সিমলা টু মানালি ভায়া পানদোহ লেক

সকালে ঘুম থেকে উঠে টের পেলাম, আজকের আবহাওয়া চমৎকার, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। আজ আমাদের গন্তব্য সিমলা থেকে মানালি। ড্রাইভার বিপিন আগেই বলে দিয়েছিল লম্বা যাত্রা, প্রায় দশ-এগারো ঘণ্টার পথ। আমাদের লাগেজ রাতেই গুছিয়ে রেখেছিলাম, নাস্তা সেরে আমরা হোটেল থেকে চেক আউট করে রওনা হলাম মানালি’র পথে। সিমলা থেকে মানালি প্রায় ২৫০ কিলোমিটারের বেশী পথের যাত্রা। আমাদের রুট ছিল সিমলা-বিলাসপুর-সুন্দার নাগার-মান্ডি-কোটলা-কুলু-মানালি। সিমলা থেকে নারকান্দা দিয়ে আরেকটা রুট আছে মানালি যাওয়ার। মজার একটা তথ্য দিয়ে রাখি, মানালি কিন্তু কুলু জেলার অন্তর্গত। কিন্তু পর্যটকেরা সবসময় বলে, মানালি গেলে কুলু যাবেন অবশ্যই। আসলে, কুলু যাবেন মানালি যাওয়ার জন্য, তাই না? 😉

যাই হোক, আমাদের গাড়ী চলতে লাগলো, আর সাথে চমৎকার সব গান। জানালার ফাঁক গলে ছবি তোলা, চারিপাশের সব দৃশ্যই ক্যামেরাবন্দী করে রাখার মত। আর আমি তো সামনে বসে ভিডিও করেই চলেছি, ঠাণ্ডায় হাত জমে যায় অবস্থা বাতাসের কারনে, তার সাথে দীর্ঘক্ষণ জানাল দিয়ে গাড়ীর ছাঁদের সাথে মোবাইল আটকে ধরে রাখা। আহ, কি সব ভিডিও ছিল; পুরাই মাথা নষ্ট। কিন্তু সব হারিয়ে গেল আমার মোবাইল চুরির সাথে সাথে।  😟  তবে সবার উদ্দেশ্যে বলি, দিল্লী বা সিমলা থেকে মানালি যাবেন দিনের বেলায়, রাতের গাড়ীতে নয়, প্রয়োজনে একটু বেশী টাকা খরচ করে প্রাইভেট কারে। তাহলে আসলেই দেখবেন হিমাচলের রূপ। নইলে রাতের আঁধারে সব হারাবেন। 😉

বেলা বারোটা নাগাদ আমরা পার হচ্ছিলাম অপূর্ব একটা জায়গা। পাহাড়ের ভাঁজে রাস্তা, মাঝে নীলাভ সবুজ রঙের পানির লেক আর তার অপর পাশেও সবুজে ছেয়ে থাকা পাহাড়। দেখে তো পুরাই মাথা নষ্ট, কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে ফটো আর ভিডিও পালা চলার পর ড্রাইভারকে বললাম গাড়ী থামাতে। ও ব্যাটা, আরেক কাঠি সরেস, বলে অপেক্ষা কর, জায়গা মত থামাব। একটা ভিউ পয়েন্টে গাড়ী থামাল। অপূর্ব সেই জায়গা, শুধু চেয়ে দেখার। পোষ্টের একেবারে শুরুতে দেয়া ছবিটা তুলে আমার নিজেরই মাথা নষ্ট, তাও মোবাইল ফোন দিয়ে। খেয়াল করে দেখুন একটা কালো বিন্দুর মত রাস্তার শেষে, লেকের কাছে; সেটা একজন মানুষ, দাঁড়িয়ে আছে লেকের পারে... আহ, কি লোকেশন!! প্রায় আধঘণ্টা সেখানে যাত্রা বিরতি ছিল। এরপর আবার এগিয়ে যাওয়া।

বিয়াস এবং সাতলুজ নদী দুটি হিমালয় থেকে প্রবাহিত যার মধ্যে বিয়াস (বিশাখা) এর স্রোত প্রায় সারা বছরই প্রবাহিত হয়। আর এই প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন'র নিমিত্তে এই পানদোহ ড্যাম তৈরি হয়। এখান হতে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে এই ড্যামের দ্বারা তৈরি স্রোত ব্যবহার করে। ১৯৫৭ সালে এই প্রজেক্ট নিয়ে ভাবনা শুরু হয়ে ১৯৭৭ সালে বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। বিয়াসের গতিপথ পাল্টে দিয়ে প্রায় ৩৮ কিলোমিটারের টানেল-চ্যানেল দিয়ে এই পানিকে প্রবাহিত করা বিয়াস থেকে সাতলুজ নদীতে, যার পরিমান প্রতি সেকেন্ডে প্রায় নয় হাজার কিউসেক পানি!

