করা গেল না। দক্ষিণবঙ্গের লঞ্চ জার্নির পূর্বের অভিজ্ঞতায় অতিরিক্ত মানুষের ভিড় এর কথা চিন্তা করে আমি কিছুটা চিন্তিত ছিলাম; কারণ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। আমি তৈরী হয়ে অপেক্ষায় থাকলাম, কিন্তু পারিবারিক ব্যস্ততায় মনা সাতটা নাগাদ পৌঁছলে পরে আমরা সদরঘাট যাত্রা করে সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছলাম সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। প্রবেশ পথের মুখেই “পারাবাত ১০” লঞ্চটি দেখে উঠে পড়লাম খোঁজখবর করতে। উঠেই পেয়ে গেলাম একটা স্টাফ কেবিন, তেমন যুতসই না হলেও রাত কাটানোর জন্য চলে; এর সাথে সঙ্গে থাকা ক্যামেরা, মোবাইল, মানিব্যাগ ইত্যাদির সুরক্ষারও একটা ব্যবস্থা হল। কেবিন এ ব্যাগ রেখে আমি আর মনা লঞ্চের দোতলার সম্মুখে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমাদের দলের অপরজনা’র জন্য। আধঘন্টা পরে উনিও চলে এলেন; তারও পরে রাত নয়টা নাগাদ লঞ্চ ছেড়ে দিল বরিশাল এর উদ্দেশ্যে। আমি কেবিন এর ছোট্ট কুঠুরিতে ঢুকে পড়লাম; আর আমার অন্য দুই সাথী লঞ্চে ঘোরাঘুরি করে একসময় ফিরে এলে দশটা নাগাদ লঞ্চের হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে রইলাম।
হয়তো দুই তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি; ভোর রাত চারটার দিকে মনা ডেকে তুললো বরিশাল লঞ্চঘাট চলে এসেছি। তখনো আকাশ অন্ধকার। আমাদের প্ল্যান ছিল লঞ্চঘাট হতে বরিশাল রূপাতলি বাসস্ট্যান্ড গিয়ে সেখান হতে কুয়াকাটার বাস ধরা। কিন্তু টার্মিনাল হতে বের হতেই দেখি নানান গন্তব্যের নানান বাস সেখানে দাঁড়িয়ে আছে; খোঁজ করে কুয়াকাটাগামী একটা বাসে উঠে পড়লাম আমরা তিনজন। লোকাল ইন্টারসিটি টাইপ বাস, ভাড়া নিল জনপ্রতি ২২০ টাকা করে। বরিশাল এর প্রায় সব লঞ্চ রাত নয়টার মধ্যেই ছেড়ে যায়। অথচ এই লঞ্চগুলো আরো পরে রওনা দিলেও পারে। কেননা শেষ রাতে বরিশাল পৌঁছে অনেককেই লঞ্চঘাটে ভোরের আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অথচ রাত দশটা/এগারোটা নাগাদ ঢাকার সদরঘাট হতে রওনা দিলে সকাল ছয়টা’র পরে বরিশাল পৌঁছে সবাই অনায়াসে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারে।
কুয়াকাটায় ফেলিলাম পা
প্রায় ঘণ্টাখানেক বাসে বসে থাকার পর ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে আমাদের বাসখানি রওনা হল কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। সারাটা পথ যাত্রী উঠানো নামানো করতে করতে সকাল সোয়া আটটা নাগাদ আমরা চলে এলাম কুয়াকাটা বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। বাসের কন্ডাক্টর খুব ভাব নিয়ে আমার অপর পাশের এক যাত্রী দম্পতি’কে বলল, “দেখছেন, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আগে চলে এসেছি”। পরে জেনেছি এই যাত্রাপথের নির্ধারিত সময় তিনঘন্টা। অবশ্য ফেরার সময় আমার অন্য সাথীদুজন যে বাসে উঠেছিল, তা চারঘন্টায় এই পথ পাড়ি দিয়েছিলো তার সুপার লোকাল সার্ভিস এর কল্যাণে। যাই হোক, আমরা কুয়াকাটা পৌঁছেই বাস যেখানে থেমে ছিল তার অপর পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুঁকে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সকালের নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা শেষে এককাপ কফি অনেকটা চাঙ্গা করে তুললে এবার একটা যুতসই হোটেল খোঁজ করার পালা। একেবারে সৈকতের ধারে হাতের ডান পাশে কিছুটা এগিয়ে দুটো হোটেল দেখে এগিয়ে গেলাম। খুবই সাধারণ মানের একটা হোটেলে একরাতের জন্য ডেরা ফেললাম; ভবিষ্যতে আমি এই হোটেল এ কোনমতেই থাকতে রাজী হবো না। সেদিন এক রাতের কথা ভেবে রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। হোটেলে ঢুকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমি আর মনা বের হয়ে পড়লাম সৈকত ধরে আশপাশটা ঘোরাঘুরি করে দেখার জন্য।
