কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা পর্যটকদের নিকট অতি অবশ্য দর্শনীয় একটি স্থাপনা হল কুয়াকাটার শতবর্ষী নৌকা। কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দির এর নিকটেই প্রতিস্থাপিত রয়েছে এই নৌকাটি একটি ছাউনি দেয়া চার দেয়ালের মাঝে। কুয়াকাটার এই
শতবর্ষী পুরাতন নৌকার কাহিনীটি খুব চমকপ্রদ। ২০১২ সালের দিকে কুয়াকাটা সৈকতের মূল পয়েন্ট
হতে পূর্বদিকে তিন কিলোমিটার দূরে সর্বশেষ এই নৌকার একটি অংশ সৈকতের বালির নীচ থেকে
জোয়ারে বালি সরে গেলে বেড়িয়ে আসে। স্থানীয় জেলেদের কাছ হতে স্থানীয় সাংবাদিক হয়ে খবর
পৌঁছায় প্রশাসনের নিকট। ধারণা করা হয়, নৌকাটির বয়স ২০০ বছরের অধিক। স্থানীয় রাখাইন
সম্প্রদায়ের দাবী, তাদের পূর্বপুরুষেরা এই নৌকাযোগে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের আরাকান
রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কুয়াকাটা এসেছিল এই নৌকাযোগে। যদিও এই মত
নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
স্থানীয় প্রবীন অধিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এর আগে আশির
দশকে এই নৌকাটি সৈকতের একই স্থানে বালির উপর জেগে ছিল। নৌকার দৃশ্যমান বেশকিছু অংশ
পিতলের পাতে ঢাকা ছিল নানান নকশায়; অনেকেই স্বর্ণের পাত ভেবে সেগুলো খুলে নিয়ে যায়।
তখন মানুষের মুখে মুখে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সোনার নৌকা জেগে উঠেছে কুয়াকাটার সৈকতে। তখন
নৌকাটিকে দেখতে উপচে পড়া ভীড় দেখা যেত কুয়াকাটায়। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ভয়াল
ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ফের সৈকতের বালির নীচে হারিয়ে যায় সেই নৌকাটি। ধীরে ধীরে
সবাই ভুলে যায় সেই ‘সোনার নৌকা’র কথা। এরপর প্রায় দেড় দশক কেটে যায়, ২০০৭ সালে ঘুর্নিঝড়
সিডরের সময় ফের সৈকতের বালি সরে গিয়ে আবার দৃশ্যমান হয় এই রহস্যজনক নৌকাটি। তখন থেকে
২০১২ সাল পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন, পর্যটক এবং স্থানীয় সংবাদকর্মীদের নানান প্রতিবেদন
এর কল্যাণে এক সময় এই নৌকাটি নজরে আসে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। তাদের যাচাই বাছাই
শেষে তারা এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি
একটা রেললাইনের স্লিপায় বানিয়ে সেই নৌকাটিকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তিন কিলোমিটার দূরের
সৈকতের মূল পয়েন্টের সন্নিকটবর্তী বৌদ্ধবিহার এর পার্শ্ববর্তী একটা জায়গায় এবং সেখানে
একে প্রতিস্থাপন করা হয়।
বর্তমানে নৌকাটি চারিদিকে প্রাচীর দেয়াল এবং উপরে ধাতব ছাউনি
দিয়ে সংরক্ষণ করা আছে। এই নৌকাটি সংরক্ষণে পটুয়াখালী জেলা পরিষদ, কলাপাড়া
উপজেলা ও পটুয়াখালী জেলা
প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বন বিভাগ, ফায়ার
সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড,
শিপইয়ার্ড, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এর অবদান রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব
বিভাগ হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে ৯০ টন
ওজনের এই নৌকাটি ৭২ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৪ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট। তাদের
তথ্য অনুযায়ী ছেনি বা কুঠার দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল এই কাঠের নৌকাট; যেখানে ব্যবহার করা
হয়েছিল গর্জন অথবা শালকাঠ। পুরো একটা গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী হয়েছিল নৌকার বাহা, গছা ও
গুড়ার কাজ। কিন্তু বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম এর রয়েছে ভিন্নমত; তাদের
রসায়নাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল মতে নৌকাটি জাম্বুল কাঠের তৈরী। এই নৌকাটি
ছিল পাল তোলা নৌকা, নৌকাটিতে পাতাম বা গজাল লোহার ব্যবহার না করে ব্যবহার করা হয়েছিল
লোহার রড-বোল্ট। আর বাইরের অংশের শোভা বাড়াতে মোড়ানো হয় পিতল ও তামার পাত। নৌকা
বিশেষজ্ঞ ফরাসি নাগরিক ইভাস মারের মতে,
এটি সমুদ্রগামী ছোট্ট পাল তোলা জাহাজ
(schooner)। এই নৌকা থেকে উদ্ধার
করা জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছেঃ তামার তৈরি
পেরেক, নারিকেলের মালাই, নারিকেলের ছোবলা দিয়ে বানানো রশি,
ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরো, প্রচুর ধানের বহিরাবরণ/চিটা, পাটকাঠি, মাদুরের অবশেষ, পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন,
লোহার ভারি ও বিশালাকৃতির
শিকল। যার মধ্যে বেশ
কিছু নিদর্শন বর্তমানে বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত রয়েছে।
মন্তব্যসমূহ