সুন্দরবনে, বহুদিন পর ভ্রমণে
প্রায় ত্রিশ মাস হতে চললো, আক্ষরিক অর্থেই কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নাই। ব্যক্তিগত নানান প্রতিকূলতা এবং তার সাথে কোভিড-১৯ এর মহামারী এবং বিধিনিষেধ এর সাথে নিজের অতিরিক্ত সাবধানতা; এই সবকিছুর বেড়াজালে ত্রিশ মাস পর কোথাও বেড়াতে বের হলাম। গত কুরবানী ঈদ এর পরপরই করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় মাসখানেক ভুগতে হয়েছিল; আর সেই সময়টায় একটা ঘরে বন্দী থেকে হুট করেই মনে হল; না এবার কোথাও বেড়াতে যাওয়া দরকার। তখন থেকেই মন চাচ্ছিল কোথাও গিয়ে কয়েকটা দিন প্রশান্তিতে কাটাতে। ২০২০ এর প্রথম লকডাউন এ প্রায় ১২৫ দিন বাসায় থাকা এই আমি, যেন আর তর সইছিলো না। বহু আগের প্রতিনিয়ত ভ্রমণে ভেসে চলা স্বত্বা যেন কড়া নাড়ছিল মনের চোরাপথ দিয়ে। আর তাই তো, ইকোট্রাভেলার্স এর আবু বকর ভাইকে মেসেঞ্জারে নক করলাম। উনারা প্রায় প্রতি সপ্তাহে সুন্দরবন ট্রিপ করাচ্ছেন, আসন্ন যে কোন একটা ট্রিপে আমাকে নিয়ে যাওয়া যায় কি না। একদিন পরই আবু বকর ভাই এর রিপ্লাই পেলাম, দুদিন পর মঙ্গলবার রাতে খুলনা রওনা হতে হবে। পরদিন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিলাম; মনে মনে ভীষণ আপ্লূত ছিলাম; আহা! আবার যাচ্ছি সুন্দরবন!!! এর আগে ২০১২ এর ডিসেম্বর এ ভ্রমণ বাংলাদেশ এর সাথে গিয়েছিলাম সুন্দরবন, সেই ভ্রমণ এর নানান স্মৃতিরা ঝাঁপি মেলে ধরল নিউরনের অলিতে গলিতে। যাই হোক, পরদিন রাত ১০:৩০ এর গাড়ীতে শুক্রাবাদ এর “সেন্টমার্টিন পরিবহন” এর এসি বাস এ করে আমি আর আবু বকর ভাই রওনা হবো খুলনার গাড়ীতে। মঙ্গলবার আমার অফিস ছিল, অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত ০৮:০০টা বেজে গেল। প্রতিবার দেখা যায়, ভ্রমণ এর দিনেই হয়তো অফিসের কোন কাজে ফেঁসে যেতে হবে; নয়তো অফিস থেকে আগে আগে বের হয়ে গেলেও রাস্তায় ভয়াবহ জ্যামে পড়তে হবে। আবার যখন বাসা হতে সকাল বেলাই ব্যাগপত্তর নিয়ে অফিসের জন্য বের হবো; সেদিন কোন বাঁধা আসবে না। যাত্রার প্রায় ঘন্টা দেড় দুই আগে বাস কাউন্টারে পৌঁছে ঝিমাতে হবে। রাত ০৮:০০ টায় বাসায় এসে দ্রুত তৈরী হয়ে রওনা দিলাম শুক্রাবাদ, নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম উবার এর মোটর বাইক সেবার কল্যাণে। আমি পৌঁছানোর বেশ অনেকটা সময় পরে আবু বকর ভাই এসে পৌঁছলেন। একেবারে শেষ মুহুর্তে টিকেট করায় আমাদের সিট পড়েছে একেবারে শেষ সারিতে। আমার যেহেতু খুব বাজে ধরণের ব্যাক পেইন রয়েছে, তাই ভয় পেলাম, যাত্রা হয়তো খুব কষ্টকর হবে। সেন্টমার্টিন হুন্দাই এর বাসটিতে আল্লাহ্র রহমতে আরামেই সারা রাত এর জার্নি শেষ করতে পেরেছিলাম এবং ভোর ছয়টা নাগাদ আমরা পৌঁছে যাই খুলনা শহরে।
