কলকাতা-বেঙ্গালুর-মাইসুর মাত্র ২১,০০০ টাকায়!!! (কম খরচে ঘোরাঘুরি - পর্ব ১০)





কলকাতা-বেঙ্গালুর-মাইসুর মাত্র ২১,০০০ টাকায় ঘুরে আসুন একা একা। গ্রুপ হলে ১৮,০০০ টাকায়!!! আর... কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গ্রুপে ১৫,০০০ টাকায়!!!

দক্ষিন ভারতের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্র কর্ণাটক এর রাজধানী বেঙ্গালুরু এবং ভারতের ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত শহর মাইসুর। এই দুটি শহর অতি সহজে এবং কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন একা একাই। চাইলে গ্রুপ করে ঘুরতে পারেন, এতে আনন্দ বাড়বে, কমবে হ্যাপা এবং খরচ। দরকার পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত এবং একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা। প্রায়শই কম খরচে ঘোরাঘুরি’র ব্লগ পোস্ট, ফেসবুক নোট, নিউজ ফিচার এগুলো বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম কারণ নিজে না ভ্রমণ করে, নানান জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, বাস্তব সম্মত চিন্তা ছাড়া শিডিউল এবং খরচ নির্ধারন করা। আমার আগের প্রতিটি নোটের মতই আমার এই নোটটিও নিজের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এবং সংগৃহীত তথ্যের আলোকেই লেখা। আশা করি সকলের কাজে লাগবে। 

ঢাকা টু কলকাতাঃ বাংলাদেশ থেকে অতি অল্প খরচে কল্যকাতা যাওয়ার রুট হলঃ ঢাকা থেকে যশোহর হয়ে বেনাপল; ভাড়া ছয়শত টাকা’র মধ্যে হয়ে যাবে। এরপর ইমিগ্রেশন শেষে বর্ডার পার হয়ে পেট্রাপল হতে বনগাঁ হয়ে হাওড়া। খরচ একশত টাকার মত, আর বাসে করে কলকাতা গেলে খরচ ২০০-৩০০ টাকা। তো সবমিলিয়ে সাতশত থেকে হাজার টাকায় কলকাতা। যাওয়া আসা দুই হাজার। এছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতার বাস আছে ১৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে। আর বাই এয়ার গেলে রিটার্ন টিকেট ৮০০০-১২,০০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে ঢাকা টু কলকাতা রুটের জন্য।

কলকাতা টু বেঙ্গালুরুঃ কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুগামী বেশকিছু ট্রেন রয়েছে, যা এই দুই শহরের মধ্যবর্তী ১৯৪৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ২৮ থেকে ৩৮ ঘন্টা। ভাড়া বিভিন্ন ক্লাসভেদে ৮০০ রুপী থেকে ৭০০০ রুপী’র মধ্যে। তবে, এই রুটে সবচেয়ে বেটার অপশন হাওড়া যশবন্তপুর দুরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি। কলকাতা থেকে যাওয়ার সময় “Howrah-Yesvantpur Duronto Express, Train No.: 12245”; সোম এবং বৃহস্পতি’বার ব্যতীত বাকী পাঁচদিন চলাচল করে এই ট্রেনটি। হাওড়া থেকে ছেড়ে যায় বেলা ১১টা নাগাদ আর বেঙ্গালুরু গিয়ে পৌঁছে পরদিন বিকেল ৪টা নাগাদ। আর বেঙ্গালুরু থেকে ফেরার সময় “Yesvantpur Jn To Howrah Jn Duronto Express – 12246”; বুধ এবং শনি’বার ব্যতীত পাঁচদিন চলাচল করে এই ট্রেনটি। বেঙ্গালুরু থেকে ছেড়ে যায় বেলা ১১টা নাগাদ আর হাওড়া গিয়ে পৌঁছে পরদিন বিকেল ৪টা নাগাদ। ভাড়া প্রথম শ্রেনী ৬০০০ রুপী, দ্বিতীয় শ্রেনী ৩৮০০ রুপী, তৃতীয় শ্রেনী ২৭০০ রুপী এবং স্লিপার ক্লাস ১২০০ রুপী (কিছু কমবেশি হতে পারে)।

নীচে তুলে ধরা হল এই রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর শিডিউলঃ

কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরুগামী ট্রেন এর শিডিউল:


বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতাগামী ট্রেনের শিডিউল

এছাড়া কলকাতা-বেঙ্গালুরু রুটে প্রতিদিন প্রায় পনেরটিরও বেশী সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইস জেট এবং জেট এয়ারওয়েজ বিমান কোম্পানিগুলো। ভাড়া আগে থেকে করে রাখলে ৩,০০০ থেকে ৩,৫০০ রুপির মধ্যে পড়বে ওয়ান ওয়ে জার্নি’র জন্য। রিটার্ন টিকেট পড়বে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার রুপীর মধ্যে। বাসে যেতে চাইলে সবচেয়ে বেটার অপশন হল কলকাতা-ভুবনেশ্বর/পুরী, ভুবনেশ্বর-হায়দ্রাবাদ, হায়দ্রাবাদ-বেঙ্গালুরু। তবে এতে সময় থাকতে হবে বেশী এবং ট্যুর প্ল্যানে ভুবনেশ্বর-পুরী-হায়দ্রাবাদ ইনক্লুড থাকতে হবে। লম্বা ভ্রমণ প্ল্যান হলে বাস ইউজ করা যুক্তিযুক্ত হবে। যেহেতু এই প্ল্যানটা হল বেঙ্গালুরু-মাইসুর এর, তাই বাস রুট এভয়ড করে যাওয়াই উত্তম।

থাকাঃ বেঙ্গালুরু পৌঁছে থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল হয় মাজিস্টিক বাস স্ট্যান্ড এলাকা। এখানে ৫০০ রুপী থেকে ৫,০০০ রুপী’র মধ্যে নানান মানের হোটেল রয়েছে। হোটেল বুকিং সাইটগুলো হতে রুম বুক করে নিতে পারেন যাওয়ার আগেই। উটিতে থাকার জন্য বেস্ট উটি লেক এলাকা; এখানে ৮০০-১,০০০ রুপীতে মোটামুটি মানের ভালো রুম পাওয়া যাবে আগে থেকে বুকিং করে গেলে। আর মাইসুরে রাত কাটাতে হলে মাইসুর বাস স্ট্যান্ড এলাকায় হোটেলে থাকা বেটার। 

খাওয়াঃ এই এলাকায় খাওয়া সস্তায় মিলে যাবে আপনার। মাজিস্টিক হোটেল এর খাওয়া খুবই ভাল, এছাড়াও একই জায়গায় বেশ কিছু ভেজ/ননভেজ খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। ১০০-২৫০ রুপী’র মধ্যে প্রতিবেলার খাবার হয়ে যাবে। মাটন/চিকেন বিরিয়ানি থেকে শুরু করে নর্থ/সাউথ থালি সবই মিলবে। মাইসুরে হোটেল যেখানে নিবেন সেখানেই খাবার হোটেল পেয়ে যাবেন, উটতে হোটেলের লাগোয়া খাবার রেস্টুরেন্ট থাকলে সেখানে খাওয়া যেতে পারে। 

ঘোরাঘুরিঃ বেঙ্গালুরুতে ঘোরাঘুরি’র জন্য নানান প্যাকেজ রয়েছে বিভিন্ন ট্রাভেল কোম্পানীগুলোর। KSTDC, KSRTC & BMTC  সহ বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানীর ডে-লং ট্যুর রয়েছে টুরিস্ট বাস এবং ট্যাক্সি ক্যাব এ। ৪০০ রুপী ভাড়া পড়বে টুরিস্ট বাসে প্রত্যেক সিটের জন্য। সারাদিনের এই ট্যুর শুরু হবে সকাল ০৯:০০টা থেকে, সারাদিন চলে শেষ হবে সন্ধ্যা ০৬:০০টা নাগাদ। দর্শনীয় স্থানে রয়েছেঃ ISKCON temple, Tippu Palace, Gavi Gangadareshwara Temple, Bull Temple, Lalbagh, Museum via Chinnaswamy Stadium, Art Gallery, Cubbon Park।  ব্যাঙ্গালোর হতে মাইসুর ট্রিপের টুরিস্ট বাস আছে, মাইসুর হতেও সারাদিনের নানান প্যাকেজ নিয়ে মাইসুর ডে ট্রিপের টুরিস্ট বাস আছে। 

রাত্রি যাপন করে পরদিন চলে যান সারাদিনের মাইসুর ট্রিপে। ৬৫০-৮৫০ রুপী জনপ্রতি ভাড়া টুরিস্ট বাসে, সারাদিনের মাইসুর ট্রিপে। সকাল সাতটা নাগাদ শুরু হয়ে শেষ হবে বেঙ্গালুরুতে এসে রাত এগারোটা নাগাদ। সারাদিনের এই ট্রিপে দেখা হবেঃ Daria Daulat Bagh, Gumbaz, Fort, Sri. Ranganatha Swamy Temple, St. Philomena's Church, Chamundi Temple, Mysore Palace, Zoological Garden, Illuminated Brindavan Gardens, Mysore & Shopping। 

একটি খসড়া পরিকল্পনা, কম বাজেটে বেঙ্গালুরু-মাইসুর ট্রিপ

 


