চঞ্চলা ঝর্ণা তার মোহিনী রূপে যুগে যুগে মানব হৃদয়ে পাগলপারা ঢেউয়ের দোলা তুলে বয়ে গেছে অবিরত। আর এই ঝর্ণার টানে মানুষ ছুটে গেছে দুর্গম থেকে দুর্গমতর এলাকায়। কিন্তু পাশাপাশি দুটি ঝর্ণা, তাও যদি বান্দরবান বা খাগড়াছড়ি’র মত কোন দুর্গম এলাকায় না হয়ে হাতের নাগালে কোন এলাকায় হয়, সাথে সিঁড়িকাটা পথ বেয়ে নেমে খানিকটা নিরীহ ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে গেলেই দেখা মেলে তবে তো সোনায় সোহাগা! জ্বী, এমনই দুটি ঝর্ণা সুপ্তধারা এবং সহস্রধারা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক এর ভেতরে এই দুটি ঝর্ণা বর্ষাকালে তার রূপের পেখমমেলে ডাক দিয়ে যায় প্রকৃতিপ্রেমীদের অবিরত। আর গেল বর্ষায় এই ডাকে সাড়া দিতে চিটাগাং হান্টের হট লিস্টে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছিল এই দুটি ঝর্ণার নাম।
গেল রমজানের ঈদের পরের সপ্তাহে এক সপ্তাহের লম্বা ট্যুরে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। দলের সদস্যসংখ্যা মাত্র দুই, আমি আর ভ্রমণবন্ধু হাসিব। চষে বেড়িয়েছিলাম চট্টগ্রাম এবং এর আশেপাশের প্রায় পনের-বিশটি ট্যুরিস্ট স্পট। চিটাগাং পৌঁছানোর পর থেকে আমরা বৃষ্টির জালে বন্দী ছিলাম। প্রথম দুইদিন বৃষ্টির কবলে বন্দী থেকে তৃতীয়দিন থেকে হান্টিং আরম্ভ হয়। কিন্তু বিধিবাম! সেদিন সীতাকুণ্ড পাহাড়ের চুড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির এবং এর আশেপাশের অপরূপ সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকার পর সমতলে নেমে এসে পঁচা শামুকে পা কাটার মত খেলাম ধপাস করে এক আছাড়, যা নিয়ে চন্দ্রনাথ মন্দির – সীতাকুণ্ড পাহাড়, আর আমার সেইরাম একটা আছাড়!!! :( পোস্টে আগেই বিশদ গল্প করা হয়েছে। আর ফলস্বরূপ সেদিন পাশের ইকোপার্ক আর হটলিস্টের সুপ্তধারা-সহস্রধারা ঝর্ণা না দেখে ফেরত যায় চট্টগ্রামস্থ হাসিবের বড় ভাইয়ের বাসায়, যেথায় আমরা ফেলেছিলাম আমাদের এক সপ্তাহের ডেরা। একদিন বিরতি দিয়ে পরেরদিন আমরা আবার যাই সেই অতিকাঙ্ক্ষিত সেই ঝর্ণাযুগলের রূপসুধা পান করার নিমিত্তে।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও চলছিল বৃষ্টি আর রোদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা, সাথে আমার কোমরে পাওয়া আঘাতের ব্যাথার বিড়ম্বনা। এই দুইকে সাথী করে বেলা নয়টায় রওনা দিয়ে এগারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম সীতাকুণ্ড ইকোপার্কের গেটে। বাস থেকে নেমে গেট অবধি যাওয়ার পথটুকু হবু ফটোগ্রাফার হাসিবের সাথে আমারও চলল প্রকৃতির ফটোসেশনে সময় দিয়ে দিয়ে। গেটে গিয়ে পাহাড়ি পথের হ্যাপা থেকে বাঁচতে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঝর্ণার সিঁড়ি’র দোরগোড়া পর্যন্ত যাওয়ার মনস্থির করলাম। কিন্তু বাঁধা হল এই অটোরিকশা চালকদের সিন্ডিকেট। স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশী ভাড়া হাঁকলো। শেষে পাঁচশ টাকার চুক্তিতে সিএনজি নিয়ে ছুটলাম সুপ্তধারা ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। সেখানে যাওয়ার পথে গেটের দারোয়ান, স্থানীয়দের বললাম যে সহস্রধারা ঝর্ণাও যেতে চাই। সবাই বলল সেখানে যাওয়া একটু রিস্কি, না যাওয়াই বেটার, বেশীরভাগ ট্যুরিস্ট সুপ্তধারা ঝর্ণাই দেখতে আসে। কি আর করা, মন খারাপ নিয়ে চললাম সুপ্তধারা ঝর্ণা’র উদ্দেশ্যে।