নাও ভাসানোর আগের গল্প
ইকো ট্রাভেলার্স এর এই ট্রিপটি মূলত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রায় ৩০ জন এর মত বন্ধুদের একটি পুনর্মিলনী ভ্রমণ যার আয়োজনে ছিল ইকো ট্রাভেলার্স; আমি আয়োজক আবু বকর ভাই’কে সঙ্গ দিতে যুক্ত হয় এই ভ্রমণে। খুলনা পৌঁছে আমরা চলে যাই খুলনা ডাকবাংলো মোড় হয়ে স্টেশন রোড এর হোটেল পার্ক এ সাত সকালে চেকইন করি। আমাকে ছোট্ট দুটি কাজ দিয়ে আবু বকর ভাই যখন বের হয়ে গেলেন একটা কর্পোরেট প্রোগ্রামে হাজির হতে; তখন সকাল সাতটা। ভাবলাম একটা ঘুম দিয়ে নেই। যখন ঘুমটা একটু গভীর হবে; তখনই আবু বকর ভাই এর ফোন। খুলনা হতে বাজারসদাই লোড করে দুপুর বারোটা নাগাদ খুলনা জেলখানা ফেরী ঘাট হতে আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ এর জন্য ভাড়া করা প্রমোদতরী “উৎসব” ছেড়ে যাবে। আমি যেন দুটো ব্যানার প্রিন্ট এর কাজ, খুলনা প্রেসক্লাব এর এলাকা হতে এই সময়ের মধ্যে সেরে নিয়ে জাহাজে উঠে পড়ি। আমাকে নিয়ে রওনা দিয়ে জাহাজ মালপত্র সমেত চলে যাবে মংলা। পরদিন ভোরবেলা আবু বকর ভাই গেস্টদের নিয়ে সেখান থেকে জাহাজে উঠবেন। কথা শেষ করে মোবাইল এর ডায়ালে দেখি সকাল নয়টা বাজে; সারা শরীরে রাতের বাসজার্নি জনিত কিছুটা ক্লান্তির সাথে সদ্য ভাঙ্গা ঘুমের জড়তা নিয়ে দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম। হোটেল হতে বের হয়ে নাস্তা করার হোটেল এর খোঁজ করে চলে এলাম ডাকবাংলা মোড়। সেখানে এসে ঢুঁকে পড়লাম রহমানিয়া হোটেল এ, নেহারী-নান রুটি দিয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে চা’এর পর্ব বাদ রেখে রওনা হলাম খুলনা প্রেসক্লাব এলাকায়। খুলনা শহরে এবারই প্রথম এভাবে ঘোরাঘুরি হচ্ছে। এর আগে সেই ২০১২ এর সুন্দরবন ভ্রমণ এর সময় ট্রেনে করে ঢাকা থেকে এসে রেল স্টেশন হতে হাঁটা দূরত্বে থাকা প্রমোদতরী’তে উঠে পড়েছিলাম; তাই শহর সেভাবে ঘোরা হয় নাই। যাই হোক, প্রেসক্লাব এলাকায় এসে দেখি দোকানপাট সবেমাত্র খুলছে। একটু এগুতেই একটি ব্যানার প্রিন্ট এর দোকান দেখতে পেলাম; মাত্রই খুললো। কাছে গিয়ে খোঁজ করতে জানতে পারলাম, দশটা নাগাদ কর্মচারী’রা এলে প্রিন্ট এর কাজ শুরু হবে। ঘড়িতে তখন সকাল প্রায় সোয়া নয়টা, ভাবলাম হোটেল এ আর ফেরত না গিয়ে এখানেই অপেক্ষা করি। রাস্তার উল্টো পাশের টঙ্গ এর দোকানে চা পাণ করে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরপর দশটার পর দোকানের কার্যক্রম শুরু হলে সবার প্রথমেই আমার কাজটি তারা করে দিলেন। সেটি নিয়ে আমি হোটেলে পৌঁছলাম যখন তখন ঘড়িতে এগারোটার বেশী। সেই দোকানে দেখলাম