কাবুলিওয়ালা’র দেশ আফগান, সৈয়দ মুজতবা আলী’র দেশে-বিদেশে পড়ে আমরা পরিচিত হয়েছি বিষয় বৈচিত্রে অনন্য আফগান জনগণ এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই আফগান এখন এক বিভীষিকার নাম। যেখানে রোজ ভোরে সদ্যফোটা পুস্পকলির উপর শিশির ঝরে পড়ে না, সেখানে এখন দেখা যায় ধোঁয়া ওঠা ধ্বংসস্তুপ হতে আগুনের শিখা আর পোড়া ধোঁয়ার কুণ্ডলীর পাশে মৃত, অর্ধমৃত অথবাআহত হয়ে পড়ে থাকা মানুষের দল আর তাদের ঘিরে ছুটতে থাকা সেনা বা উদ্ধারকর্মী’র দলকে। আর এই আফগানিস্তানের মূল শহর কাবুলে অবস্থান করে গত একযুগের কাবুলের চিত্র নিজ লেখনীতে তুলে ধরেছেন মঈনুস সুলতান, তার ভ্রমণধর্মী পুস্তক “কাবুলের ক্যারাভান সরাই” এর পাতায় পাতায়।
আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিস্থল হিসেবে পরিচিত। বহু প্রাচীন বাণিজ্য ও বহিরাক্রমণ এই দেশের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু লোক আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছেন, এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। দেশটির বর্তমান জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। তখন থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান একটি রাজতন্ত্র ছিল। এরই মাঝে দেশের রাজধানী কান্দাহার থেকে কাবুলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং দেশটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে অনেক অঞ্চল হারায়।
১৯শ শতকে দেশটি ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য ও রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে এক বিরাট খেলার মধ্যবর্তী ক্রীড়ানক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৭৩ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক অফিসারেরা রাজার পতন ঘটান এবং একটি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। ১৯১৯ সালে তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধশেষে আফগানিস্তান দেশটি ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিপ্রায়ে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এর সাথে সাথে দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
১৯৯৬ সালে তালেবান নামের একটি মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী কাবুলের দখল নেয়। তালেবান সন্ত্রাসবাদী দল আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ২০০১-এর শেষে তালেবানদের উৎখাত করে। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানের সংবিধান নতুন করে লেখা হয় এবং একটি রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা চালু হয়।
সেই ১৯৯৬ সালের তালেবান শাসন থেকে এই দেশটির সাধারণ জনগনের ভাগ্যে আসে অমানিশার কাল মেঘের ঘনঘটা। প্রথমে ২০০১ পর্যন্ত চলে তালেবানদের অত্যাচার আর তারপর শুরু হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার। আর এই দুয়ে পিষ্ট হয়ে এই দেশটি এখন আর কোন জনপদ নয়, জনপদ নামধারী এক কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে। আর এই যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে দিনের পর দিন ঘুরেছেন মঈনুস সুলতান, মিশেছেন বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে, তুলে এনেছেন সেই ভাগ্যাহত মানুষদের জীবনের সব বিচিত্র আর বেদনাবিধুর গল্পকথা। যুদ্ধ আফগান্দের জীবন বদলে দিয়েছে, বিত্তশালীকে পরিণত হয়েছেন মিসকিনে, প্রাণ চঞ্চল কর্মোদ্যম মানুষটি পরিণত হয়েছেন অর্ধমৃত মনুষ্য মূর্তিতে।