সেখানে পৌঁছে সিএনজি ছেড়ে দিলাম, কথা হল তার মোবাইলে ফোন দিলে সে আবার আমাদের নিতে চলে আসবে। এখন সে মেইনগেটে আবার ফেরত যাচ্ছে নতুন কাস্টমার ধরতে!!! কি আর করা, দ্বিমত করলাম না। সিঁড়ি বেয়ে আমি আর হাসিব নামতে থাকলাম নীচের দিকে। কিছুক্ষণ নামার পর ঝর্ণার জলপতনের শব্দ শুনতে পেলাম। আরও কিছুক্ষণ নেমে খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়ে দেখা পেলাম সুপ্তধারা ঝর্ণার। এই ঝর্ণা হয়ত নাফাখুম, অমিয়াখুম, মাধবকুণ্ড, রিজুক এর মত তীব্র, আকর্ষণীয় বা বড় নয়, কিন্তু অদ্ভুত এক মায়াময় আকর্ষণী ক্ষমতা আছে এই ঝর্ণার। অন্য ঝর্ণাগুলো যদি হাই মেটাল রক বা উচ্চ মার্গের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হয়ে তবে এই ঝর্ণাদ্বয় হবে গ্রাম বাংলার রাখালের ক্লান্ত শরীরে ভর দুপুরে বাঁশিতে তোলা কোন পথ ভুলা সুর। আর এই সুরে তন্ময় হতে আমার মত বোকা মানুষের কখনোই অরুচি হওয়ার কথা নয়।
ঝর্ণা’র কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে আবার বৃষ্টি পড়া শুরু হল, কি যন্ত্রণা! আমরা জনা পাঁচেক ভ্রমনার্থী যখন জলকেলিতে মত্ত, তখন আমাদের সঙ্গী হয়ে নয় জনের একটি দল এসে পৌঁছল সুপ্তধারা’র কাছে। আর কি? সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠলাম। পরিচয় হল, গল্প হল, তারা সকাল নয়টায় শুরু করে চন্দ্রনাথে ওঠা, সেখান থেকে সরাসরি নেমে এসেছে সুপ্তধারায়। এখান থেকে যাবে সহস্রধারা, আমি আর হাসিব তাদের সহযাত্রী হতে চাই জানাতে দ্বিমত করল না। সবাই মিলে ঘণ্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রওনা হলাম সহস্রধারা’র উদ্দেশ্যে।
আমাকে আর হাসিবকে মেইনগেটে সবাই যতটা ভয়ের আর রিস্কের কথা বলেছিল তার ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাই নাই সহস্রধারা ঝর্ণা’র ঐ পথে। তবে এটা সত্যি মাঝে মাঝে ঐ ঝর্নায় যাওয়ার ঝিরিপথে ছিনতাই এর ঘটনা ঘটে, বিশেষ করে ছোট দল নিয়ে গেলে। যাই হোক প্রায় বারো জনের দল একসাথে শ’পাঁচেক নানান রকমের সিঁড়ি মাড়িয়ে নেমে এলাম সহস্রধারার ঝিরিপথে। এরপর ঝিরিপথ ধরে মিনিট দশেক হাঁটার পর চলে এলাম সহস্রধারায়। এই ঝর্ণার নাম কেন সহস্রধারা তা বুঝে পেলাম না। যাই হোক, এই ঝর্ণা আরও বেশী মনকাড়া। এবার আবার জলে ভেজার পালা আর তার সাথে মনভরে ছবি তোলা। কারণ, তখন বৃষ্টি থেমে আবার সূর্যের দেখা মেলেছে। ততক্ষণে সদ্য পরিচিত হওয়া ঐ দলের সবাই বন্ধুতে পরিণত হয়েছে যেন। গল্প, ঠাট্টা, হাসি-তামাশা চলতে লাগলো সমান তালে।
স্মরণীয় কিছু সময় কাটিয়ে সবাই মিলে রওনা হলাম ফিরতি পথে। আমার হাসিবের গন্তব্যে শেষ বিকেলে মহামায়া’র মায়াবী কোল। আমাদের নব্য বন্ধুমহল ঐক্যমতে না পৌঁছতে পারায় আমাদের সাথী না হয়ে তাদের ডেরার দিকে রওনা হল। আমি হার হাসিব ছুটলাম মহামায়ার উদ্দেশ্যে। সেই গল্প আরেকদিন শোনাবো কথা দিয়ে বিদায় নিলাম।