ট্যুরিজম – শৌখিনতা বনাম পেশাদারিত্ব শিল্প
বেশী দিন আগের কথা নয়, যখন কারো CV বা Biodata ‘তে ভ্রমণ লেখা থাকতো শখের তালিকায়। ভ্রমণ বা ট্যুরিজম কারো পেশা হতে পারে এই কল্পনা আমাদের দেশে এক যুগ আগেও কেউ চিন্তা করতো না। কিন্তু সারা বিশ্ব অর্থনীতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিগত কয়েক দশক ধরেই ট্যুরিজম একটি বিকাশমান ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। আমাদের দেশে যদিও ট্যুরিজম এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখনো আমাদের দেশের ভ্রমণকারীর কাছে ভ্রমণ মানে বাইরে বেড়াতে যাওয়া আর যারা নিয়মিত ভ্রমণকারী তাদের কাছে ভ্রমণ হল একটি এডভেঞ্চার এক্টিভিটিস অথবা এক্সট্রিম ইন্টারটেইনমেন্ট; যার অনেকাংশই আটকে আছে কম খরচে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর কার্যক্রমের মাঝেই। এই বোকা মানুষেরও বেশ কিছু লেখা আছে এই ব্লগেই “কম খরচে ভারত ভ্রমণ” শীর্ষক। কিন্তু কথা হচ্ছে ভ্রমণ যে ক্রমবিকাশমান একটি ইন্ডাস্ট্রি, তা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? আর পারলে এই ইন্ডাস্ট্রি দেশের জিডিপি’তে কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারে, রাখতে পারে কর্মসংস্থান পূরণে তা কি আমরা সাধারণ জনগণ তো পরের কথা, নীতিনির্ধারকবৃন্দ কি সেই গভীরতায় ভেবে দেখেছেন?
আচ্ছা ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কারণটুকু ব্যাখ্যা করা যাক আগে। গত তিন দিন আগে, আমার ইমেইলে ব্রাক ব্যাংক এর ক্রেডিট কার্ড ডিপার্ট্মেন্ট থেকে একটি মেইল আসে (আমি তাদের বহুদিনের পুরানো ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহারকারী বলেই হয়ত। তো সেই মেইল পেয়ে আমি কিছুটা অবাক। কারন বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কেটিং করছে ইন্ডিয়ান অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট MakeMyTrip এর! তাদের মেসেজ ছিল এরকমঃ "Exciting Discounts at MakeMyTrip"...!!! যেখানে মূল অফারটি ছিল বিডি ভিসা ডট কম হতে। মোদ্দাকথা, আপনি বাংলাদেশ থেকে অনলাইনে ব্রাক ব্যাংক এর কার্ড দিয়ে MMT হতে Flight, Hotel বা Package ক্রয় করলে নানান অংকে এবং পার্সেন্টেজে ডিসকাউন্ট পাবেন। কিন্তু কথা হল, এর মাধ্যমে আমাদের ট্যুরিজম সেক্টর কি কোন লাভবান হচ্ছে? যতদূর জানা যায়, MakeMyTrip অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করতে। ইতোমধ্যে ভারতীয় প্রাইভেট বিমান সংস্থা IndiGo এবং SpiceJet বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল। আর এইসবের পেছনে কারনটি অনেক বড়। আপনি হয়ত জেনে অবাক হবেন ভারতে ২০১৮ সালের মোট জিডিপি’র ৯.২% এসেছিল ট্যুরিজম খাত থেকে টাকার অংকে যা ২৪০ বিলিয়ন ইউএসডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২,০৩,০৫,২৫,০৪,০০,০০০ ( বিশ লক্ষ ত্রিশ হাজার পাঁচশত পঁচিশ কোটি) টাকা। কি অবাক হচ্ছেন? জানেন তো ২০১৮-২০১৯ সালে আমাদের বাংলাদেশের মোট বাজেট ছিল ৫৫.৩৩ বিলিয়ন ইউএসডলার! ট্যুরিজম সেক্টর ভারতে প্রায় সোয়া চারকোটি লোকের কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করেছে যা মোট কর্মসংস্থান এর ৮.১০%। কিন্তু এত কিছুর পরেও কিন্তু ভারত ট্যুরিজম খাত এর আয়ের দিক থেকে থাইল্যান্ড, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ থেকে অনেক পেছনেই আছে। ও ভাল কথা, ভারতের এই ট্যুরিজম খাত থেকে আয়ের প্রায় এক পঞ্চমাংশের বেশী কিন্তু বাংলাদেশী ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে এসেছে।
তথ্যসূত্রঃ Tourism in India