২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মঈনুস সুলতান বিভিন্ন মেয়াদে আফগানিস্তানে গেছেন, বেশীরভাগ সময় থেকেছেন কাবুলে। আর সেই সময়ে তিনি মিশেছেন কাবুলের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির মানুষের সাথে, তুলে এনেছেন তাদের জীবনের অতি সুক্ষ্মসব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সেগুলোর ধ্বংস হওয়ার কথা।
মঈনুস সুলতান ১৯৫৬ সালের ১৭ এপ্রিল সিলেটের ফুলবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। বছর পাঁচেক একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেণ্টেটিভ হিসেবে কাজ করেন লাওসে। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি কায়েম হলে ফি-বছর ওখানে যান পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য। কাবুলে কখনো ছিলেন এডুকেশন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর, কখনো আফগানিস্তানে উচ্চশিক্ষা প্রকল্পের গবেষণা উপদেষ্টা।
এই সময়টায় আফগানদের সহজাত গল্পগুজবে তিনি খুঁজে পেয়েছেন অযুত সব গল্প-ঘটনা যা তিনি বছরের পর বছর লিখে গেছেন তার দিনলিপির খেরখাতায়। এই লেখাগুলো প্রথমে “প্রথম আলো” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সিরিজ আকারে প্রকাশিত হয়। সবশেষে প্রথম আলো’র সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান “প্রথমা প্রকাশন” হতে ২০১২ সালে বইমেলার আগে আগে জানুয়ারি মাসে বইটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশনার পর হতেই পাঠক সমাজে বইটি ব্যাপক সমাদৃত হয়। এটি শুধু একটি ভ্রমণ কাহিনী অথবা কোন ইতিহাসের বই হিসেবে নয়, এটি একটি প্রামান্য দলিল হয়ে থাকবে আগত দিনগুলোতে যখনই আফগান তথা কাবুলের কথা আসবে বাংলা ভাষার জবানীতে।
এই বইটিতে মোট ২৩টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। বইটির শুরু হয়েছে লেখকের কাবুল পৌছতে এয়ারলাইন্স বিড়ম্বনায় ইস্তাম্বুল পৌঁছানো এবং সেখানকার হয়রানী দিয়ে। এরপর বইটি ধীরে আসন জমিয়েছে কাবুলের মাটিতে সেখানকার মানুষ আর তাদের সুখদুঃখের গল্প তুলে ধরতে। বইটি আপনি যত পড়বেন আপনার মন ভালো লাগার চেয়ে খারাপ হবে প্রতিনিয়ত, পরতে পরতে বইটিতে রয়েছে কষ্টের উপাখ্যান। এক পৌঢ় ভিক্ষুকের গল্প এরকম-
"... এ ভিখারি যাযাবর গোত্রের। বছরে দেড়েক আগে সে তার যাযাবর বেরাদারদের সঙ্গে জাবুল প্রদেশের এক পার্বত্য উপত্যকায় তাঁবু খাটিয়ে বাস করছিল। এক রাতে খোদাই গজবের মতো একটি আমেরিকান হেলিকপ্টার সে উপত্যকায় উড়ে এসে ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করতে থাকে। এতে পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি তাঁবু; মৃত্যু হয় অনেকগুলো উট ও খচ্চরের। বোমাবর্ষণে কতজন যাযাবর মানুষের মৃত্যু হয়, ভিখারি আজও তার সঠিক তথ্য কিছু জানে না। তাকে আহত ও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে আল রাশিদ ট্রাষ্ট নামক দাতব্য সংঘের কর্মীরা। হাসপাতালে হুঁশ হলে তাকে জানানো হয় যে তার পরিবারের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী, বৃদ্ধ মাতা ও এক এতিম ভগ্নিসহ আটজনকে দাফন করা হয়েছে... "
এই একই পরিচ্ছেদে আপনি পাবেন, হাজিজার গল্প। লেখকের লেখনীতে আবদুল বসির খান নামক আফগানি’র জবানীতেই শুনুনঃ