চারপাশে চোখ বুলানো
কুয়াকাটা সৈকতটি দুইদিকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ; এক প্রান্ত গিয়ে শেষ হয়েছে ফাতরার বন এর বিপরীত পাশে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একেবারে তিন নদীর মোহনায়। ফাতরার বন মূলত সুন্দরবনের অংশ; কেউ চাইলেই ইঞ্জিন বোট ভাড়া করে ফাতরার বন ঘুরে আসতে পারে; এক ঢিলে দুই পাখী মারা হবে। কুয়াকাটার সাথে বোনাস সুন্দরবন ভ্রমণ! আমি মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই সুন্দরবন ভ্রমণ করে এসেছি বিধায় আমার কুয়াকাটা ভ্রমণ পরিকল্পনায় ফাতরার বন যুক্ত ছিল না। কুয়াকাটা সৈকত ধরে এই প্রায় আঠারো কিলোমিটার টানা সৈকত এলাকায় ভ্রমণ এর জন শতশত মোটরবাইকে রয়েছে। তাদের কাছে সারাদিনের প্যাকেজ এর সাথে সকাল বা বিকাল এর আংশিক প্যাকেজ রয়েছে। মূলত কুয়াকাটায় দ্রষ্টব্যর মধ্যে রয়েছে গঙ্গামতির চর, কাউয়ার চর, লাল কাঁকড়ার চর, রাখাইন পল্লী, কুয়াকাটার কুয়া, বৌদ্ধ মন্দির, বৌদ্ধ বিহার, ২০০ বছরের পুরাতন নৌকা, লেম্বুর চর, তিন নদীর মোহনা, ফাতরার বন, ঝাউবন এবং তদসংলগ্ন লাল কাঁকড়ার আস্তানা। এই লাল কাঁকড়ার আস্তানাটি সদ্য স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারা পর্যটকদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে বলে জানা গেল। কেননা, ভোরবেলা গঙ্গামতির চর হতে লাল কাঁকড়ার চর ভ্রমণ করে ফিরতে গেলে জোয়ার ভাটার সময়ের হিসেব রেখে চলতে হয়, কারণ সৈকত ধরে মোটর সাইকেল করে অনেকটা পথ ফিরতে হয়।
আমি আর মনা সৈকত এ নেমে বাম পাশ দিয়ে কিছুটা হেঁটে গিয়ে সৈকত হতে জনপথে উঠে গেলাম। সেখান হতে পথ এর খোঁজ করে চলে এলাম ২০০ বছরের পুরাতন নৌকা দেখতে। এখানে কিছু সময় কাটিয়ে আর ছবি তুলে চলে গেলাম বৌদ্ধ মন্দির। এরপর সেখান হতে প্ল্যান করলাম “পানি জাদুঘর” দেখার। একটা অটো রিকশা ভাড়া করে রওনা দিলাম সেটার উদ্দেশ্যে; কিন্তু গিয়ে দেখি তা বন্ধ। সেখান হতে ফিরে এলাম আমাদের হোটেল এ। এরপর কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে শুক্রবার এর জুম্মা নামাজ পড়তে হোটেলের পেছনের এলাকার জামে মসজিদে গেলাম; সেখানেও প্রচুর ভীড় ছিল। অনেক কষ্টে কিছুটা জায়গা ম্যানেজ করে নামাজ শেষে এবার দুপুরের খাবার এর পালা। আমাদের হোটেলে উল্টো পাশে বাশের চালার বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল ছিল; প্রতিটি হোটেল হতে সারাক্ষণ পর্যটকদের ডাকাডাকি চলছিল। সকাল হতে বেশ কয়েকবার এই পথ অতিক্রম করার ফলে একটি হোটেলে একটা পিচ্চির সাথে বেশ খুনসুটি করেছি কয়েকবার। আমার বাকী দুই সাথীকে বললাম, ঐ হোটেলেই দুপুরের খাবার খাওয়া যাক। পিচ্চির সাথে সেই হোটেলে প্রবেশ করে নানান পদের মাছ হতে নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী খাবার অর্ডার করলেও সবাই শেয়ার করে চেখে দেখলাম প্রতিটি পদই। এরপর হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম এর পালা, রোদ কিছুটা কমে এলে বিকেলে বের হব সৈকত ধরে বেড়াতে…
মন্তব্যসমূহ