"বিলেতে সাড়ে সাতশ দিনঃ মুহম্মদ আবদুল হাই" (ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই - পর্ব ০৩)

দেশে বিদেশে - সৈয়দ মুজতবা আলী

দেশে বিদেশে - সৈয়দ মুজতবা আলী

  • বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন - মুহম্মদ আবদুল হাই
        ....বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন - মুহম্মদ আবদুল হাই ভ্রমণ নয়-স্মৃতি কথা, স্মৃতিকথা নয়-ভ্রমণ, এ দুয়ের সংমিশ্রণে এক আশ্চর্য রস সৃষ্টি করেছেন তিনি; তাতে সঙ্গীতের সম্মোহ সৃষ্টি করেছে ভাষা।... ‘আর তার আশার দানা-রঙীন গানের উপর আঁকা সাঁজেলিজে যেন একটি মিষ্টি তিলক ফোঁটা। শেষে আর্ক দু’ত্রয়ামফ। আট দিক থেকে আটটি রাস্তা এসে পায়ে কুর্নিশ করেছে।’ বিলেতে সাড়ে সাত শ দিনে’র ভাষা আশ্চর্য সঙ্গীতমুখর। অনুভব ও হৃদয় সংবেদনার মদিরতা মাখা তা স্বীকার করিতেই হবে। 

উপরের কথাগুলো প্রখ্যাত আব্দুল গাফফার চৌধুরী’র, মুহম্মদ আবদুল হাই এর “বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন। অনেকদিন হল “ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই” সিরিজ এর লেখা নেই। আসলে এতো ব্যাস্ততা আর তার মাঝে এতো এতো লেখার পোকা ঘুর ঘুর করে যে, প্রতিদিনই একটা করে লেখা দিতে মন চায়। যাই হোক শুরু করি আমার পঠিত মুহম্মদ আবদুল হাই এর “বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ নিয়ে আজকের লেখা।

মুহম্মদ আবদুল হাই এর “বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ মূলত আজ থেকে পাঁচ যুগ আগেকার সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত এবং ঐ সমসাময়িক কালেই প্রথম প্রকাশিত হয়। মুহম্মদ আবদুল হাই রচিত এ বইটি সেই অর্ধ শতাব্দী পূর্বেই ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা আজও ভ্রমণ সাহিত্য প্রিয় মানুষের নিকট সমানভাবে সমাদৃত। এর মূল কারণটা কি? কারণ, ধ্বনিবিদ মুহম্মদ আবদুল হাই তার দীর্ঘ প্রবাস জীবনকে যেমন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে অনুধাবুন করেছিলেন, তেমনি তৎকালীন ব্রিটিশ সভ্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন হৃদয় দিয়ে। লন্ডনের প্রকৃতি, মাটির রুপরসগন্ধ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও দৈনন্দিন জীবনের মাঝে লুকিয়ে থাকা বহমান সভ্যতা, ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়কে তিনি লেখনীর মাধ্যমে ছবির মত ফুটিয়ে তুলেছেন এই গ্রন্থে। 

এই বইতে মোট একত্রিশটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদেই লেখক লন্ডনের প্রতি তার ভালো লাগা এবং উচ্ছসিত হওয়ার সাথে সাথে নিজ দেশের একটি তুলনামূলক ছবি আঁকারও চেষ্টা করেছেন। তবে বইটি পড়তে গিয়ে এখনকার পাঠক কিছুটা ধাক্কা খেতে পারেন, কেননা তিনি বাংলাদেশকে পুরো লেখায় পাকিস্তান বলেই অভিহিত করেছেন, কেননা তখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির উদ্ভব হয় নাই। (কেউ কেউ আবার উনাকে রাজাকার ট্যাগ দিয়েন না ভাই 😜। 

একবারে শুরুর পরিচ্ছেদ থেকে আপনি দেখতে পাবেন লেখকের চারিপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সতর্ক অনুধাবন ক্ষমতা। প্লেনে চড়ে বসার পর থেকে লন্ডন পৌঁছে এবং সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে এই পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে লক্ষ্য করে গেছেন। একবারে শুরুর প্যারায় দেখুন, “... পাখীর মতো ডানা মেলে দিয়ে জীবনের প্রথম আজ নিজের দেশের আকাশে উড়ছি। নিজের দেশের শ্যামশোভা এমন ক’রে দেখার সুযোগ হয়নি কোনদিনও। নীচে ফসলের মাঠ আর তরুলতার সবুজ। ওপরে নীল শুন্য আকাশ। সাদা-কালো রঙ-বেরঙের মেঘমালায় ছোঁয়া লাগছে শরীরে ও মনে। ওপর থেকে মাঠঘাট দেখে মনে হচ্ছে কে যেন পাশার ছক পেতে রেখেছে। মানুষ ও মানুষের ঘরবাড়ীগুলো দেখে গালিভারের লিলিপুটের কথা মনে পড়ছে। অনন্তকাল-স্রোতের মধ্যে বুদ্বুদের মতো মানুষের জীবন-অবিরত ফুটছে ও ঝরছে। দুনিয়ার খেলাঘরে কয়েকটি মুহূর্ত কাটিয়ে দেবার জন্যে তার কত আয়োজন-আর নিজের শক্তির পরিচয়ে কি তার আনন্দ! কিন্তু ওপর থেকে এমন নির্লিপ্তভাবে দেখলে মানুষের ক্ষুদ্রতার কথা আশ্চর্যভাবে মনে প’ড়ে যায়... 

