সদ্য বৃষ্টিস্নাত মুঘল গার্ডেনগুলো সেদিন যেন অন্যরকম এক সৌন্দর্য লাভ করেছিল। শঙ্করাচার্য হিল আর চাশমেশাহী মুঘল গার্ডেন ভ্রমণ শেষে আমরা এলাম কাশ্মীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুঘল গার্ডেন ‘নিশাত বাগ’ ভ্রমণে। পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত এই বাগান বিখ্যাত ডাল লেকের পূর্ব পাশে অবস্থিত; যার দরুন এখান হতে সূর্যাস্তের অপূর্ব একটা ভিউ পাওয়া যায়, আমরাও পেয়েছিলাম। এই বাগানের স্থাপত্যশৈলী, লোকেশন, রঙবেরঙের বাহারি সব ফুলের সমারোহ আর সম্মুখের ডাল লেক এবং পেছনে দাঁড়ানো পর্বতমালায় মেঘের লুকোচুরি আমাদের সত্যি বিমোহিত করেছিল।
উর্দু শব্দ নিশাতবাগের অর্থ আনন্দের বাগান বা উৎফুল্লতার বাগান। এই নিশাতবাগের নির্মাতা ছিলেন আসিফ খান। ইতিহাস বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের বড় ভাই আসিফ খান ১৬৩৩ সালে নির্মাণ করেন। এই বাগানকে ঘিরে রয়েছে একটি চমৎকার ইতিহাস। এই বাগান নির্মাণ সম্পন্ন করে আসিফ খান তার জামাতা সম্রাট শাহজাহানকে আমন্ত্রণ জানান বাগান পরিদর্শনে। আসিফ খানের কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগম'কে বিবাহ করেন সম্রাট শাহজাহান, যার মধ্যস্থতাকারী ছিলেন সম্রাজ্ঞী নুরজাহান। এই বাগানের নির্মাণশৈলী এবং সৌন্দর্য সম্রাট শাহজাহানকে এতোটাই বিমোহিত করে যে, উনি এটার প্রেমে পড়ে যান। তিনি মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করেন এই বাগানটি নিজের করে পেতে এবং বারকয়েক তা প্রকাশও করেন শ্বশুরের সম্মুখে। সম্রাট আশা করেন তার ভালোলাগার কথা জানতে পেরে আসিফ খান এটা জামাতাকে উপহার দিবেন। কিন্তু সেরকম কিছু না ঘটায় সম্রাট মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং পরবর্তীতে বাগানের পানি সরবারাহ বন্ধ করে দেন।
এই বাগানের পানি সরবরাহ হত শালিমার বাগ হতে, যা এই বাগানের সন্নিকটে এবং সম্রাট শাহজাহানের মালিকানায় ছিল। পানির অভাবে ধীরে ধীরে এই নিশাত বাগের গাছগুলো সব শুকিয়ে যেতে থাকে, সাথে মর্মাহত আসিফ খান ভেঙ্গে পড়েন। এই রকম সময়ে একদিন শাহজাহানের এক ভৃত্য আসিফ খানের মনকষ্ট বুঝতে পেরে পানির সরবরাহ চালু করে দেন। কিন্তু আসিফ খান তা বন্ধ করে দিতে বলেন যেন সম্রাট শাহজাহান আরও বেশী মনঃক্ষুণ্ণ না হন। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান এই ঘটনা জানতে পেরে শালিমার বাগ হতে নিশাত বাগে পুনরায় পানির সরবরাহ চালু করে দেন।
কাশ্মীর ভ্যালীতে প্রায় ৪৬ একর জমির উপর সুসজ্জিত এই বাগানের সামনে ডাল লেকের স্বচ্ছ জল আর পেছনে নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়; একে দিয়েছে অনবদ্য রূপ। শীতকালে যখন এই বাগানের পাহাড়ের পেছনে শ্বেতশুভ্র বরফে ঢাকা পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ দেখা যায়, তখন তা হয়ে ওঠে অপার্থিব। অন্যান্য মুঘল গার্ডেনের মত এটিও একটি ভবনের ন্যায় কাঠামোর ছাদের উপর নির্মিত যাকে বলা হয়ে থাকে ‘Terraced Garden’। নির্মাণের শুরুতে ছিল ১২ ধাপের টেরেসের উপর এই বাগানটি; কিন্তু পরবর্তীতে রাস্তা নির্মাণ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে বর্তমানে নয়টি টেরেসের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই বাগানটি। পারস্য স্থাপত্যকলার আদলে তৈরি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত চতুর্ভুজাকৃতির কাঠামোর এই বাগানের দু’পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বাগানের গাছগুলো রোপিত হয়েছে।
৫৪৮ মিটার লম্বা আর ৩৩৮ মিটার চওড়া কাঠামোটি অনিন্দ টপোগ্রাফি আর পানির প্রবাহধারা দিয়ে তৈরি অন্যতম একটি মোঘল স্থাপনা যার সৌন্দর্যে প্রতি বছর লাখো পর্যটক এখানে ছুটে আসে। এই বাগানের একেবারে উপরে, পাহাড়ের পাদদেশের প্রথম ধাপটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, এখান হতে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে নীচে নেমে এসে শেষ ধাপটি মিলেছে ডাল লেকের সাথে। পলিশ করা পাথরে তৈরি বাগানের দুপাশে রয়েছে চিনার গাছের সারি। গোপী ঝর্ণা হতে প্রবাহিত পানির উৎস হতে এই বাগানের মাঝের তৈরি পথে পানি প্রবাহিত হয়ে ডাল লেকে গিয়ে মেশে। প্রতিটি ধাপের মাঝে পানির ফোয়ার তৈরি করা আছে, উঁচু ধাপ হতে ক্রমান্বয়ে নীচের ধাপে। বেলা সাড়ে নয়টা থেকে বেলা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এই বাগান খোলা থাকে সর্বসাধারণের জন্য; তবে বেলা সাড়ে চারটার পর প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়। জনপ্রতি দশ রুপী করে এখানে টিকেট কাটতে হবে আপনাকে।
নিশাত গার্ডেনে বিকেলের বেশ কিছুটা সময় কাঁটিয়ে আমরা রওনা হলাম শেষ গন্তব্য শালিমার গার্ডেনের উদ্দেশ্যে। এমন মায়াময় প্রতিটি বাগান আর সৌন্দর্যের ঝাঁপি যে মন চায় সারাদিন বসে থাকি। কিন্তু সময় স্বল্পতা বলে কথা। চোখের দেখা দেখে, মনে এক বুক তৃষ্ণা রেখে আমরা ছুটে চললাম পরের গন্তব্যে। এর মধ্যে সূর্য লাল বর্ণ ধারন করে জানান দিচ্ছে সন্ধ্যে হল বলে।