"...হাজিজার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা বা রক্তের রিস্তাদারি কিছু নেই। লড়াইয়ের কারনেই আমি তাকে কন্যা হিসেবে দত্তক নিয়েছি। হাজিজার বাবার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন মুদির দোকানদার। তার দোকান থেকে আমি হামেশা তেল-চিনি-ময়দা-সাবান কিনতাম। লড়াইয়ের যে রাতে হাজিজাদের বাড়িতে বোমাবর্ষণ হলো, সে সময় সে তার বাবাকে নিয়ে গাঁয়ে গেছে পূর্বপুরুষদের ভিটেয় দাদা-দাদিদের দেখতে। পরওয়ারদেগারের হুকুম, তাই মেয়েটি ও তার বাবা বোমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। তবে তার মা ও দুই মাস বয়সের ছোট্ট ভাই রক্ষা পায়নি। বেধড়ক বোমাবর্ষণে তাদের বস্তির অনেকগুলো ঘরবাড়ি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। পরদিন যখন হাজিজা তার বাবার সঙ্গে দাদা-দাদির গ্রাম থেকে নিজেদের বস্তিতে ফিরে আসে, তখনো বাড়ীগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া উঠছে; উড়ছে আগুনের ফুলকি। তার বাবা ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করতে থাকেন। হাজিজা ছোটাছুটি করে পথচারীদের মদদ করার আবেদন জানায়। কজন মানুষ তার ডাকে সাড়া দিয়ে এসে গনগনে ধ্বংসস্তূপের আগুন নেভাতে শুরু করে। একপর্যায়ে খবর পেয়ে আমিও ওখানে গিয়ে হাত লাগাই। সবকিছু নিয়ন্ত্রনে আনতে আনতে সন্ধ্যা নেমে আসে। শহরের কোথাও বৈদ্যুতিক বাতি নেই। তাই আমরা কাগজ পুড়িয়ে তার আলোয় কিছুক্ষণ উদ্ধারকাজ চালাই। একপর্যায়ে অনেকগুলো লাশের সঙ্গে মা ও বাচ্চাটির গোর দিতে গেলে জানাজার সময় হাজিজার বাপকে খুঁজে পাওয়া যায় না। খানিক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে তাকে পাওয়া যায় – একটি গাছের ডাল থেকে পাগড়ি পাকিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি ঝুলছেন... "
এভাবে বইয়ের পাতায় পাতায় আফগান জনগনের দুঃখগাঁথার সাথে পাবেন নানান ইতিহাস, ঐতিহ্য’র বর্ণনার সাথে সাথে অতি সাধারণ দিনযাপনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচারণ। কিভাবে শৈশবের স্বপ্নভুবন হারায় যুদ্ধের ময়দানে কখনো তা পড়বেন “শিশু সৈনিক ও বুলেট ভাস্কর্য” অথবা “তিন পুরুষের চিত্র জিহাদ” পরিচ্ছেদে পাবেন চিত্রশিল্পী পরিবারের তিন প্রজন্মের লড়াইয়ের কাহিনী। যখন আপনি পড়বেন এক সফেদ শ্মশ্রু বৃদ্ধ বুজুর্গ বালুকায় গর্তে তাঁর দুই পা ঢুকিয়ে বসে আছেন অসহনীয় প্রদাহ থেকে একটু আরাম পেতে। দেখবেন সেখানে এক পায়ের জন্য জুতো তৈরি হচ্ছে এবং তা বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে তখন আপনার চোখে নিশ্চয়ই অশ্রু জমবেন না... কিছুদিন আগে মার্কিন কোন এক বিশিষ্ট তারকা পর্যন্ত বলেছেন, “সন্ত্রাসের অজুহাতে আমরা মুসলমানদের যে অত্যাচার করেছি তা সব দিক দিয়ে সীমা অতিক্রম করে গেছে...”। আফগানরা প্রথমে নিস্পেশিত হয়েছে তালেবানদের অত্যাচারে, এরপর হচ্ছে বৈদেশিক শান্তির সন্ত্রাসীদের দ্বারা। আর বেশী লিখতে মন চাচ্ছে না।
তবে বইটি অবশ্যই সবার পড়ে দেখা উচিত, নইলে অনেক অজানা কথা থেকে আপনি বঞ্চিত থেকে যাবেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৮৪ পৃষ্ঠার এই বইয়ের গায়ের মূল্য রাখা হয়েছে ২৮৫ টাকা। বইটি নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট সহ দেশের ভালো মানের যে কোন বইয়ের দোকানে পাওয়া যাবে। বর্তমানে বইটির তৃতীয় মুদ্রন চলছে (আমি বইটির যে মুদ্রনটি পড়েছি)।
এই পর্বের ভ্রমণ সাহিত্যে আপনার মন খারাপ করে দিলাম হয়ত, কিন্তু কথা দিচ্ছি খুব শীঘ্রই আরেকটি মন ভালো করে দেয়ার ভ্রমণ সাহিত্য’র গল্প নিয়ে হাজির হব আপনাদের কাছে।