সিমলা দর্শন - শহরে ঘোরাঘুরি
আগামীকাল সকালে চলে যাব সিমলা থেকে মানালি, তাই এদিন বিকেল বেলাটা বরাদ্দ ছিল সিমলা শহরের কিছু দ্রষ্টব্য স্থান ঘুরে দেখার। বিকেলের শুরুতেই আমরা চলে যাই সিমলা মলের দিকে। মূলত এই মলকে ঘিরেই সিমলা শহরের পর্যটন আবর্তিত হচ্ছে। দুই পাশে সারি সারি দোকানের লোভনীয় পণ্য সমাহার আর পিচঢালা পথে হাজারো পর্যটকের পদচারনা সিমলার অন্যতম দ্রষ্টব্যের একটি। এখানে রয়েছে রেস্তোরা, ক্লাব, বার, কফিশপ থেকে শুরু করে স্ট্রীট ফুডের সমাহার। আর তাইতো সিমলা মল পর্যটকদের কেনাকাটার জন্য এক স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মল রোড মূলত তৈরি হয় ব্রিটিশ শাসন আমলে। সিমলার বিখ্যাত “রিজ” এর ঠিক নীচের দিকের স্তরে মল রোড। যেন একতলায় মল রোড, আর ছাঁদের উপর রিজ। এই মল রোডে রয়েছে সিমলা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টার। কোন যানবাহন এখানে ঢুকতে পারে না, শুধুমাত্র অতি জরুরী ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
আমার সাথীদের মল রোডে ছেড়ে দিয়ে আমি আমার এজেন্টের অফিস খোঁজা শুরু করলাম। প্রায় আধঘণ্টা একমাথা হতে আরেক মাথা ঘুরেও যখন ব্যর্থ তখন খুঁজে পেলাম। আমাদের হোটেল থেকে যে রাস্তাটা সোজা মলের দিকে উপরে উঠে গেছে সেই রাস্তার একেবারে বরাবর, বড়সড় সাইনবোর্ডটি কেন আমার চোখে পড়ল না বুঝতে পারলাম না। সেখানে কিছু দেনাপাওনা এবং অফিসিয়াল কাজ শেষ করলাম। ওদের অফিসে এক গ্লাস আপেল জুস দিল, সেই রকম স্বাদ। কাশ্মীর এবং মানালিতে জুস খেয়েছি, কিন্তু ওটার মত মজার ছিল না। তবে সবচেয়ে ফ্রেশ জুস ছিল কাশ্মীরের আপেল বাগানের জুস, একেবারে অন্যরকম। যদিও টেস্ট বেটার ছিল এদেরটা। বুঝেনই তো, নিশ্চয়ই কিছু মিক্সড ছিল :P
আমি আমার কাজ শেষে নিজের মত করে ঘুরে দেখা শুরু করলাম সিমলা শহর। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট। না ভাই আমি কিছু করি নাই, করছিল পাতিয়ালার মহারাজ আর এক ব্রিটিশ ভাইসরয় এর কন্যা... ;) । না, স আসলে এটা হল মল রোড আর রিজ রোডের সংযোগ স্থল। এখানে আছে ব্রিটিশ এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম একজন লালা লাজপাত রায় এর মূর্তি। ইয়ে, উনার কিন্তু কোন স্ক্যান্ডাল এর সাথে সম্পর্ক নেই। এই পয়েন্টের লাগোয়া রয়েছে সিমলার জেনারেল পোস্ট অফিস। আমি সেখানে বসে বসে ভাবছিলাম একটা স্ক্যাএন্ডাল করা যায় কি না, আর সেই স্ক্যাএন্ডআল এর কথা জানিয়ে জেনারেল পোস্ট অফিস হতে বাসায় একটা চিঠি পাঠিয়ে দেই। ফায়ার সার্ভিস কিন্তু পাশেই আছে ;)
যাই হোক, এবার আমি সিমলা রিজ এর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আমি আমার সাথীদের বলেছি রিজে ঘোরাঘুরি করতে, আমি খুঁজে নিব। বিকেলের সোনালি আলোয় রঙিন মানুষের রঙের বাহার দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে। দোকানে দোকানে নানান অফার, মনে হয় সব কিনে ফেলি। কিন্তু কেনাকাটা কাশ্মীরেই অনেক হয়ে গেছে, গতকাল ফাগু থেকেও কিছু কিনেছি, তাই এখন আর কিছুতেই না। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সিমলা রিজে। অনেকবার টিভিতে দেখা সিমলা রিজ!