এখন আসি আমাদের বাংলাদেশের অবস্থানের কথায়। “Travel & Tourism Competitiveness Index 2019” পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিশ্ব পর্যটন এ আমাদের অবস্থান ১২০ তম। কিন্তু এই অবস্থানেরও আরো নীচের দিকেই আমাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতি প্রদত্ত সুবিধার কল্যাণে আমরা কিছুটা এগিয়েছি। “Total Number of Known Species” এ আমাদের অবস্থান ৪৯তম এবং “Oral & Intangible Cultural Heritage” এ রয়েছি ৪৩তম তে। এছাড়া কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে “Safety & Security” তে যেখানে ১২৩ তম থেকে ১০৫ এ উন্নিত হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে আমি নিজে কিছুটা সন্দিহান। কেননা ভ্রমণে গিয়ে এখনো আগের চাইতে ভাল একটা নিরাপদ বোধ করিনা অভ্যন্তরীণ ট্যুরগুলোতে। যাই হোক, এছাড়াও Govt. commitment to the T&T Inustry, Country Brand Strategy Rating, Prioritization of T&T, ICT Readiness, Overall infrastructure প্রভৃতি খাতে দু’চার ধাপ করে এগিয়েছে আমাদের দেশ ট্যুরিজম এর আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে। কিন্তু পিছিয়েছি আসল কিছু জায়গাতেঃ International Openness, Visa Requirements, Tourist Service Infrastructure, Construction Permits এর মত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে।
তথ্যসূত্রঃ World Economic Forum
শেষ করতে চাই, কিছু আশা নিয়ে। আমাদের দেশে তরুন সমাজের মাঝে ট্যুরিজম যে ক্রেজ নিয়ে এসেছে, তা যদি নীতি নির্ধারকেরা পজেটিভলি কাজে লাগাতে পারে; তাহলে আমাদের ট্যুরিজম গ্রোথগ্রাফ উপরিমূখী থাকবে এটাই আশা করা যায়। আমাদের দেশের প্রয়োজন আমাদের যে ন্যাচারাল রিসোর্স আছে তা নান্দনিকভাবে উপস্থাপন এর পাশাপাশি হসপিটালিটি’তে আরও বেশী পিপিপি ইনভেস্টমেন্ট, আরও বেশী প্ল্যানিং এন্ড প্রোকিউরমেন্ট এবং সোশ্যাল সেফটি ও সিকিউরিটি নিশ্চিত করন। এর সাথে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট এ কন্টিনিউয়িটি মাস্ট থাকতে হবে। ২০১৬-২০১৮ সরকার ঘোষিত “পর্যটন বর্ষ” হতে আমাদের প্রাপ্তি কি? সেই রিপোর্ট আজও জানা হল না। হয়ত কোথাও কিছু পাবলিশড হয়েছিল; আমার নজরে পড়েনি; আমি কিন্তু অনলাইন এন্ড অফলাইনে খুঁজেছি প্রচুর। কেউ কোন রেফারেন্স পেয়ে থাকলে আমাকে মন্তব্যে লিংক দিলে উপকৃত হব। পর্যটন বর্ষ নিয়ে সেই সময়ে আমার দুটি লেখা ছিল, দেখতে পারেনঃ
শুভ পর্যটন বর্ষ ২০১৬। - কিছু বাস্তবতা এবং ভাবনা-প্রস্তাবনা।
এই বিষয়ক আরেকটি লেখা, প্রায় উপরের লেখার দুই বছরে আগে লেখাঃ
বাংলাদেশের পর্যটন আর বোকা মানুষের টেনশন!!!
অনেকেই যারা ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করছেন, অনলাইনে কিংবা অফলাইনে, সবাইকে বলবো পেশাদারিত্ব’র সাথে বৃহৎ শিল্প অঙ্গনের ধারনা নিয়ে এই সেক্টরে কাজ করলে সুফল আসবে। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। দেশের বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানিজদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশে সরকারী-বেসরকারী অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি হতে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে, ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে স্বয়ং পর্যটন কর্পোরেশন এর উদ্যোগে। এই জনবল এবং তারুণ্যের আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে ট্যুরিজম নিয়ে যে শৌখিনতার ক্রেজ রয়েছে তাকে শখের মোড়ক থেকে বের করে প্রফেশনাল রূপ দিতে সরকার এবং প্রাইভেট সেক্টর উভয়কে আরও বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। বিলিয়ন ডলারের এই মার্কেটে নিজেদের স্থান পোক্ত করতে হলে দরকার প্রফেশনাল প্ল্যানিং। তাই শুধু ট্রাভেল রিলেটেড পার্সোনেল দিয়ে এই সেক্টর নিয়ে ভাবলে হবে না; অন্তর্ভুক্ত করতে হবে নানান শ্রেনীর পেশাদারী এক্সপার্টদের। আশা করি তবেই আমাদের দেশের জিডিপি’তে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে ট্যুরিজম সেক্টর।
সবশেষে বলবো, Happy & Sustainable T&T with professionalism as profession to contribute in growth of country's GDP।
মন্তব্যসমূহ