সদাসদী জমিদার বাড়ী - গোপালদী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২১)

টলটলে পুকুরের জলে স্বচ্ছ নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি আয়নার মত দেখাচ্ছিলো উপর থেকে, ঠিক তার পেছনে সবুজ লতাগুল্মের ঝোপ এর উপরে দুচারটি গাছ দাঁড়িয়ে, তার পাদদেশ ঘেঁষে দৃষ্টি এগিয়ে দিলে হলদে সর্ষে ক্ষেতের বিস্তীর্ন জমিন যার শেষপ্রান্তের দিগন্ত রেখায় আবার সবুজ গাছের সারি। এমন প্রকৃতির রূপ দেখলে যে কেউই দৌড় দিবে সেই দিকে। তাই তো আমার ভ্রমণসাথী এক বন্ধুর ছয় বছরের ছেলেটি বাঁধনমুক্ত থাকায় এক দৌড়ে পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে সোজা নীচে নেমে গেল একেবারে। আমাদের সমস্বর চিৎকারে বেচারা উল্টো ভয় পেয়ে গেল, সে তো পানিতে নামতো না, বরং আমাদের চিৎকারে ভয়েই পানিতে পড়ে যেতে পারতো। হ্যাঁ, কথা হচ্ছিলো সদাসদী জমিদার বাড়ীতে প্রবেশ এর মুখে থাকা একটা পুকুর এর। গত জানুয়ারী মাসের শেষ শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ভ্রমণের সময় প্রায় পাঁচ বছর পর কোন জমিদার বাড়ী ভ্রমণ করার সুযোগ পেলাম। এমনিতেও প্রায় তিন বছর ঘোরাঘুরি একেবারে বন্ধ ছিলো। বহুদিন পর জমিদার বাড়ীর খোঁজে বের হয়ে সেদিন বেশ ঘোরাঘুরি হয়েছিলো। তো আজ কথা বলছি সদাসদী জমিদার বাড়ীর, যা নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার গোপালদী পৌরসভায় অবস্থিত। 



প্রায় দেড়শত বছর আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বর্তমান গোপালদী পৌরসভা এলাকায় ৩টি জমিদার পরিবারের ইতিহাস জানা যায়, তারা ছিলো সরদার পরিবার, তেলি পরিবার এবং ভুঁইয়া পরিবার। এদেরে মধ্যে সম্পদ এবং ক্ষমতার মাপকাঠিতে এগিয়ে ছিলো সরদার পরিবার। সরদার পরিবারের তিন সন্তান শ্রী প্রসন্ন কুমার, মরিন্দ্র কুমার আর গোপাল চন্দ্র। সেই গোপালচন্দ্রের নামানুসারেই বর্তমান গোপালদী নামটি রাখা হয়। এর সাথেই এখানে রয়েছে ভুঁইয়া বাড়ি যার জমিদার ছিলেন হরিচন্দ্র ভুঁইয়া এবং কানাইচন্দ্র ভুঁইয়া নামক দুই ভাই। অপরদিকে তেলি পরিবার নিয়ে বিশদ কোন তথ্য জোগার করতে পারি নাই। 


পুকুরঘাট ধরে এগিয়ে ভেতরের দিকে গিয়ে বামে তাকালেই চোখে পড়বে সরদার বাড়ী, কারুকার্যখচিত দ্বিতল জমিদার বাড়িটি ১০১ কক্ষবিশিষ্ট। বাড়ির সম্মুখপানে প্রসস্থ একটি উঠোন যার ৩ দিকে রয়েছে আরও তিনটি বাড়ি। এই বাড়ীর নির্মাণশৈলীতে মোগল আমলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। অযত্ন আর অবহেলায় ভেঙে পড়েছে রন্ধনশালা। লতাগুল্ম গজিয়ে ঢেকে গেছে পূজা-অর্চনার ঘর ও শৌচাগার। এই বাড়ীর নিচতলায় চলত দাপ্তরিক কর্মকান্ড আর দ্বিতীয় তলায় ছিল শয়ন কক্ষ, জলসাঘর ও পূজা-অর্চনার ঘর। কারুকার্য খচিত দরজা-জানালাগুলো এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। এরই মধ্যে খসে পড়েছে মূল স্থাপনার পলেস্তারাসহ নানা অংশ। চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান পাথরসহ আসবাবপত্র। আর শুরুতেই তো বলেছি সেই পুকুরের গল্প, যেখানে রয়েছে দুটি শানবাঁধানো ঘাট। অনেক আগে এই দুই ঘাটের মাঝে একটি দেয়াল ছিল, যা দিয়ে দুটি ঘাটের মাঝে একটা পর্দা তৈরী করা হয়েছিলো। এই ঘাটগুলোর একটিতে পুরুষ, অন্যটিতে মেয়েরা গোসল করত। পুরো জমিদার বাড়ীর স্থাপনার সর্বত্র আর দশটা জমিদার বাড়ীর মতই অযত্ন আর ক্ষয়ে যাওয়ার ভগ্নদশা পরিলক্ষিত হয়েছে। 


আমরা সময় নিয়ে জমিদার বাড়ীটির চারিধার ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ছবি তোলা হল অনেকগুলো। এরপর এখান হতে দলের কাছ থেকে আমি বিদায় নিয়ে আলাদ হয়ে যাই। সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে চলে যাবে, আর আমি রওনা দিলাম আরও তিনটি জমিদার বাড়ীর খোঁজে। সেই গল্পগুলো এই সিরিজের পরবর্তী পর্বগুলোতে থাকবে। আর হ্যাঁ, জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে দুঃখ হয়, কিভাবে অবহেলায় এসব নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।












মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