কাশ্মীরি মুঘল গার্ডেনস - পরিমহল এবং চাশমেশাহী
পরীমহল অনিন্দ্য সুন্দর একটি মুঘল স্থাপনা। সাতটি ছাঁদের উপর সুসজ্জিত এই স্থাপনার পরতে পরতে রয়েছে মোঘল স্থাপত্যের ছোঁয়া। ‘জাবারওয়ান’ পর্বতশ্রেণীর কোলে অবস্থিত এই স্থাপনা ও বাগান ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এই বাগানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, এখান থেকে পুরো শ্রীনগর শহর দেখা যায়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের সময়ের স্থাপত্যকলা এবং চিত্রকলার অনন্য নিদর্শন’র ছায়া এখানে দেখা যায়। মুঘল যুবরাজ দারাশিকো’র জন্য এটা নির্মাণ করা হয় ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। এটা মূলত ছিল যুবরাজের পাঠাগার এবং তাকে ঘিরে সাজানো বাগান। ১৬৪০, ১৬৪৫ এবং ১৬৫৪ সালের দিকে যুবরাজ দারাশিকো এখানে বসবাস করেছিলেন বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। পরবর্তীতে এই মহল আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষ করে এস্ট্রোলজি এবং এস্ট্রনমি’তে এটার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে এই বাগান শ্রীনগর সরকারের অধীনে রয়েছে।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরে পরীর নিবাসখ্যাত এক মুঘল স্থাপনা এবং তার সন্নিকটস্থ বাগান’কে কেন্দ্র করে এই জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ‘পরীমহল’ অবস্থিত। শ্রীনগরের ডাল লেকের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের ‘জাবারওয়ান’ পর্বত শ্রেণীর এই মুঘল স্থাপনায় দেখা মেলে ষোড়শ শতকের মুঘল স্থাপত্য এবং চিত্রকলার অনন্য নিদর্শন। সুপ্রশস্ত বাগান ঘেরা এই স্থাপনায় একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মঠ ছিল, পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র দারাশিকো’র পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে এস্ট্রোলজিকাল স্কুল গড়ে তোলা হয়। শ্রীনগরের অন্যান্য মুঘল গার্ডেনগুলোর মত এখানে কৃত্রিম ঝর্ণা বা ফোয়ারা দেখা যায় না। এর মূল কারণ, এখানে বাগানে পানি প্রবাহিত হয় মাটির তলদেশে স্থাপিত পাইপ দিয়ে প্রবাহিত পানির ধারা হতে। এখানে মোট সাতটি চত্বর দেখা যায়, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ ফিট এর কাছাকাছি এবং প্রস্থ ১৭৯ ফিট থেকে ২০৫ ফিট পর্যন্ত বিস্তৃত।
উপরের দিকের চত্বরগুলো দুটি ভিন্ন স্থাপনায় বিভক্ত; ডাল লেকের দিকে মুখ করা ‘বারাহদ্বারি’ নামক কক্ষ এবং পাহাড়ের দিকে ছিল জলাধার যেগুলো পর্বতের উপর হতে প্রবাহিত ঝর্ণা হতে প্রবাহিত পানিতে পূর্ণ হত। আজ আর সেই জলধারা নেই, আছে শূন্য জলাধারগুলো। এগুলো পাথরচূর্ণ আর চুনা দিয়ে তৈরি মিশ্রন দ্বারা নির্মিত এবং দুটি ছোট খিলানযুক্ত। একটি চত্বর এর নীচে অন্য চত্বর, এমন করে তৈরি হয়েছে এগুলো। প্রতিটি হতে নিম্নের চত্বরে প্রবাহের জন্য নালা কাঁটা আছে। প্রতিটি স্তরের নির্মাণ কৌশল এবং স্থাপত্যকলা তৎকালীন অনন্য নির্মাণশৈলী’র সাক্ষী দেয়। স্থাপত্যকলা এবং তদসংলগ্ন বাগানের অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে আজও এই পরিমহলে ছুটে আসে হাজারো পর্যটক। পরিমহল না দেখেই আমরা ছুটেছিলাম ‘চাশমেশাহী’র পাণে। ডাল লেক ঘেঁষে চলে যাওয়া পিচঢালা পথে, মেঘলা আকাশ আর ডাল লেকের জলে তার প্রতিচ্ছবি, সম্মুখে পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের খেলা, অপরূপ ছিল সেই ছুটে চলা। শঙ্কর আচার্য হিল হতে অতি অল্প সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম মুঘল গার্ডেন ‘চাশমে শাহী’র প্রাঙ্গনে।
রাজকীয় বসন্তের আবেশে সাজানো মুঘল গার্ডেন ‘চাশমে শাহী’র স্থাপনাটি ১৬৩২ সাল নাগাদ সম্রাট শাহজাহানের তৎকালীন গভর্নর আলী মারদান খান নির্মাণ করেন। মূলত এটা নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল সম্রাট কর্তৃক তার প্রিয় জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশিকো কে উপহার দেয়া। ডাল লেকের প্রান্ত ঘেঁষে ‘রাজ ভবন’ সংলগ্ন এই মোঘল বাগানটিও ‘জাবারওয়ান’ পর্বতশ্রেণীর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
এই বাগানের নামকরণ নিয়ে যে ইতিহাস পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক এই বাগানের নামকরণ করা হয় কাশ্মীরের বিখ্যাত মহিলা ধর্মীয় সাধক ‘রুপা ভবানী’র বংশীয় উপাধি ‘সাহিব’ থেকে। ‘চাশমে সাহিবি’ নামে খ্যাত এই বাগান যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়ে আজ ‘চাশমেশাহী’ নামে পরিচিত। চাশমে শাহী বলতে মূলত বুঝায় রাজকীয় ঝর্ণাধারা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝর্ণার প্রবাহিত জলধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই বাগানের ফুলের বাহার দেখলে আপনিও এর নামের সার্থকতা খুঁজে পাবেন। এই চাশমেশাহী’র পূর্ব দিকে গড়ে তোলা হয়েছিল পরিমহল, যা ছিল সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো’র এস্ট্রলজি শিক্ষার জন্য নির্মিত। চাশমেশাহী বাগানটি ১০৮ মিটার লম্বা এবং ৩৮ মিটার প্রশস্ত; এবং পূর্ণ বাগান এলাকা এক একরের বেশী জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে; যা অন্য দুটি বাগানের চেয়ে অনেক ছোট আয়তনের।
চাশমেশাহী বাগানটি শ্রীনগর এয়ারপোর্ট হতে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে রাজভবনের সন্নিকটে অবস্থিত। ডাল লেকের তীর ঘেঁষে এই বাগান হতে ডাল লেকের অপূর্ব রূপ দেখা মেলে। এই বাগান মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে ভ্রমণের সেরা সময় এপ্রিল থেকে অক্টোবর। আমরা গিয়েছিলাম অক্টোবর এর দ্বিতীয় সপ্তাহে। ফুলে ফুলে ছেয়ে ছিল পুরো বাগান। তাই তো দলের সবাই বাগানে ঢুঁকে যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছবি তুলতে, সাথে রূপের সাগরে ডুব দিতে।