 

এর মাঝে মান্ডি থেকে আমাদের দলের বাকী সদস্যরা ডলার ভাঙ্গিয়ে নিল। এটা নিয়ে ছিল মজার ঘটনা। আমি আমার সকল ডলার কলকাতা থেকেই ভাঙ্গিয়ে নিয়েছিলাম, রেট পেয়েছিলাম যতদূর মনে পড়ে ৬৬ রুপীর কাছাকাছি। দলের বাকী সবাই আরও ভাল রেটে ভাঙ্গানোর আশায় সাথে বয়ে বেড়াল। কাশ্মীরে ভাঙ্গাল ৬৪ রুপী করে, আর সিমলা এসে রেট পেল আরও কম ৬২। শেষে ড্রাইভারের পরামর্শে মান্ডি’তে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র শাখায় নিয়ে গেল। তবে ওখানে না ভাঙ্গাতে পারলেও, ব্যাংকের লাগোয়া একটা গভঃ এপ্রুভড মানি এক্সচেঞ্জে ওরা পাঠাল, রেট মন্দ দিল না, ৬৪ রুপী, সাথে মানি রিসিপটও দিল। 

এরপর আমাদের যাত্রা বিরতি ছিল দুপুরের লাঞ্চের। একটা ধাবা টাইপ রেস্টুরেন্টে আমরা লাঞ্চ সারলাম, আজও ড্রাইভার বিপিনের ব্রত ছিল, ও সাথে ক্যারি করা ফলার দিয়ে লাঞ্চ সারল, সাথে চা। আবারো যাত্রা। মাঝে পার হলাম সিমলা-মানালি পথের জালরি পাস অতিক্রম করে ২.৮ কিলোমিটার লম্বা একটি টানেল। সিমলা থেকে মানালি যেতে হয়ে এই টানেল অতিক্রম করে। এমন কি স্থানীয় লোকেরা কাজের জন্য টানেলের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত হেঁটে অতিক্রম করে। আমাদের গাড়ী যখন যাচ্ছিল, আমি এক হাতে যথারীতি মোবাইল ধরে আছি গাড়ীর ছাঁদে আর সম্মুখে দৃষ্টি। তখন দেখি এক লোক সুন্দর হেঁটে যাচ্ছে, ফুটপাথ ধরে। টানেলের ভেতর ফুটপাথ আছে। ভেতরটা অত্যাধিক ঠাণ্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে, তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ড্রাইভার বিপিন জানাল, মানালি-লেহ এর মাঝে প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল তৈরির কাজ জোরেশোরে এগিয়ে চলছে, ২০১৭-২০১৮ সালের দিকে খুলে দেয়া হবে। তখন মানালি থেকে লাদাখ একদিনে চলে যাওয়া যাবে। টানেলটির নাম দেয়া হয়েছে “রোহটাং টানেল”। ২০১০ সালে এটার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। গতমাসে নিউজ দেখলাম, এক বছর পিছিয়ে এটা এখন ২০১৯ সাল নাগাদ কাজ শেষ করে খুলে দেয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

 

বিকেল বেলা আমাদের ড্রাইভার বিয়াস নদীর পাশ ঘেঁষে কুলু’র কাছাকাছি এলাকায় যাত্রা বিরতি দিল। একটা রোড সাইড ক্যাফে, অপর পাশে একটা হোটেলের নির্মাণ কাজ চলছে। চমৎকার একটা জায়গা, সেইরকম ভিউ। দুঃখের ব্যাপার এখানকার তেমন কোন ভাল ছবি তুলতে পারি নাই। একটা ছবি একজন ভ্রমণ সাথী তুলেছে, ছবিটি হারিয়ে ফেলেছি, তাই দেয় হল না পোস্টে; তবে ছবিটা ছিল অসাম। পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গীতে চা খাচ্ছি বিয়াস নদীর পাশে। নীচে পাথরের ফাঁক গলে কুলকুল রবে বয়ে চলছে খরস্রোতা নদী, অপর পাশে পাহাড়ের ঢালে সাজানো সব বাড়ীঘর। ছবিটা দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়। আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর একটি বিকেল আর অতি অবশ্যই সেরা বৈকালিক চা-পান। 😜

সন্ধ্যে প্রায় হয় হয় এমন সময় আমরা মানালি এসে পড়লাম। মানালি মল হতে বারো’শ মিটার দূরে ছিল আমাদের হোটেল। হোটেলে এসে চেক ইন করলাম, এবারের সফরের সবচেয়ে লম্বা সময় এই হোটেলেই থাকতে হবে, চারদিনের ডেরা। মাঝারি মানের হোটেলটি খুব একটা মন্দ ছিল না। মানালি’তে দেখলাম শীত ভালই, আর কিছুদিনের মধ্যেই বরফ পড়া শুরু হবে। তো কি আর করা, আজ আর মানালি মলে যাওয়ার আগ্রহ নেই, প্ল্যান করলাম কাল না হয় যাওয়া যাবে। তাই, আজ বিশ্রাম নেয়া যাক। 

বিঃদ্রঃ আমার মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় প্রচুর ফটো সংকটে ছিলাম, সিমলা-মানালি রোডের অপূর্ব ভিউগুলোর ছবি দিতে পারলাম না। দুঃখ আর দুঃখ!!!

মন্তব্যসমূহ

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