বিউটি বোর্ডিং এ মধ্যাহ্নভোজ
গতকিছু দিন যাবত নিজের জমে থাকা ছোটখাটো কাজ এক এক করে শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এরমধ্যে চলছে দাঁতের খোঁচাখুঁচি পর্ব, আজকেও সকালে শিডিউল ছিলো ডেন্টিস্টের কাছে। গতকাল রাতে চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছিলাম, চশমার পাওয়ার চেঞ্জ হয়েছে। আমি বিগত বিশ বছর যাবত একই দোকান হতে চশমা কিনি এবং পাওয়ার চেঞ্জ হলে গ্লাস চেঞ্জ করি; আর তা পুরাতন ঢাকার পাটুয়াটুলিস্থ পরিচিত একই দোকান হতে। আজ সকালে ডেন্টিস্টের চেম্বার হবে দাঁতের খোঁচাখুঁচি শেষ করে রওনা হলাম পাটুয়াটুলি। সেখানে আরও দুটি ছোটখাটো কাজ ছিলো। পুরাতন ঢাকার নবাবগঞ্জ হতে নয়াবাজার-বাবুবাজার পর্যন্ত এলাকা জুড়ে জায়গায় জায়গায় রাস্তা খুড়ে একাকার করে রেখেছে। ফলে রিকশা নিয়ে এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় যাতায়াতে পড়তে হয় মহা যন্ত্রণায়। আজকে চকবাজার হতে প্রায় পুরোটা পথ হেঁটে হেঁটে গেলাম পাটুয়াটুলি। এরপর চশমার গ্লাস পরিবর্তন করতে দিলাম, বললো ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। এর ফাঁকে অন্য কাজগুলো সমাধা করতে করতে দেখি ঘড়িতে দুপুর দুটোর বেশী, পেটে ছুঁচো ডাকছে। হুট করেই মনে হল বিউটি বোর্ডিং এর এত কাছে এসে অন্যখানে মধ্যাহ্নভোজ করাটা অন্যায়।
যেই ভাবনা, সেই কাজ; মিনিট সাতেক হেঁটে চলে এলাম ১নং শ্রীশদাস লেন, বাংলাবাজার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর কাছ হতে বাংলাবাজার এর গলি ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে একটা চৌরাস্তা মত পড়ে, সেটা পেড়িয়ে সোজা কয়েক কদম এগিয়ে গেলে হাতের বাম দিকের সরু গলিতে ঢুকলেই চোখে পড়বে “বিউটি বোর্ডিং” এর। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বেশ বড়সড় একটা স্টুডেন্ট গ্রুপ বোর্ডিং এর সামনের খোলা উঠোনের নীচে ছাতা পেতে সাজানো টেবিল এর চারিধারে গোল হয়ে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে, তাদের খাবার পর্ব প্রায় শেষ। বিউটি বোর্ডিং এর ভেতরে প্রবেশ করলে একেবারে সামনের দিকে একটা ফাঁকা জায়গা, এখানে কিছু মোটর সাইকেল পার্কিং করা দেখতে পেলাম। তার লাগোয়া অফিসঘর। এই পথ দিয়ে বাঁয়ে রয়েছে একটি দ্বিতল ভবন, তার লাগোয়া মাঝামাঝিতে খাবার এর ডাইনিং। লোক সমাগম বেশী হয় বলে ফাঁকা উঠোনের মাঝে বড় বড় ছাতা পেতে তার নীচে চেয়ার টেবিল দিয়ে আগত অতিথিদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি বাইরে না বসে, ডাইনিং অংশের ঘরটিতে ঢুঁকে গেলাম, ভেতরটা প্রায় ফাঁকা, ঘড়িতে চেয়ে দেখি দুপুর আড়াইটা। আমি দ্বিতল ভবনের নীচে থাকা বেসিনে হাত ধুয়ে এসে বসে পড়লাম একটা ফাঁকা টেবিলে। স্টিলের বড় থালা আর গরম পানির জগ দিয়ে গেলে তা দিয়ে থালা ধুয়ে নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম, ভাত গরম গরম রান্না হচ্ছে, আগের কিস্তির রান্না শেষ।
নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের এই বাড়িটি ভারত ভাগের আগে “সোনার বাংলা“ নামক পত্রিকার অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ১৯৪৯ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা নামের দুই ভাই এই বাড়ি ভাড়া নেন এবং এখানে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। ১১ কাঠা জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বিউটি বোর্ডিং নলিনী মোহনের বড় মেয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। পরবর্তীতে প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারত গমন করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তারক সাহা পরলোক গমন করেন। সেখানে তার স্মৃতিতে দুটো পোস্টার দেখলাম।
> |
বিউটি বোর্ডিং এর জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। অফিস ঘরের পাশে এই গুণীজনদের একটি বিশাল তালিকা দেয়া আছে, এখানে যারা আড্ডার আসরে আসতেন তাদের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেনঃ কবি শামসুর রাহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, গোলাম মুস্তাফা, খালেদ চৌধুরী, সমর দাস, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী প্রমুখ।
প্রায় মিনিট পনেরো বসে থাকার পর গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত চলে আসলো পাতে। সাথে কি খাবো, দেরী করায় মাছের মধ্যে শুধু রুই মাছ আর মাংসে আছে মুরগীর মাংস, দুটোর কোনটাই খাবার ইচ্ছে হলো না। তাই ভর্তা ভাজি আর সবজি খাবো বলে জানালাম, কি কি আছে নিয়ে আসতে বললাম। পাওয়া গেল, টাকি মাছ আর চিংড়ী মাছের ভর্তা, বেগুন ভর্তা, লাউয়ের তরকারী, পাঁচমিশালি সবজি, ঘন ডাল… আর কি চাই, সাথে লেবু, কাঁচামরিচ এবং তাদের অতি জনপ্রিয় তেঁতুল-বড়ই দিয়ে বানানো টক-মিষ্টি চাটনি। পেটপুরে খেয়ে নিলাম।
কাউন্টারে গিয়ে বিল দিতে যাবো, কাউন্টারে বসা ভদ্রলোক বললেন তাদের দই খেয়ে দেখতে। দই নিয়ে এসে বাইরের ছাতাগুলোর তলায় বসলাম। এই উঠোনে কত গুণীজন বসেছেন, তাদের উপস্থিতি অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। এতটাই তন্ময় ছিলাম, হুট করে দেখি আমি যে চেয়ার এ বসে আছি তার পাশের চেয়ারে একটা মুসকো বিড়াল সুন্দর ভাত ঘুম দিচ্ছে।
এখানে প্রতিদিন সকল পদ রান্না করা হয় না, একেকদিন একেক পদ থাকে। তাই আগে থেকে কোন বিশেষ পদ খাবার পরিকল্পনা করে এখানে আসা যাবে না। এখানে ভাত, ডাল প্রতি বাটি ২০ টাকা, সবজি এবং প্রতি পদ ভর্তা ৩০ টাকা, চাটনি আর বেগুণ ভাঁজা ২৫ টাকা। আলুর দম ৩৫ টাকা, মুড়িঘণ্ট ৫০ টাকা। মুরগীর মাংস ১২০ টাকা, ইলিশ ২৮০ টাকা, রুই ২২০ টাকা (আজকের দেয়া দর অনুযায়ী)। দই ছিলো প্লাস্টিকের ছোট বাটিতে, দাম ত্রিশ টাকা। বিকেলের দিকে লুচি ভাজি বিক্রি হয়, দাম জিজ্ঞেস করা হয় নাই। দাম কিছুটা বেশী মনে হলেও, খাবারের স্বাদ ভালো ছিলো। দুজনে শেয়ার করে প্রতিটি পদ খাওয়া যাবে, শুধু চিংড়ী আর টাকি’র ভর্তা ছাড়া, সেগুলো অন্যান্য যেকোন সাধারণ হোটেলের মত এট্টুসখানি একটা মার্বেল সাইজের!
তো একদিন সময় করে ঘুরে আসুন না, মধ্যহ্নভোজে “বিউটি বোর্ডিং”।
মন্তব্যসমূহ