ব্যানার, ফেস্টুন আর টিশার্ট প্রিন্ট এর হিরিক। আগের দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শহীদ শেখ আবু নাসেরের সহধর্মিনী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচী শেখ রাজিয়া নাসের ইন্তেকাল করেছেন। উনার প্রয়াণে শোক জানিয়ে নানান রাজনৈতিক ব্যানারে বিভিন্ন ছাপাখানা কাজের ভীড় ঐ দোকান এবং তার আশেপাশের এলাকায়।
হোটেলে পৌঁছে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে সবকিছু নিয়ে হোটেলের কাউন্টারে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আমি ফেরীঘাটে এসে দেখি আশেপাশে “উৎসব” জাহাজের কোন নামগন্ধ নেই। আমি পৌঁছানোর পর একটি ফেরী ছেড়ে গেল। আমি আবু বকর ভাই’কে ফোন দিয়ে দেখি কল যাচ্ছে না, এদিকে শিপের কন্টাক্ট পারসন কে ফোন দিচ্ছি, সেও ধরছে না। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম, প্রায় আধঘন্টার মত সময় পার হলে শিপের কন্টাক্ট পারসন ফোন ধরলো, জানালো শিপ আছে ফেরী ঘাট হতে উল্টো দিকের খাড়ির দিকে। ঘাট থেকে একটা ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যেন সেখানে চলে আসি। আমি এই আধঘন্টা ধরে দেখছিলাম, ফেরীর জেটির ডানপাশে কয়েকটা ইঞ্জিন নৌকা রয়েছে; সেখানে একটা নৌকায় অনেকগুলো খাবার পানির জার তোলা হচ্ছিলো। নৌকাগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে আমি “উৎসব” জাহাজে যাবো, তারা কেউ নিয়ে যাবে কি না জিজ্ঞাসা করতেই নৌকার লোক আমাকে সেই পানি তুলতে থাকা নৌকা দেখিয়ে বলল, সেটি উৎসব এর নিজস্ব বোট। এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে তারা আমাকে তাদের শিপ এ তুলে নিল।
নাও এ ফেলিলাম পা
দুপুর একটা নাগাদ আমি “উৎসব” এ পা রাখলাম। আজসহ আগামী তিনদিন এর আবাস এই জাহাজখানি। এগুলোকে জাহাজ বলা যায় কি না, আমি সন্দিহান। আবার লঞ্চ বলতেও কেমন লাগে। তাই আমি পুরো লেখায় এটিকে প্রমোদতরী বলেই না হয় সম্বোধন করি। তো আমাদের প্রমোদতরী উৎসব এ গেস্ট হিসেবে আজ আমি একা; আমি ছাড়া জনা দশেক কর্মচারী রয়েছে প্রমোদতরীর; চালনা, রান্নাবান্না, ক্লিনিং, রেস্টুরেন্ট এ পরিবেশন সহ নানান কাজের জন্য। আর হ্যাঁ, এই দলে রয়েছে এই প্রমোদতরী’র সুপারভাইজার হিসেবে বছর ত্রিশের একটা ছেলে। সে আমাকে একটা সিঙ্গেল রুম দিলে আমি সেখানে গিয়ে আমার ব্যাগপত্তর রেখে ফ্রেশ হয়ে প্রথমেই শিপটা একটা চক্কর দিয়ে ঘুরে দেখলাম, মন্দ না। ত্রিতল শিপের নীচতলা আর দোতলা মিলে রুম রয়েছে ১৮ টি; এর মধ্যে প্রায় ৪০ জন অতিথি থাকতে পারবে। আর তৃতীয় তলায় রেস্টুরেন্ট তথা ডাইনিং স্পেস। রুমগুলোর মধ্যে ১০টি’তে রয়েছে এটাচড বাথরুম এর সুবিধা; এর বাইরে কমন বাথরুম ৪টি রয়েছে নীচতলায়, প্রবেশমুখে। এই শিপটি’র যে জিনিষটি আমার খুব চোখে লেগেছে, শিপে প্রবেশ এর মুখেই ৪টি বাথরুম, এরপর কিচেন, তার পাশে স্টাফদের থাকার জায়গা; এখানকার পরিবেশটা দৃষ্টিকটু। চাইলেই সরাসরি দোতলায় উঠার সিঁড়ি তৈরী করে গেস্টদের উপরে সুন্দর করিডোর দিয়ে প্রমোদতরীতে প্রবেশ করাতে পারতো। হাজার হলেও, “ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন”। দুপুর দুইটার পর তিনতলার ডাইনিং এ আমি লাঞ্চ করলাম; মেনু প্রমোদতরী’র স্টাফদের জন্য রান্না হওয়া ভাত, সবজি, মাছের তরকারী আর ডাল। পুরো শূন্য ডাইনিং এ রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশে একা একা লাঞ্চ করতে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। প্রমোদতরী’র ইঞ্জিন বন্ধ থাকায় নিঃশব্দ পরিবেশের যে একটা আলাদা কোমলতা মন মস্তিস্ককে ছুঁয়ে যাচ্ছিল; তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম। দুপুরের খাবারের পর জানতে পারলাম এখন প্রমোদতরী ছাড়ছে না; সময়মত সকল বাজার সদাই লোড না হওয়ায় জোয়ারের সময় পেড়িয়ে যাবে; তাই রাত দশটা নাগাদ আমরা রওনা হব মংলার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম, আজ ফাঁকা প্রমোদতরী’তে সূর্যাস্তর নানান রূপ উপভোগ করার সাথে কিছু ফটোগ্রাফি করার সুযোগ হবে, তা আর হল না। নতুন ক্যামেরা কেনার পর হাতে গোনা চার পাঁচটা ট্যুর দিয়েছি। তাই ছবি তোলা শেখা বা অনুশীলন এর তেমন সুযোগ হয় নাই। ভেবেছিলাম, আজকের দিনটা খুব কাজে লাগাবো। তা আর হল কই?
সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত তৃতীয় তলার উন্মুক্ত করিডোর এ বসে রইলাম কানে হেড ফোন গুঁজে দিয়ে। সূর্যডোবার পর চলে এলাম আমার কেবিন এ। কিচ্ছু করার নাই, মোবাইল এর ডাটা ইউজ করে ইউটিউবে একটা সস্তা দরের কোন মুভি দেখে সময় কাটাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। কি আর করা… রাত নয়টার সময় রাতের খাবার এর জন্য দরজা নক করলে বললাম, উপরে তৃতীয়তলায় খাবার দিতে। রাতের খাবার শেষ করে অনেকটা সময় বসে রইলাম উপরে। রাসপূর্নিমা’র পূর্ণ তিথি এখনো প্রকাশ পায় নাই, আজ ১৬ নভেম্বর, ২০২১; দুইদিন পর পূর্নিমা তিথি। তারপরও প্রায় পূর্ণ চাঁদ এর আলোয় থেমে থাকা প্রমোদতরী’তে একা বসে থাকতে মন্দ লাগছিলো না। রাত দশটা নাগাদ নিজের কেবিন এ গিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করলাম। আগামীকাল সাত সকালে আবু বকর ভাই তার গেস্টদের নিয়ে হাজির হবেন। তার আগে আমাকে ঘুম থেকে উঠে তৈরী হয়ে নিতে হবে। গত রাতের বকেয়া ঘুম এর কল্যাণে অল্প কিছু সময় পর তলিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