এমনতর লেখনী নিয়ে তরতর করে এগিয়ে গেছে এই ভ্রমণ কাহিনী। কখনো প্রকৃতি, কখনো মানুষের জীবনাচার, কখনো সেখানকার রীতিনীতি, সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে। কি নেই এই ভ্রমণ কাহিনী’র বইটিতে? পরতে পরতে পাবেন ক্রিসমাস থেকে শুরু করে ইউথ উৎসব হয়ে আমাদের মুসলমানদের ঈদের উৎসবের খুঁটিনাটি পর্যন্ত, পাবেন লাইব্রেরী থেকে নিয়ে বইয়ের দোকান হয়ে পাঠদান। আছে যোগাযোগের স্থলপথ-জলপথ থেকে শুরু করে টিউব রেলওয়ে। বোটানিক্যাল গার্ডেন, এমিউজমেণ্ট পার্ক থেকে শুরু করে মিউজিয়াম, লেক-নদী-পাহাড়ের কথা। আছে সেই সময়ের লন্ডনের শিক্ষা, আচার ব্যবহার, খেলাধুলা, শান্তি –শৃঙ্খলা ব্যাবস্থা থেকে শুরু করে খাবার-পানীয় নিয়ে লেখকের অভজারভেশন।

একশত বিশ পৃষ্ঠার এই বইটি বর্তমানে “স্টুডেন্ট ওয়েজ” প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। বইটির দামও খুব বেশী নয়, মাত্র একশত টাকার মত। আজ থেকে পঞ্চযুগ আগেকার ব্রিটিশ জীবনধারা সম্পর্কে জানতে বইটি পড়ে দেখতে পারেন। আশা করি নিরাশ হবেন না। 

এবার আমার ব্যাক্তিগত অভিমত বলি। লেখনের পুরো লেখনী জুড়ে লন্ডন শহরের প্রতি এক অতি আশ্চর্য মুগ্ধতা মিশে ছিল। ফলে সেখানকার জীবন ব্যাবস্থার তেমন কোন নেগেটিভিটি লেখনীতে খুঁজে পাওয়া যায় না তেমন একটা। যেমনটা আপনি পাবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র” বইটিতে। এটি সম্পূর্ণরুপে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। এই খুঁতটুকু ছাড়া আমার কাছে বইটি খুবই সুপাঠ্য মনে হয়েছে। প্রায় ছয় মাস পর এই সিরিজে লেখা দিলাম, এখন থেকে চেষ্টা থাকবে মাসে একটা করে হলেও লেখা দেয়ার।
আগের পর্ব পরের পর্ব

Translate

বোকা পর্যটকের কথা

মানুষ যেমন হঠাৎ করেই কারো প্রেমে পড়ে, ঠিক তেমনই করে আমিও প্রেমে পড়েছি ভ্রমণের। আজব এক নেশায় নেশাগ্রস্থ, কবে থেকে জানি না। তবে নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে লড়াই করে টিকে থাকার পর ভ্রমণে মনঃসংযোগ করতে উদ্যত হই। সেই থেকে যখনই সময়-সুযোগ হয় বেড়িয়ে পড়ি ঘর হতে, ভ্রমণের তরে। মজার ব্যাপার হল, আমি সাইক্লিস্ট নই, সাঁতার কাটতে পারি না, না পারি ট্র্যাকিং, হাইকিং, ক্লাইম্বিং। কোন ধরণের এডভেঞ্চারধর্মী কোন গুণই আমার নেই, শুধু আছে ভ্রমণের শখ আর অদম্য ইচ্ছাটুকু। আর সেই ইচ্ছা থেকেই সময় সময় আমার ঘুরে বেড়ানো আর সেই গল্পগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখা এই ডায়েরীতে। আমার এই লেখাগুলো বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লেখা ছিল; সেগুলো সব একত্রে সংরক্ষণ করে রাখার নিমিত্তেই এই ব্লগ। যদি আপনাদের কারো এই লেখাগুলো কোন কাজে লাগে তবে আমার পরিশ্রম কিছুটা হলেও সার্থক হবে।

পোস্ট সংরক্ষণাগার

যোগাযোগ ফর্ম

প্রেরণ