দিন ০০ঃ ঢাকা থেকে রওনা হয়ে যান কলকাতার উদ্দেশ্যে।

দিন ০১ঃ কলকাতা পৌঁছে সারাদিন কলকাতা ঘোরাঘুরি করুন। রাত কাটিয়ে পরদিন সকালের ট্রেন ধরতে হবে। আর এই একদিন বাঁচাতে চাইলে, ঢাকা থেকে ভোরের বাসে রওনা হয়ে কলকাতা পৌঁছাতে হবে রাতে, রাত থেকে পরদিন দুপুরের ট্রেনে রওনা হতে হবে বেঙ্গালুরু। 

দিন ০২ঃ  বেলা এগারোটার ট্রেনে রওনা হয়ে যান বেঙ্গালুরুর উদ্দেশ্যে। সারাদিন ট্রেন জার্নি।

দিন ০৩ঃ এদিন বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবেন বেঙ্গালুরু। নিজের বাজেটের মধ্যে একটি হোটেল খুঁজে নিয়ে রাস্তার ধারের নানান ট্রাভেল এজেন্সী’র দোকান ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দমত ডে লং ট্রিপ বুক দিয়ে দিন পরের দিন মাইসুর ডে-ট্রিপ এবং তারপর দিন বেঙ্গালুরু ডে-ট্রিপ এর। সন্ধ্যের পর শহর ঘুরে দেখুন, চাইলে কোন সিনেমাও দেখতে পারেন। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুন, খুব সকালে উঠে রওনা হতে হবে মাইসুর ট্রিপের উদ্দেশ্যে। 

দিন ০৪ঃ সারাদিন মাইসুর ডে-ট্রিপ। রাতে ফিরে ঘুমুতে চলে যান। পারলে হোটেলে বলে যাবেন, রাতের খাবারের ব্যবস্থা রাখতে, কেননা এদিন সাইট সিয়িং ট্রিপ শেষ করে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

দিন ০৫ঃ সারাদিন বেঙ্গালুরু ট্রিপ। সন্ধ্যের পর ফ্রি টাইম, শপিং করতে হলে করে নিন। পরদিন সকাল বেলা ট্রেন ধরতে হবে। 

দিন ০৬ঃ বেলা এগারোটার দিকের ট্রেনে করে রওনা হয়ে যান কলকাতা’র উদ্দেশ্যে। সারাদিন ট্রেন জার্নি।

দিন ০৭ঃ বিকেল নাগাদ কলকাতা পৌঁছে হোটেলে চেকইন করুন। সন্ধ্যের পর কলকাতা শহর ঘুরে দেখুন।

দিন ০৮ঃ পরদিন সকালবেলা রওনা হয়ে যান ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাতের মধ্যে ঢাকা পৌঁছে যাবেন। 


খরচের হিসাবঃ

ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা (১৫০০X২) ৩,০০০ টাকা

কলকাতা-বেঙ্গালুরু-কলকাতা (১৫০০X২) ৩,০০০ টাকা

বেঙ্গালুরু এবং মাইসুর ডে ট্রিপ (১০০০+৫০০ রুপী) ২,০০০ টাকা

কলকাতা দুই রাত হোটেল ভাড়া ২,৪০০ টাকা

বেঙ্গালুরু তিন রাত হোটেল ভাড়া ৩,৬০০ টাকা।

খাওয়া খরচ (০৮ দিন, প্রতিবেলা ১৫০ রুপী হিসেবে) ৪,৩৫০ টাকা

ট্রাভেল ট্যাক্স, এন্ট্রি টিকেট এবং অন্যান্য ২,৬৫০ টাকা।

সর্বমোট ২১,০০০ টাকা।

বিঃদ্রঃ কোভিড এর আগে এই নোটটি যখন লিখেছিলাম, তখন সর্বমোট খরচ ১৮,০০০ টাকার কম ছিলো। কোভিড পরবর্তী সময়ে সকল পরিবহণের খরচের বৃদ্ধি এখানে ধরে নেয়া হয়েছে। গ্রুপে গেলে আগের হিসেবে ১৫,০০০ টাকায় এই ট্রিপ করা সম্ভব ছিলো, এখন হয়তো ১৮,০০০ টাকায় হয়ে যাবে। তবে, যেহেতু বাই রোডে ভারত ভ্রমণ প্রায়শই বন্ধ থাকছে, তাই বাই এয়ারে ভারত গেলে এই কম খরচে ঘোরাঘুরি আর কম খরচের থাকবে না। আশা করি ব্যাপারটি মাথায় রেখেই কম খরচে ভারত ভ্রমণের পরিকল্পনা করবেন সবাই।

আনন্দদায়ক হোক ঘোরাঘুরি।

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