“সিমলা রিজ” মূলত পাহাড়ের উপরে খোলা একটা প্রশস্ত চত্বর, এটিকে বলা যেতে পারে সিমলার প্রাণকেন্দ্র। এখানে যাবতীয় সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের আয়োজন হয়ে থাকে। আমরা যেদিন গেলাম, সেদিনও দেখলাম একটা প্রতিষ্ঠানের কোন একটা চ্যারিটি কার্যক্রম চলছে একপাশে। এই রিজের সাথে স্নো ডাউন, মল, জাখু হিল, লাক্কার বাজার উডেন মার্কেট এসব সংযুক্ত রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত এই রিজ পশ্চিম দিক দিয়ে সেই স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট হয়ে মলের সাথে মিশেছে আর পূর্ব দিকে লাক্কার বাজারে। এই রিজ এই রয়েছে বিখ্যাত সিমলা চার্চ, এখান থেকেই যেতে হয় জাখু মন্দিরে। এখানে রয়েছে সিমলার লাইব্রেরি বিল্ডিং। রিজে রয়েছে মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী এবং ডঃ ওয়াই এস পারমার (হিমাচল প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী) এর মূর্তি। এই রিজে সারাটা বিকেল অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যায়। রিজের দুটি ধার করা ছবি নীচে দিলাম দুই সিজনের রিজ দেখার জন্য।আমি রিজে এসে বিখ্যাত চার্চের সামনে দাঁড়ালাম, এখান হতে খুঁজে দেখলাম আমার সঙ্গীদের কাউকে দেখা যায় কি না। দেখি, আমাদের দলের জেনুইন ট্র্যাভেলার মিতা রয় জাখু পাহাড়ের পাহাড়ি পথ ধরে চলেছেন জাখু মন্দির দর্শনে। আমি দাঁড়িয়ে সেখানে, এখানেই সবাইকে পাওয়া যাবে। বিখ্যাত চার্চের ধারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এটিকে।
উত্তর ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম চার্চ এটি। নিও-গোথিক স্টাইলে এই চার্চটি নির্মাণ করা হয় ১৮৫৭ সালে। এর ডিজাইন করেন জে টি বইলিউ ১৮৪৪ সালে। মূলত ইংরেজ কলোনির খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্মিত হয় এই চার্চটি। চার্চের যে ঘড়িটি রয়েছে তা ১৮৬০ সালে কর্নেল ডাম্বেলটন দান করেন। ১৮৭৩ সালে পোর্চ যুক্ত হয়। এলিজাবেথিয় ঘরনার নকশাদার এই চার্চের রয়েছে প্রচুর বইয়ের সংগ্রহশালা। মজার ব্যাপার হল এই চার্চে পাঁচটি ঘোলাটে কাঁচের জানাল রয়েছে যেগুলো খ্রিষ্ট ধর্মের পাঁচটি মূল্যবোধঃ বিশ্বাস, আশা, সেবা, শক্তি, ধৈর্য এর প্রতীকী রূপ। এই চার্চে একটি পাইপ অর্গান রয়েছে যা ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড়। এটি ১৮৯৯ সালে এখানে স্থাপিত হয়।
এতক্ষণে আমার দলের সদস্যদের দেখা পেলাম। আমরা একপাশে সবাই গল্প করে কিছু সময় পার করলাম। ঠিক একঘণ্টার কিছু সময় পর মিতা ফিরে এল। এই জাখু হিলের প্রবেশমুখে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে, জাখু হিলের মন্দির দর্শনের জন্য কোন ধরনের মানুষের কমপক্ষে কতক্ষণ সময় লাগবে।
জাখু পাহাড় সিমলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আর এই চূড়ায় অবস্থিত হনুমান মন্দিরটিই হল বিখ্যাত জাখু মন্দির বা জাখু টেম্পল। হিন্দু ধর্মের রামায়ন অনুসারে প্রভু হনুমান মর্ত্যে আসার সময় এই পাহাড়ে বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং লক্ষণের চিকিৎসার জন্য পাহাড়ের সঞ্জীবনী ঔষধি সংগ্রহ করেন। এই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেই মূলত এই মন্দিরটি গড়ে ওঠে। সিমলা রিজ হতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ দূরত্বে এই মন্দিরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৮,০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত। বর্তমানের যে মূর্তিটি সারা সিমলা শহর থেকে দৃষ্টিগোচর হয়, তা স্থাপিত হয় ২০১০ সালে। ১০৮ ফিট উচ্চতার এই হনুমান মন্দিরের চারপাশে সত্যিকার অর্থেই রয়েছে বানরের রাজত্ব। মন্দির দর্শনার্থীরা এই বানরের দলের হাতে হয়রানি হন। আমাদের মিতা রয়ও হয়েছিলেন, তার মধ্যে তিনি প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় সময়ে সেখানে রওনা হয়েছিলেন... পরে এক স্থানীয় যুবক উনাকে মন্দির পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাদের দুজনের কল্যাণে আমরা সেখানকার কিছু ছবি পেয়েছিলাম। :)
মিতা নেমে এলে পরে আমরা সন্ধ্যের পরপর ঘুরে বেড়ালাম পুরো মল, খেলাম কিছু স্ট্রীট ফুড। এরপর রাত প্রায় নয়টা নাগাদ হোটেলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। যথারীতি ভুল পথ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আধঘণ্টা পর হোটেলে পৌঁছেছিলাম, অথচ বিকেল বেলা হোটেল থেকে মলে যেতে লেগেছে মিনিট পাঁচেক :P । হোটেলে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে গিয়ে ব্যাগ গোছানোর পালা, কারণ আগামীকাল আমরা সকালের নাস্তা সেরে রওনা হয়ে যাব মানালির পথে।
মন্তব্যসমূহ